চিনা ড্রাগনের গলায় পা! যন্ত্রণায় ছটফট করলেও পালাবার পথ নেই। শক্তিধর বেজিংকে হাঁটু মুড়ে বসতে বাধ্য করছে ইউরোপের ‘বাঁধের দেশ’ নেদারল্যান্ডস। ডাচদের এক ঘুষিতে ড্রাগনের সাধের ‘সেমিকন্ডাক্টর’ সাম্রাজ্যের দফারফা হওয়ার জোগাড়। তাসের ঘরের মতো সে সাম্রাজ্যের ভেঙে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দিচ্ছেন না বিশ্লেষকেরা।
চলতি কথায় সেমিকন্ডাক্টরকে বলা হয় চিপ। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন থেকে শুরু করে যাবতীয় বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের ‘প্রাণভোমরা’ হল এই সেমিকন্ডাক্টর। ব্যাটারিচালিত গাড়ি হোক বা উন্নত ফৌজি হাতিয়ার, চিপের ব্যবহার সর্বত্র। বিশেষজ্ঞদের একাংশের অনুমান, আগামী দিনে দুনিয়া শাসন করবে এই সেমিকন্ডাক্টর।
মজার বিষয় হল, যে যন্ত্রের সাহায্যে চিপ তৈরি হয়, তার একমাত্র নির্মাণকারী দেশ হল নেদারল্যান্ডস। অন্য দিকে, দুনিয়ার অন্যতম বড় সেমিকন্ডাক্টর হাব রয়েছে চিনে। এত দিন পর্যন্ত সেখানে ওই যন্ত্র সরবরাহ করছিল ডাচ সংস্থা ‘এএসএমএল হোল্ডিং’। কিন্তু সম্প্রতি বেজিংকে সেগুলি রফতানি করার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে আমস্টারডাম।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ডাচ বৈদেশিক বাণিজ্য ও উন্নয়নমন্ত্রী রাইনেটে ক্লেভের রফতানির নিয়মে বড় পরিবর্তন আনেন। এর ফলে আপাতত চিনা শিল্প সংস্থাগুলিকে সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণকারী যন্ত্র সরবরাহ করতে পারবে না ‘বাঁধের দেশের’ নামী সংস্থা এএসএমএল। এর জন্য লাইসেন্স চেয়ে নতুন করে আবেদন করতে হবে তাদের।
আমস্টারডামের এই সিদ্ধান্তের কথা জানাজানি হতেই বেজিঙের টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির শেয়ারের দর হু হু করে পড়তে শুরু করে। নেদারল্যান্ডসের ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তাদের সম্পত্তি কমে ২৮ শতাংশ। এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে ড্রাগনভূমির কারখানাগুলির পক্ষে চিপ নির্মাণ যে একরকম অসম্ভব হয়ে পড়বে, তা বলাই বাহুল্য।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে পেরে এই ইস্যুতে বিবৃতি দিয়েছে চিনা বিদেশ মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়েছে, ডাচদের এ-হেন সিদ্ধান্তের ফলে দুনিয়ার অন্য দেশগুলিকেও আর্থিক দিক থেকে ভারী লোকসান সহ্য করতে হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা অবশ্য এর নেপথ্যে খুঁজে পেয়েছেন আমেরিকার ছায়া। তাঁদের দাবি, বেজিংকে চাপে ফেলতে আমস্টারডামকে কাজে লাগাচ্ছে ওয়াশিংটন।
বিশ্লেষকদের এই যুক্তিকে একেবারে অমূলক বলা যাবে না। কিন্তু, শুধুমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের কথাতেই ডাচেরা ড্রাগনের থেকে মুখ ফিরিয়েছে, তা ভাবা ঠিক নয়। পশ্চিমি সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, জাতীয় নিরাপত্তার কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত এই চরম সিদ্ধান্ত নিতে একরকম বাধ্য হয়েছে ইউরোপের বাঁধের দেশ। এ ব্যাপারে চিনা গুপ্তচরদের বড় ভূমিকা রয়েছে বলে একাধিক প্রতিবেদনে স্পষ্ট করা হয়েছে।
