সেই কবে ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের সংলাপে দ্বিজেন্দ্রনাথ রায় লিখেছিলেন, ‘সত্যিই সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’ এ দেশের বিচিত্র সব চরিত্র দেখে সেনাপতি সেলুকাসের উদ্দেশে সেই মন্তব্য করেছিলেন আলেকজান্ডার। তবে দেশ জুড়ে বিচিত্র সব দুর্নীতির খবর শুনলে মনে হয়, আলেকজান্ডারের সে সংলাপ বোধ হয় আজও অনায়াসে বলা যায়। তেমনই কয়েকটি দুর্নীতিতে নজর ঘোরানো যাক।
উচ্চপদে নিয়োগ থেকে পদোন্নতি, সবেতেই নাকি ‘শিরোমণি’ নামধারী হিমালয়ের এক সাধুর পরামর্শে করতেন ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জের (এনএসই) প্রাক্তন এমডি-সিইও চিত্রা রামকৃষ্ণ। চলতি বছরের গোড়ায় তা নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি। দুর্নীতির গন্ধে সিবিআইয়ের গোয়েন্দারা পর্যন্ত নড়েচড়ে বসেছিলেন। জেল হেফাজতে পাঠানো হয়েছিল চিত্রাকে।
অভিযোগ, ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এমডি-সিইও পদে থাকাকালীন অর্থাৎ চিত্রার আমলে এনএসইতে নানা আর্থিক অনিয়ম হয়েছে। সে জন্য তাঁকে তিন কোটি টাকা জরিমানাও করেছিল সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি)। পাশাপাশি, এনএসই-র প্রাক্তন কর্ণধার রবি নারাইন এবং এনএসই-র গ্রুপ অপারেটিং অফিসার (জিঅঅ) তথা এমডি-র উপদেষ্টা আনন্দ সুব্রহ্মণ্যনকে দু’কোটি জরিমানা করেছিল তারা।
এই দুর্নীতির মামলায় ১৯০ পাতার রিপোর্টে শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সেবির দাবি ছিল, পদে থাকাকালীন এনএসইতে টাকা কামানোর নিজেদের ছক কাজে লাগিয়েছিলেন চিত্রা এবং আনন্দ। আনন্দের নিয়োগ এবং পদোন্নতি-সহ ব্যক্তিগত এবং কর্মস্থানের নানা সিদ্ধান্তে ‘শিরোমণির’ কথাতেই ওঠাবসা করতেন চিত্রা। ওই সাধুর পরামর্শেই সুব্রহ্মণ্যনকে নিয়োগ করেন তিনি। ২০১৪ সালের এপ্রিলে এনএসইতে তাঁর বেতন হয় ২.০১ কোটি এবং ২০১৫ সালের এপ্রিলে ৩.৩৩ কোটি। পরের বছরের এপ্রিলে গ্রুপ অপারেটিং অফিসার এবং এমডির উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ করা হয় আনন্দকে। সে সময় তাঁর বেতন বেড়ে দাঁড়ায় ৪.২১ কোটি টাকা। যদিও আনন্দের কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এমনকি, এনএসইর আর্থিক ও ব্যবসা সম্পর্কে গোপন তথ্য, ডিভিডেন্ডের পরিস্থিতি, আর্থিক ফল নিয়েও সাধুর সঙ্গে আলোচনা করতেন চিত্রা। পাঁচ দিনের বদলে সপ্তাহে তিন দিন কাজে আসতেন আনন্দ।
