বিহার তথা জাতীয় রাজনীতিতে জোর জল্পনা, ফের বিজেপির সহযোগী হচ্ছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা জেডিইউ প্রধান নীতীশ কুমার। গেরুয়া শিবিরের হাত ধরে আবার তিনি এনডিএ-র শরিক হতে পারেন বলে খবর। জেডিইউয়ের একটি সূত্র জানাচ্ছে, শনিবারই রাজ্যপাল রাজেন্দ্র অরলেকরের সঙ্গে দেখা করে ইস্তফা দিতে পারেন নীতীশ। সেই সঙ্গে বিজেপির হাতে হাত মিলিয়ে নতুন সরকার গড়ারও দাবি জানাবেন তিনি।
নীতীশ কুমারের জোটবদলের জল্পনার মধ্যেই শুক্রবার রাতে প্রথম প্রকাশ্যে আসে বিহারে ক্ষমতাসীন জোট ‘মহাগঠবন্ধন’-এর অন্তর্বিরোধ। ‘অস্তিত্বের সঙ্কট’-এর দোহাই দিয়ে জেডিইউ বিধায়ক গোপাল মণ্ডল জানান, নীতীশ যে কোনও পদক্ষেপ করতে পারেন। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই বিহারের জোট সরকারের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।
নীতীশ কুমারের ‘বন্ধুবদল’ অবশ্য এই প্রথম নয়। সেই ২০১৩ সাল থেকে তিনি এত বার বিভিন্ন জোটে যোগ দিয়েছেন যে তাঁর নামের পাশে ‘বদলু রাম’ তকমা লেগে গিয়েছে। বিজেপি তো বটেই, কংগ্রেস এবং লালুপ্রসাদ যাদবের রাষ্ট্রীয় জনতা দলের জোটেও যোগ দিয়েছিলেন বিহারের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপি মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী ঘোষণা করার পরে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রথম বার এনডিএ জোট ছেড়েছিলেন নীতীশ। তার পর একাধিক বার বিজেপির সঙ্গ ছাড়েন তিনি। ২০২২ সালে শেষ বার পদ্মশিবিরের হাত ছাড়েন বিহারের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী।
এখন নতুন করে তাঁর দলবদলের জল্পনা শুরু হয়েছে বিহারের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কর্পূরী ঠাকুরকে ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন প্রদান করার পর। কর্পূরী ছিলেন প্রবাদপ্রতিম সমাজবাদী নেতা, যিনি সত্তরের দশকে দু’বার মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন। বিহার অনগ্রসর সংরক্ষণ নীতি বাস্তবায়নের জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয় তাঁকেই। আজও ‘জন নায়ক’ বা ‘জনগণের নেতা’ হিসাবে স্মরণ করা হয় কর্পূরী ঠাকুরকে।
তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে জেডিইউয়ের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন নীতীশ কুমার। সেখানেই তিনি পরিবারতান্ত্রিক রাজনীতির বিরুদ্ধে মুখ খোলেন। দলীয় সমাবেশে ভাষণ দেওয়ার সময় বিহারের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, তিনি কর্পূরী ঠাকুরের দেখানো পথ অনুসরণ করে চলেছেন। সেই কারণেই বাড়ির কাউকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাননি।
রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য, নীতীশের এই মন্তব্যের লক্ষ্য ছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। সেই মন্তব্যের পাল্টা হিসাবে নাম না করেই নীতীশকে ‘বদতমিজ’ বলে কটাক্ষ করেন লালু-কন্যা রোহিণী। তার পরেই মুখ্যমন্ত্রীকে অপমান করা হয়েছে বলে অভিযোগ করে প্রকাশ্যে রোহিণীর ক্ষমা চাওয়ার দাবি তোলে বিজেপি।
জল্পনায় নতুন মাত্রা যোগ করেন নীতীশ সরকারের প্রাক্তন উপমুখ্যমন্ত্রী এবং বিজেপি নেতা সুশীলকুমার মোদী। তিনি বলেন, ‘‘রাজনীতিতে কোনও দরজা বন্ধ থাকে না। প্রয়োজনে দরজা খোলা যেতে পারে।’’
নীতীশ-ঘনিষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন, গত ১৩ জানুয়ারি ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকটিই ছিল ‘টার্নিং পয়েন্ট’। সেই বৈঠকে সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরি জোটের ‘মুখ’ হিসাবে নীতীশ কুমারের নাম প্রস্তাব করেন। লালুপ্রসাদ যাদব, শরদ পাওয়ার-সহ প্রায় সমস্ত নেতা তাঁকে সমর্থন করেছিলেন।
সূত্রের খবর, একমাত্র রাহুল গান্ধী তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন এবং জানিয়েছিলেন যে এই বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ এই পদে নীতীশের নামে আপত্তি রয়েছে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
একদা ইন্ডিয়া জোট গড়ার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন যিনি, সে দিনের বৈঠকের পর সেই নীতীশ কুমারই বেসুরো গাইতে শুরু করেন। নীতীশ কুমার গত শুক্রবার প্রজাতন্ত্র দিবসে বিহারের রাজ্যপালের বাসভবনে হাজির হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ।
সেখানে উপমুখ্যমন্ত্রী তথা আরজডি নেতা তেজস্বী যাদবের অনুপস্থিতি ‘মহাগঠবন্ধন’-এর অন্তর্বিরোধ আরও প্রকাশ্যে নিয়ে আসে।
শুক্রবার বিহার সরকার ৭৯ জন আইপিএস আধিকারিক এবং বিহার প্রশাসনিক পরিষেবা (বিএএস)-এর ৪৫ জন কর্মকর্তাকে বদলি করেছে। সূত্রের খবর, নীতীশ কুমারের সঙ্গে সম্ভাব্য জোটের ইঙ্গিত দিয়ে আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের কৌশল নিয়ে আলোচনা করার জন্য বিজেপি একটি বৈঠক ডেকেছে। রাজ্য বিজেপির প্রধান সম্রাট চৌধুরী সে কথা অস্বীকার করলেও সূত্রের খবর, গোপনে এই সংক্রান্ত আলোচনা চলছে।
এই রাজনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে কংগ্রেস এবং আরজেডি উভয়েই তাদের বিধায়কদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছে। যদিও কংগ্রেসের দাবি, বিহারের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তাদের কোনও সংযোগ নেই। এই বৈঠক রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো ন্যায় যাত্রা’র প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য বলেই দাবি হাত শিবিরের।
রবিবার সকাল ১০টায় দলের বিধায়কদের নিয়ে বৈঠক ডেকেছেন নীতীশ কুমারও। সূত্রের খবর, সে দিনই আনুষ্ঠানিক ভাবে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে তাদের সমর্থনে নবম বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নেওয়ার সিদ্ধান্ত অনুমোদন করিয়ে নিতে পারেন তিনি।
সব ছবি: পিটিআই।