হলদিয়া থেকে দূরত্ব মেরেকেটে ১,৩০০ কিলোমিটার। এ বার সেখানেই মিলল আন্তর্জাতিক মাদকপাচার চক্রের হদিস। বাজেয়াপ্ত ছ’হাজার কেজির নেশার দ্রব্য। উদ্ধার হওয়া মাদকের বাজারমূল্য ৩৬ হাজার কোটি টাকা! এই খবর প্রকাশ্যে আসতেই কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের।
চলতি বছরের নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে আন্দামান সাগরে বিপুল পরিমাণ মাদক উদ্ধার করে কেন্দ্রশাসিত দ্বীপপুঞ্জের পুলিশ। উপকূলরক্ষী বাহিনীর সাহায্যে চালানো ওই সফল অপারেশনের পর উঠতে শুরু করেছে একাধিক প্রশ্ন। পঞ্জাব, কাশ্মীর ছেড়ে এ বার কি দক্ষিণ ভারতে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে চাইছে ড্রাগ মাফিয়ার দল?
শুধু তা-ই নয়, মাদক পাচারের ‘কিং পিন’দের মাথায় যে পাকিস্তান ও চিনের হাত রয়েছে, ইতিমধ্যেই তার একাধিক প্রমাণ পেয়েছে নয়াদিল্লি। তদন্তকারীদের দাবি, আন্দামান-নিকোবর, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং দক্ষিণ ভারতের তামিলনাড়ুতে ‘ড্রাগ হাব’ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। আর তাই বঙ্গোপসাগরকে নতুন মাদক করিডরে বদলে ফেলার চেষ্টা চলছে।
কোকেন বা হেরোইনের বদলে এই এলাকায় সম্পূর্ণ অন্য ধরনের একটি মাদক পাচারের ষড়যন্ত্র চলছে। সেটির নাম, ‘মেথামফেটামাইন’। নারকোটিক্স সেলের অফিসারদের কথায়, খুব অল্প জায়গায় এটি তৈরি করা সম্ভব। তা ছাড়া এই ড্রাগটিকে পাচার করা তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি সহজ।
আন্দামান-নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের পুলিশ জানিয়েছে, নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে হঠাৎ করেই একটি মাছ ধরার ট্রলারের অদ্ভুত গতিবিধির খবর পায় উপকূলরক্ষী বাহিনী। তৎক্ষণাৎ নজরদারি বিমান ডর্নিয়ার উড়িয়ে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হন তাঁরা। এর পরই স্থানীয় পুলিশকে নিয়ে ওই ট্রলারটিকে ঘিরে ফেলে উপকূলরক্ষী বাহিনী।
আন্দামান-নিকোবরের ডিজিপি হরগোবিন্দ সিংহ ধালিওয়াল জানিয়েছেন, আন্দামান সাগরে ব্যারেন দ্বীপের কাছে মাদকবোঝাই ট্রলারটিকে আটক করা হয়। এতে মায়ানমারের ছ’জন বাসিন্দা ছিলেন। গ্রেফতার করে তাঁদের সবাইকে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। ছ’টন মেথামফেটামাইন পাচারের জন্য তাইল্যান্ড যাচ্ছিলেন তাঁরা।
এই অপারেশনের পর এক্স হ্যান্ডেলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্ট করে উপকূলরক্ষী বাহিনী। সেখানে বলা হয়েছে, ‘‘ভারতীয় জলসীমায় এই পরিমাণ মাদক এর আগে বাজেয়াপ্ত হয়নি।’’ ধৃতদের বিরুদ্ধে এনডিপিএস ও বিদেশি আইনের একাধিক ধারায় মামলা রুজু করেছে আন্দামান-নিকোবর পুলিশ।
আন্তর্জাতিক জলপথ ব্যবহার করে মাদক পাচার চক্র ফাঁসের পর তদন্তে উঠে এসেছে একাধিক চাঞ্চল্যকর তথ্য। ডিজিপি হরগোবিন্দ সিংহের কথায়, ‘‘প্রযুক্তিগত সমস্যার কারণে পাচারকারীরা তাইল্যান্ডের বদলে ভারতীয় জলসীমার দিকে চলে আসে। তাঁদের স্যাটেলাইট ফোনের কল রেকর্ড পাওয়ার চেষ্টা চলছে।’’
মেথামফেটামাইন পাচারের ব্যর্থ চেষ্টার ঘটনায় নাম জড়িয়েছে ধনকুবের আমেরিকার শিল্পপতি ও রাজনীতিবিদ ইলন মাস্কের সংস্থা ‘স্টারলিঙ্ক’-এর। তদন্তকারীদের অনুমান, স্টারলিঙ্কের ইন্টারনেট ব্যবহার করে অভিযুক্তেরা মাথাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন। এর জন্য মোবাইল ফোনের হটস্পট ব্যবহার করেন তাঁরা।