সেমিকন্ডাক্টর তৈরির যন্ত্রাংশ একমাত্র নেদারল্যান্ডস থেকেই সরবরাহ হওয়ায় ভবিষ্যতে সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে বলে আগেই আঁচ করেছিল ড্রাগন। ফলে ওই যন্ত্রাংশ কী ভাবে নিজের দেশে উৎপাদন করা যায়, তার নীল নকশা ছকতে শুরু করে বেজিং। অভিযোগ, এই প্রযুক্তি ডাচদের থেকে চুরি করতে সেখানে গুপ্তচর পাঠায় বেজিং।
২০২২ সালে বেজিংয়ের এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যায়। ওই বছর বেশ কয়েক জন কর্মীকে ছাঁটাই করে ডাচ সংস্থা এএসএমএল। কোম্পানির তরফে জানানো হয়, এই কর্মচারীরা চিপ তৈরির বিভিন্ন যন্ত্রের জটিল প্রযুক্তি চিনা সংস্থাকে মোটা টাকার বিনিময়ে বিক্রি করেছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে রুজু হয় ফৌজদারি মামলা।
ডাচ প্রযুক্তি চুরির চেষ্টা ড্রাগন যে ২০২২ সালে প্রথম বার করেছে, এমনটা নয়। এর আগে ২০১৮ সালে চিনা সংস্থা ‘ডংফুং জ়িংগুয়ান’-এর বিরুদ্ধে এএসএমএলের ‘বুদ্ধিবৃত্তিমূলক সম্পত্তি’ (ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি) চুরির অভিযোগ ওঠে। বেজিংভিত্তিক কোম্পানিটির প্রতিষ্ঠাতা ইউ জ়ংচ্যাং একটা সময়ে ডাচ সংস্থাটিরই কর্মী ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী কালে এএসএমএলের আরও দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে নতুন সংস্থা খোলেন তিনি।
‘ডংফুং জ়িংগুয়ান’ ডাচ সংস্থাটির মতোই চিপ বানানোর যন্ত্রাংশ তৈরি করে। সেগুলি দেখতে হুবহু এএসএমএল নির্মিত সামগ্রীর মতোই। বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, এই ধরনের গুপ্তচরবৃত্তির উপর ভর করে অতি সম্প্রতি তিন ন্যানোমিটারের ট্রানজ়িস্টর তৈরি করে ফেলেছে চিন। যদিও এ ব্যাপারে পোক্ত কোনও প্রমাণ মেলেনি।
‘নেদারল্যান্ডস টাইমস’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এএসএমএলের মতো ডাচদের ৯০০টি বড় প্রযুক্তি সংস্থায় বিপুল শেয়ার রয়েছে চিনের কব্জায়। একে জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে সবচেয়ে বড় বিপদ বলে উল্লেখ করেছেন আমস্টারডামের গোয়েন্দাকর্তারা। এই প্রযুক্তি সংস্থাগুলির মাধ্যমে তাঁদের প্রতিটা পদক্ষেপের উপর বেজিং কড়া নজর রাখছে বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা।
সূত্রের খবর, গোয়েন্দাকর্তাদের ওই রিপোর্ট পাওয়ার পর থেকেই নড়েচড়ে বসে ডাচ প্রশাসন। তড়িঘড়ি চিনের সঙ্গে চিপ নির্মাণকারী যন্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার ঘোষণা করেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ান এবং আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার উপরেও জোর দিয়েছে আমস্টারডাম।
