রাশিয়ার ক্রাসনোদার এলাকার দম্পতি দিমিত্রি বকশিভা এবং নাতালিয়া বকশিভা। রাশিয়ানরা অবশ্য এই দম্পতিকে চেনেন ‘নরখাদক দম্পতি’ হিসাবে।
প্রথমে এক স্থানীয় মহিলাকে খুন করার অভিযোগ ওঠে এই দম্পতির নামে। ধীরে ধীরে এই দম্পতির খুনের সংখ্যা আরও বাড়তে থাকে। অভিযোগ, খুন করার পর তাঁদের মাংসও খেত এই দম্পতি। ৩০টি খুনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে এই দম্পতিকে ২০১৯ সালে কারাগারে পাঠানো হয়।
১৯৮২ সালে দিমিত্রি এবং ১৯৭৫ সালে জন্ম নাতালিয়ার। কিছু সময়ের জন্য নাতালিয়া একটি স্থানীয় সেনা স্কুল সাফাইকর্মীর কাজ করতেন। মদ্যপানের অভ্যাস থাকার কারণে তাঁকে সেই স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয়।
দিমিত্রির নামও অনেক আগেই পুলিশের খাতায় উঠেছিল। ডাকাতি এবং গাড়ি চুরির জন্য তাকে জেলেও যেতে হয়। জেল থেকে ফেরার পর সে বাড়ি মেরামতির কাজ করতে শুরু করে।
২০১২ সাল থেকে এই দম্পতি একটি ছাত্রাবাসের ঘরে একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। এই ঘর নাতালিয়া তার আগের স্বামীর কাছ থেকে পেয়েছিল। দিমিত্রি এবং নাতালিয়ার একসঙ্গে অপরাধ জীবনের সূত্রপাত এই ঘর থেকেই।
কিন্তু কী ভাবে এই দম্পতির যাবতীয় অপরাধের ঘটনা পুলিশের হাতে আসে?
এক বার নিজের মোবাইল ফোন হারিয়ে ফেলে দিমিত্রি। এই মোবাইল ফোন হারানোই কাল হয় দিমিত্রি এবং নাতালিয়ার জন্য। প্রকাশ্যে আসে এই দম্পতির যাবতীয় অপরাধের ঘটনা।
দিমিত্রির হারানো মোবাইল হাতে আসে এক দল নির্মাণ শ্রমিকের। ফোন খুলে তাঁরা দেখেন, এক মহিলার মৃতদেহের সঙ্গে দিমিত্রির ছবি। এর মধ্যে একটি ছবিতে দিমিত্রিকে মৃতদেহের পা মুখে করে ধরে থাকতেও দেখা যায়। ছবিগুলি দেখে সঙ্গে সঙ্গে ফোন নিয়ে পুলিশের কাছে যান ওই শ্রমিকরা।
ফোন পেয়ে দিমিত্রিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডেকে পাঠায় পুলিশ। দিমিত্রি জানায়, একটি ঝোপের মধ্যে সে এই মহিলার দেহাবশেষ খুঁজে পেয়েছিল। কিন্তু খুনের কথা অস্বীকার করে দিমিত্রি।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, দিমিত্রির হাতেই খুন হয়েছেন ওই মহিলা। খুনে সঙ্গ দিয়েছেন নাতালিয়াও। মৃত ওই মহিলার নাম এলেনা ভাখরুশেভা। ২০১৭ সালের ৮ সেপ্টেম্বর একসঙ্গে মদ্যপানের পর নাতালিয়া এবং এলেনার মধ্যে হঠাৎ ঝগড়া শুরু হয়। এর পর এলেনাকে নৃশংস ভাবে খুন করে নাতালিয়া এবং দিমিত্রি।
ছুরির একাধিক আঘাতে খুন করা হয় এলেনাকে। এর পর বকশিভা- দম্পতি এলেনার মৃতদেহ টুকরো টুকরো করে আশপাশের এলাকায় আলাদা আলাদা করে ফেলে দেয়। এর মধ্যে কিছু দেহাবশেষ বাড়িতেও রেখে দেওয়া হয়।
দম্পতির বা়ড়িতে তল্লাশি করতে গিয়ে নুন জলে হিমায়িত করে রাখা মানবদেহের আলাদা আলাদা টুকরো উদ্ধার করে পুলিশ। পরীক্ষা করে দেখা যায় হিমায়িত করে রাখা এই টুকরোগুলি আলাদা আলাদা মানুষের।
দিমিত্রি এবং নাতালিয়ার বিরুদ্ধে একাধিক খুনের অভিযোগ এনে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। দিমিত্রির ফোন ঘেঁটে উদ্ধার করা হয় আরও অনেক ছবি। যার মধ্যে ১৯৯৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, দিমিত্রি মানবদেহের কাটা মুণ্ড একটি থালায় রেখে ছবি তুলেছে।
শহর জুড়ে দম্পতির নরখাদক হওয়ার জল্পনা আরও জোরালো হতে শুরু করে।
দ্রুত গুজব ছড়াতে শুরু করে যে, ১৯৯৯ সাল থেকেই মানুষ খুন করে তাঁদের মাংস থেকে শুরু করেছিল এই দম্পতি। এ কথাও ছড়িয়ে পড়ে, খুনের আগে শিকারদের উপর শারীরিক নির্যাতনও করা হত। অভিযোগ ওঠে, দম্পতি খুনের পর মৃতদেহগুলি রান্না করে খেত। নিজেরা খাওয়ার পাশাপাশি এই মাংস সংরক্ষণ করে বিভিন্ন জায়গায় সরবরাহ করা হত বলেও অভিযোগ ওঠে।
একই সঙ্গে এ-ও অভিযোগ উঠেছিল, নাতালিয়া যে সেনা স্কুলে কাজ করত সেখানেও সংরক্ষণ করা মানুষের মাংস সরবরাহ করা হত। তবে যাঁরা এই মাংস কিনতেন, তাঁদের ন্যূনতম ধারণা ছিল না যে, তাঁরা মানুষের মাংস কিনছেন।
পুলিশি জেরার মুখে এই দম্পতি মোট ৩০ জনকে খুন করার কথা স্বীকার করে নেয়।
২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে নাতালিয়াকে রাশিয়ার এক আদালতে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। একাধিক খুনে প্ররোচনা দেওয়ার জন্য তাকে দোষী সাব্যস্ত করে আদালত। নাতালিয়াকে সাড়ে ১১ বছরের জেলের সাজা দেওয়া হয়। নাতালিয়া একাধিক আবেদন করার পরও আদালতের তরফে সিদ্ধান্ত বদল হয়নি।
২০১৯ সালের ২৮ জুন দিমিত্রিকেও ১২ বছরের কারাদণ্ডের সাজা শোনানো হয়। পাশাপাশি তাকে এক জন মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে থাকারও পরামর্শ দেয় আদালত।
২০২০-এর ১৬ ফেব্রুয়ারি হেফাজতে থাকাকালীনই মধুমেহ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় দিমিত্রি।