একেই বলে সোনায় সোহাগা! দুনিয়ার সবচেয়ে বড় হলুদ ধাতুর খনির হদিস পেল চিন। সূত্রের খবর, সেখানে লুকিয়ে থাকা সোনার পরিমাণ আনুমানিক হাজার টন। এই খনি যে আর্থিক দিক থেকে বেজিংকে আরও শক্তিশালী করল, তা বলাই বাহুল্য।
শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ড্রাগনল্যান্ডের নতুন সোনার খনি সংক্রান্ত খবর জানাজানি হতেই বিশ্ব জুড়ে শোরগোল পড়ে যায়। চিনা সরকারি সংবাদমাধ্যমের দাবি, খনিতে লুকিয়ে থাকা হলুদ ধাতুর আনুমানিক বাজারদর ৮ হাজার ৩০০ কোটি ডলার।
এত দিন পর্যন্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণখনির মালিক ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। সেখানকার ‘সাউথ ডিপ’ খনিতে রয়েছে ৯০০ টন হলুদ ধাতু। এ বার সেই মুকুট বেজিংয়ের মাথায় উঠতে চলেছে।
চিনের হুনান প্রদেশের পিংজিয়াং কাউন্টিতে বিশ্বের সর্বাধিক বড় স্বর্ণখনিটি অবস্থিত বলে জানা গিয়েছে। স্থানীয় ভূতাত্ত্বিক ব্যুরো জানিয়েছে, মাটির নীচে মাত্র দু’কিলোমিটার গভীরতায় ছড়িয়ে আছে ৪০টি স্বর্ণ শিরা বা গোল্ড ভেন।
মাটির নীচে তাল তাল সোনা জমে যাওয়ার নেপথ্যে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। ভূবিজ্ঞানীদের দাবি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ভূপৃষ্ঠের ভিতরের পাথরের মধ্যে দিয়ে গলিত তরল সোনার স্রোত চলাচল করছে।
তরল অবস্থায় থাকায় হলুদ ধাতু ভূত্বকের ফাটল এবং ফাটলের মাধ্যমে সঞ্চালিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে ওই তরল আশপাশের শিলা থেকে সোনা দ্রবীভূত করে। ফলে ধীরে ধীরে অবস্থার পরিবর্তন হয়ে তা ভূত্বকের নীচে জমাট বাঁধতে থাকে। এ ছাড়া চাপ ও তাপের পরিবর্তনের জেরেও তরল সোনা জমে যায় বলে জানিয়েছেন ভূবিজ্ঞানীরা।
হুনানের ভূতাত্ত্বিক ব্যুরোর অনুমান, শুধুমাত্র স্বর্ণ শিরা থেকেই ৩০০ মেট্রিক টন সোনা পাওয়া যেতে পারে। খনিতে হলুদ ধাতুর পরিমাণ জানতে ‘থ্রিডি মডেলিং’ পদ্ধতির সাহায্য নিয়েছেন তাঁরা।
সুপার কম্পিউটার পরিচালিত থ্রি ডি মডেলিং পদ্ধতিতে জানা গিয়েছে, খনির গভীরে অতিরিক্ত সোনা পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য ভূগর্ভের তিন কিলোমিটার নীচে নামতে হতে পারে খনি শ্রমিকদের। একে অবশ্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে উল্লেখ করেছে ভূতাত্ত্বিকদের দল।
চিনা ভূতাত্ত্বিক ব্যুরোর পদস্থ কর্তা চেন রুলিন জানিয়েছেন, স্বর্ণখনির হদিস পেতে পাথুরে ভূপৃষ্ঠের কোর এলাকা খোদাই করতে হয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘খনি থেকে তোলা প্রতি টন হলুদ ধাতু শোধন করলে ১৩৮ গ্রাম বিশুদ্ধ সোনা পাওয়া যাবে।’’
বিশেষজ্ঞদের দাবি, বেজিংয়ের দাবি সত্যি হলে হুনানের স্বর্ণ আকরিককে উৎকৃষ্ট মানের বলে স্বীকৃতি দিতে হবে। উল্লেখ্য, আকরিক শোধন করে ৮ গ্রাম বা তার বেশি সোনা পাওয়া গেলে এই তকমা দেওয়া হয়।
নতুন স্বর্ণখনির আবিষ্কার চিনা হলুদ ধাতুর শিল্পে বড় প্রভাব ফেলতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী স্বর্ণ উৎপাদনের ড্রাগনল্যান্ডের অবদান ১০ শতাংশ। চলতি বছরের গোড়ায় বেজিংয়ের কাছে দু’হাজার টনের বেশি সোনা মজুত রয়েছে বলে খবর মিলেছে। যার উপর ভিত্তি করে বিশ্বের স্বর্ণ বাজারের উপর আধিপত্য বিস্তার করেছে চিন।