পরে জানা যায়, হিমালয়ের ওই সাধুই আসলে আনন্দ। সেবির দাবি, ২০ বছর ধরে এনএসইর নানা সিদ্ধান্তে ওই সাধু অর্থাৎ আনন্দের পরামর্শে কাজ করেছেন চিত্রা। দু’জনের বিরুদ্ধেই তল্লাশি অভিযান চালায় আয়কর দফতর। এর পর চিত্রা এবং আনন্দ দু’জনকেই গ্রেফতার করে সিবিআই। এফআইআরে সিবিআইয়ের অভিযোগ ছিল, দিল্লির ব্রোকিং সংস্থা ওপিজি সিকিউরিটিজ এবং তার প্রোমোটার সঞ্জয় গুপ্ত নিয়ম ভেঙে এনএসইর কো-লোকেশন ব্যবস্থার সুবিধা নিয়েছিলেন। ফলে অন্য ব্রোকারদের থেকে আগে লেনদেনের জন্য লগ-ইন করতে পারতেন এবং তার সাহায্যে মুনাফা লুটতেন।
সিবিআইয়েরই আধিকারিক নিয়োগের ভুয়ো বিজ্ঞাপনের আড়ালে এককালে সাফ হয়ে গিয়েছিল গয়নার দোকান। সেটি ছিল ১৯৮৭ সালের ১৯ মার্চ। সিবিআইয়ে আধিকারিক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেখে ৩০ জনেরও বেশি চাকরিপ্রার্থী মুম্বইয়ের তাজ ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে ইন্টারভিউয়ের জন্য হাজির হয়েছিলেন।
বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছিল, ওই চাকরিপ্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেবেন ‘সিবিআই আধিকারিক মোহন সিংহ’। অভিযোগ, সেই ইন্টারভিউ শেষ হওয়ার পর ২৬ জনকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাঁদের বলা হয়েছিল, দক্ষিণ মুম্বইয়ের একটি গয়নার দোকানে তল্লাশি অভিযান চালিয়ে নিজেদের দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে।
অভিযোগ, তল্লাশি অভিযানের ওই বাছাই করা প্রার্থীদের চোখে ধুলো দিয়ে গয়নার দোকান লুট করেছিলেন ‘মোহন সিংহ’। আজ পর্যন্ত ওই ‘মোহন সিংহের’ আসল পরিচয় জানা যায়নি।
এই জোচ্চুরির গল্প ধরা পড়েছিল বলিউডি পর্দায়। ২০১৩ সালে এই গল্প নিয়ে ‘স্পেশাল ২৬’ তৈরি করেছিলেন পরিচালক নীরজ পাণ্ডে। অক্ষয় কুমারের অনবদ্য উপস্থিতিতে লাভের মুখ দেখেছিল ‘স্পেশাল ২৬’। ‘মোহন সিংহের’ নাম বদলে করা হয়েছিল অজয় সিংহ।
পুলিশি তদন্তে জানা গিয়েছিল, ১৭ মার্চ থেকে তাজ হোটেলের ৪১৫ নম্বর রুম বুক করেছিলেন ‘মোহন সিংহ’। খবরের কাগজে তিনিই ভুয়ো বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। ঘটনার দিন গয়নার দোকান থেকে লুটের সামগ্রী নিয়ে হোটেলে পৌঁছেছিলেন তিনি। সেখান থেকে একটি ট্যাক্সি ভাড়া করেন। এর পর ভিলে পার্লে এলাকায় ওই ট্যাক্সিটি ছেড়ে একটি অটো ধরেন। তার পর থেকে গায়েব ‘মোহন সিংহ’। আজ পর্যন্ত তাঁর টিকিটিও ছুঁতে পারেনি পুলিশ।
দেশ জুড়ে তল্লাশি চালালেও ‘মোহন সিংহকে’ পাকড়াও করতে পারেননি তদন্তকারীরা। তাঁর খোঁজে দুবাইয়েও হানা দিয়েছিলেন তাঁরা। কেরলের একটি হোটেলের রেজিস্টার দেখে জানা গিয়েছিল, ওই প্রতারক তিরুঅনন্তপুরমের বাসিন্দা। তবে তাতেও লাভ হয়নি। ওই গয়নার দোকান থেকে প্রায় ৩.৭ কোটি টাকার সামগ্রী হাপিস করে দিয়েছিলেন ‘মোহন সিংহ’।