গত বছর (পড়ুন ২০২৩) ‘চিপ ফোর’ গোষ্ঠীতে যোগ দেয় নেদারল্যান্ডস। এই গোষ্ঠীতে মোট চারটি দেশ রয়েছে। সেগুলি হল, আমেরিকা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া এবং তাইওয়ান। সেমিকন্ডাক্টর তৈরির নিরিখে এই চার দেশের জুড়ি মেলা ভার। আগামী দিনে এদেরকেই চিপ নির্মাণকারী যন্ত্রাংশ বহুল পরিমাণে সরবরাহ করবে বলে জানিয়েছে আমস্টারডাম।
যদিও এখনই সরাসরি চিনের সঙ্গে সম্মুখসমরে যাচ্ছে না ইউরোপের বাঁধের দেশ। তাঁদের সিদ্ধান্ত ‘স্বল্পমেয়াদি’ এবং ‘সাময়িক’ বলে বেজিংকে বার্তা দিয়েছে আমস্টারডাম। ২০৫০ সালের মধ্যে সামরিক দিক থেকে আমেরিকা ও রাশিয়াকে টপকে যাওয়ার স্বপ্ন দেখছেন ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি। ডাচদের ধাক্কায় তাঁর সেই স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বর্তমানে প্রতি বছর ৩০ হাজার কোটি ডলারের সেমিকন্ডাক্টর নির্মাণকারী যন্ত্রাংশ নেদারল্যান্ডস্ থেকে আমদানি করে চিন। সেখান থেকে আসে চিপ তৈরির ‘ডিপ আল্ট্রাভায়োলেট মেশিন’। সেমিকন্ডাক্টরের লিথোগ্রাফি সিস্টেমের জন্য খুচরো যন্ত্রাংশ ও সফ্টঅয়্যার আপডেটের কাজও করে ডাচ সংস্থা। প্রযুক্তি চুরি করলেও সেই ব্যবস্থা রাতারাতি বানিয়ে ফেলা ড্রাগনের পক্ষে একরকম অসম্ভব, বলছেন বিশেষজ্ঞেরা।
১৯৮৮ সালে চিনা বাজারে পা রাখে ডাচ সংস্থা এএসএমএল। এখন পর্যন্ত ড্রাগনভূমিতে হাজারের বেশি মেশিন এবং লিথোগ্রাফি সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে তারা। এএসএমএল নির্মিত যন্ত্রে সাত ন্যানোমিটারের চেয়ে ছোট চিপ তৈরি করা যায়। দুনিয়ার সবচেয়ে উন্নত সেমিকন্ডাক্টর তৈরির সুনাম রয়েছে ডাচ সংস্থাগুলির যন্ত্রের।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, চিপ যত ছোট হয় তত ভাল হয় তার অপারেটিং সিস্টেম। আর তাই ছোট সেমিকন্ডাক্টর বানাতে এর ভিতরের ট্রানজ়িস্টারকেও সেই মাপে তৈরি করতে হবে। ১৯৫০ সালে এই নিয়ে গবেষণা শুরু করে আমেরিকা। ৪০ বছর পর ১৯৯০ সালে এ ব্যাপারে সাফল্য পান যুক্তরাষ্ট্রের গবেষকেরা।
যদিও ওই সময়ে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির যন্ত্র বানিয়ে বিপুল খরচের ধাক্কা নিতে রাজি ছিল না যুক্তরাষ্ট্র। ফলে প্রযুক্তিটি দ্রুত ‘বন্ধু’ দেশ নেদারল্যান্ডসের হাতে তুলে দেয় ওয়াশিংটন। এর পর আমেরিকার দেওয়া প্রযুক্তিতে শান দিয়ে তাকে আরও ধারালো করে তোলে আমস্টারডাম। ২০১৮ সালে ১৩ ন্যানোমিটারের চিপ নির্মাণকারী যন্ত্র তৈরি করে ডাচ সংস্থা এএসএমএল।
গত তিন-চার বছর ধরে ঘরের মাটিতে চিপ তৈরির উপর জোর দিয়েছে ভারতও। নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে বেজিংয়ের দূরত্ব তৈরি হওয়ায় নয়াদিল্লির লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী দিনে ডাচ সংস্থাগুলি তাঁদের যন্ত্র সরবরাহের নতুন বাজার হিসাবে ভারতকে বেছে নেয় কি না, সেটাই এখন দেখার।
সব ছবি: সংগৃহীত।