হুনানের স্বর্ণখনির অবিষ্কারের খবর ছড়িয়ে পড়তেই বিশ্ব বাজারে ফের হলুদ ধাতুর দর চড়তে শুরু করেছে। পূর্ব ইউরোপ (পড়ুন রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ) এবং পশ্চিম এশিয়ায় (পড়ুন ইজ়রায়েল ও হামাস-হিজ়বুল্লার সংঘাত) ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে সম্প্রতি এর সূচক নামতে দেখা গিয়েছিল।
চিনা সরকারি সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার জেরে সোনা-সহ অন্যান্য মূল্যবান ধাতুর চাহিদা ড্রাগনল্যান্ডে উত্তরোত্তর বাড়ছে। ফলে এই আবিষ্কার দেশের সম্পদের নিরাপত্তা রক্ষায় তাৎপর্যপূর্ণ হতে পারে বলে দাবি করেছে হুনান ভূতাত্ত্বিক ব্যুরো।
গত কয়েক বছর ধরেই আর্থিক ভাবে নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে চিন। ডলারের নিরিখে বেশ দুর্বল হয়েছে চিনা মুদ্রা ইউয়ানের দর। নেমেছে জিডিপির সূচক। ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় নতুন করে ওয়াশিংটনের সঙ্গে শুল্ক যুদ্ধের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে নতুন স্বর্ণখনির আবিষ্কারকে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের কাছে ‘দেবতার আশীর্বাদ’ বলেই উল্লেখ করেছেন দুনিয়ার তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরা। সোনার পাশাপাশি খনিজ তেল-সহ দামি ধাতুর খোঁজ পেতে গত দু’বছরে কোটি কোটি ডলার খরচ করেছেন তিনি।
২০২২ সালে খনিজ সম্পদের সন্ধান পেতে ১.১ লক্ষ কোটি ইউয়ান খরচ করে বেজিং। ভারতীয় মুদ্রায় এর পরিমাণ ১.২৭ লক্ষ কোটি টাকা। ধাতু শিল্পে বিদেশি নির্ভরতা কমাতে ড্রাগন-সরকার ওই সিদ্ধান্ত নেয় বলে জানা গিয়েছে।
উল্টো দিকে চিনে বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্বর্ণখনির আবিষ্কার যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে কিছুটা ‘ব্যাকফুটে’ ফেলল বলেও মনে করা হচ্ছে। কারণ, এই খনির উপর ভর করে বেজিং অর্থনীতি দৌড়তে শুরু করলে সেখানে আমেরিকান লগ্নিকারীদের বিনিয়োগ বাড়বে। সে ক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের পক্ষে সরাসরি শুল্ক যুদ্ধে নামা বেশ কঠিন হয়ে পড়বে।
একই কথা ভারতের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই ঘটনায় বিদেশি লগ্নিকারীদের মুম্বই থেকে মুখ ফিরিয়ে বেজিংয়ের রাস্তা ধরায় উৎসাহ দিতে পারে। তবে এখনও খনি থেকে উৎপাদন শুরু হয়নি। ফলে দ্রুত অর্থনীতির বদলের সম্ভাবনা বেশ কম বলে জানিয়েছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
উল্লেখ্য, আগামী দিনে এই ধরনের স্বর্ণখনির সন্ধান দুনিয়ার অন্য কোনও প্রান্তে মিলবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। তবে ভূতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন, সোনার মতো মূল্যবান ধাতু ভূগর্ভে প্রচুর পরিমাণে জমা রয়েছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।