‘মোহন সিংহের’ লুটের প্রায় ৩০ বছর পর প্রায় একই ধরনের প্রতারণার কথা জানতে পেরেছিল পুলিশ। যা আইআরএস বা মীরা রোড কল সেন্টার কেলেঙ্কারি নামে খ্যাত। সেটি ছিল ২০১৬ সালের অক্টোবর। অভিযোগ, আমেরিকার ইন্টারনাল রেভিনিউ সার্ভিস (আইআরএস)-এর আধিকারিক সেজে সে দেশের নাগরিকদের থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন প্রতারকেরা। টাকার অঙ্কে তার পরিমাণ ছিল, ২,০৪০ কোটির বেশি।
আমেরিকার বিচার বিভাগীয় দফতরের দাবি, এ দেশের কল সেন্টার থেকে আইআরএস আধিকারিক সেজে অর্থ তোলার কাজ চলত। তারই সাতটি কল সেন্টারের খোঁজ পাওয়া গিয়েছিল মুম্বইয়ের শহরতলি মীরা রোডে। অভিযোগ, আমেরিকার করদাতাদের দিনে হাজারো ফোন করতেন ওই কল সেন্টারগুলির সাতশোরও বেশি কর্মী। তাঁদের ধোঁকা দিয়ে কোটি কোটি ডলার ট্রান্সফার করাতে বাধ্য করতেন ওই প্রতারকেরা।
কী ভাবে চলত প্রতারণা? তদন্তকারীদের দাবি, আইআরএস আধিকারিকদের থেকে একটি ভয়েস মেল পেতেন আমেরিকার বাসিন্দারা। তাতে বলা হত, কর ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে তাঁদের জেল হতে পারে। এবং গ্রেফতারি এড়াতে একটি নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করুন। ওই নম্বরটি ছিল কল সেন্টারের। আমেরিকার বাসিন্দারা তাতে ফোন করলে ম্যাজিক জ্যাক নামে একটি যন্ত্রের মাধ্যমে লোকেশন বদলে দেওয়া হত। তাতে ভারতের বদলে আমেরিকার লোকশন ফুটে উঠত। সে সময় গিফ্ট কার্ড কেনার নামে ডলার ট্রান্সফার করার কথা বলা হত ওই বাসিন্দাদের।
আইআরএসের দাবি, এটি আন্তর্জাতিক স্তরের প্রতারণা। ২০১৬ সালে ওই এজেন্সির তালিকায় এই প্রতারণাটি শীর্ষে উঠে এসেছিল।
সংগঠিত প্রতারণা নয়। একার হাতেই নাকি লোক ঠকাতেন ১৯ বছরের এক যুবক। এমসের চিকিৎসক সেজে প্রায় পাঁচ মাস ধরে প্রতারণা চালিয়ে গিয়েছেন বলে আদনান খুররমের বিরুদ্ধে অভিযোগ। নেটমাধ্যমে, বিভিন্ন প্রতিবাদসভায় নিজেকে এমসের চিকিৎসক বলেই পরিচয় দিতেন তিনি। এক বার তো ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশনে (এনএমসি) বিলের বিরুদ্ধে রেসিডেন্ট ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন (আরডিএ)-এর প্রতিবাদেও অংশ নেন তিনি।
নেটমাধ্যমে আরডিএর ভুয়ো পরিচয়পত্র ব্যবহার করতেন খুররম। তবে নেটমাধ্যমে তাঁর উপস্থিতিই খুররমের কাল হয়েছিল। আরডিএর তৎকালীন সভাপতি হরজিৎ সিংহ ভাট্টি বলেছিলেন, ‘‘এমসের সমস্ত ইভেন্টে যে ভাবে জুনিয়র ডাক্তার সেজে আসতেন খুররম, তা দেখে আমরা হতবাক। প্রতি দিন ডাক্তারদের হস্টেল, কফি শপেও ঘোরাফেরা করতেন তিনি। সে সময়ই সন্দেহ হয়েছিল, ১৮-২০ ঘণ্টার ডিউটির পর এক জন জুনিয়র ডাক্তার কী ভাবে এত ফুরসত পেতেন?’’
খুররম কী ভাবে ধরা পড়লেন? এমসের নিরাপত্তা আধিকারিক বার বার বলা সত্ত্বেও এক বার কিছুতেই অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিংয়ে আসেননি তিনি। সে সময় থেকেই সন্দেহ হয়ে ওই আধিকারিকের। এক রবিবার ম্যারাথনে যোগ দিলে তাঁকে পাকড়াও করেন আধিকারিকেরা। এর পর খুররমকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়।
চিকিৎসকদের একাংশের দাবি, এমসের মতো চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে যে সুরক্ষাজনিত খামতি রয়েছে, তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন খুররম। তাঁদের প্রশ্ন, কী কারণে চিকিৎসক সেজে ঘুরে বেড়াতেন খুররম? অন্যান্য কর্মী বা রোগীর পরিবারের কাছ থেকে তিনি কি আর্থিক ভাবে ফায়দা তোলার চেষ্টা করেছিলেন? যদিও এ সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায়নি। খুররমের বিরুদ্ধেও প্রতারণার অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি।
২০১৮ সালের মে মাসে দিল্লির এক কাপড়ের রফতারিকারক ব্যবসায়ীর অভিযোগ ছিল, বীরেন্দ্রমোহন ব্রার এবং তাঁর ছেলে বাবা ব্রার-সহ অনেকে তাঁকে ঠকিয়েছেন। এই অভিযোগে দিল্লির অপরাধদমন শাখার দ্বারস্থ হয়েছিলেন তিনি। ওই ব্যবসায়ীর দাবি, রাইস পুলার পরীক্ষার নামে তাঁর কাছ থেকে ১.৪৩ কোটি টাকা নিয়েছেন বীরেন্দ্ররা।
প্রসঙ্গত, কাঁসা দিয়ে তৈরি রাইস পুলার অনেকটার থালার মতো দেখতে। এটি চালকে আকর্ষণ করতে পারে বলে দাবি করা হয়। এ কারণে এর মূল্যও যথেষ্ট। বিদ্যুতের মাধ্যমে এটি চার্জ করা যায় বলে দাবি করেছিলেন প্রতারকেরা। পাশাপাশি, নাসা এবং ডিআরডিওর মতো মহাকাশ গবেষণাকারী সংস্থাগুলির গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্যও এর চাহিদা রয়েছে বলেও দাবি করেন তাঁরা।
দিল্লির ওই ব্যবসায়ীর অভিযোগ, কয়েক বছর আগে এক ব্যক্তি তাঁকে বলেছিলেন যে রাইস পুলারের ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা করা যায়। তদন্তে নেমে রাইস পুলার বিক্রি করা এবং তা পরীক্ষার অভিযোগে বীরেন্দ্র এবং বাবা ব্রারকে গ্রেফতার করেছিল দিল্লি পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে নাসার স্টিকার লাগানো একটি রাইস পুলারও বাজেয়াপ্ত করেছিল তারা।
দিল্লি পুলিশের তৎকালীন যুগ্ম কমিশনার অশোক কুমারের দাবি ছিল, ‘‘রাইস পুলার নামে কোনও জিনিসের অস্তিত্বই নেই। ধাতব প্লেট বা বাসনের উপর তরল চুম্বকের পোঁচ দিয়ে একে বিক্রি করার চেষ্টা করেন প্রতারকেরা। ওই বাসনে লোহার তার জড়িয়ে তাতে কয়েকটি চাল দিয়ে লোকজনকে বোকা বানান তাঁরা।’’