বাজেয়াপ্ত হওয়া এই মাদকের সর্বাধিক চাহিদা রয়েছে নিউ ইয়র্কে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এর দাম ৭০ হাজার কোটি টাকা। পাঁচটি মারুতি গাড়ির ওজনের সমান মেথামফেটামাইন উদ্ধার করেছে ভারতের উপকূলরক্ষী বাহিনী। ২০২৩ সালে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় একলপ্তে বাজেয়াপ্ত হয়েছে এর মাত্র দু’শতাংশ মাদক।
মজার বিষয় হল, মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘ইসরো’র জন্য বরাদ্দ হওয়া বাজেটের দ্বিগুণ অর্থের মেথামফেটামাইন মিলেছে আন্দামান সাগরে। সাধারণত, মায়ানমার থেকে আসা মাদক সে দেশের কাছে থাকা হ্যাভলক দ্বীপের মাধ্যমে পাচার হয়ে থাকে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বেশ কিছুটা দূরে ব্যারেন দ্বীপপুঞ্জের ব্যবহার হওয়ায় কেন্দ্রের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
আন্দামান পুলিশের এক পদস্থ কর্তা জানিয়েছেন, মেথামফেটামাইন পাচারের ধরন দেখে মনে হচ্ছে এর নেপথ্যে ড্রাগ দুনিয়ার রাজা এল মেনঞ্চোর ‘জেলিস্কো নিউ জেনারেশন’ এবং চিনের ‘এল চাপো’ গ্যাংয়ের হাত রয়েছে। ২০১৯ সাল থেকে আন্দামান-নিকোবরকে ড্রাগ হাব তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছে তারা।
তদন্তে আরও জানা গিয়েছে বড়দিন ও নতুন বছরের উৎসবে তাইল্যান্ডে এই মাদকের চাহিদা বহু গুণ বেড়ে যায়। আর তাই চায়ের প্যাকেটে ভরে মেথামফেটামাইন পাচার করা হচ্ছিল। কাজ হাসিল করতে মাফিয়াদের পছন্দ রোহিঙ্গাদের নৌকা ও মায়ানমারের চোরাশিকারিদের জলযান। ফলে হাই অ্যালার্টে রয়েছে উপকূলরক্ষী বাহিনী।
মাদক গবেষকদের দাবি, গত শতকে আফিম যে জায়গা নিয়েছিল, বর্তমানে সেটাই দখল করেছে মেথামফেটামাইন বা মিথ। আফিমের কাঁচামাল হল পোস্ত। প্রাকৃতিক ভাবে চাষ করলে এর থেকে মেলে দু’টি উপাদান। সেগুলি হল, মরফিন ও কোডেইন। এই মরফিনেই রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে হেরোইন তৈরি করেন মাদক পাচারকারীরা।
হেরোইন তৈরির ক্ষেত্রে বিশাল জমিতে পোস্ত চাষ আবশ্যক। মিথের ক্ষেত্রে কিন্তু এই ঝামেলা নেই। মাত্র ১০০ বর্গফুটের একটি ঘরে বসে টন টন মাদক তৈরি করা সম্ভব। দ্বিতীয়ত, মিথ পুরোপুরি একটি সিন্থেটিক ড্রাগ। ফলে এর নেশা এক বার হয়ে গেলে তা ছাড়ানো প্রায় অসম্ভব। হেরোইন হল সেমি সিন্থেটিক ড্রাগ।
একটা সময়ে উত্তর ভারতে বিশেষত পঞ্জাব, কাশ্মীর, রাজস্থান, গুজরাত ও মহারাষ্ট্রে ‘মাদক সন্ত্রাসবাদ’ শুরু করে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। কিন্তু প্রশাসন শক্ত হাতে ব্যবস্থা নেওয়ায় বর্তমানে সেখানে ড্রাগ পাচারের সূচক অনেকটাই নিম্নগামী। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, এই পরিস্থিতিতে দক্ষিণ ভারতকে নিশানা করছেন পাক গুপ্তচরেরা।
গোয়েন্দা সূত্রে খবর, মাদক পাচারের জন্য শ্রীলঙ্কার মৎস্যজীবীদের নিশানা করছে আইএসআই। টাকার লোভ দেখিয়ে সিন্থেটিক ও সেমি সিন্থেটিক মাদক তাঁদের মাধ্যমে তামিলনাড়ুতে পাঠাচ্ছেন তাঁরা। সেখান থেকে পার্শ্ববর্তী কেরল ও কর্নাটক হয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ঙ্কর সেই নেশার দ্রব্য।
আন্দামানকে ‘ড্রাগ হাব’ বানানোর ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে আবার হাত রয়েছে চিনের। এই দ্বীপপুঞ্জে নতুন বন্দর তৈরি করছে নয়াদিল্লি। সেটি ব্যবহার করে মলাক্কা প্রণালী-সহ ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ড্রাগনের দাদাগিরি বন্ধের সুযোগ পাবে ভারত। আর তাই এই কাজ বানচাল করতে উঠেপড়ে লেগেছে বেজিং।
উত্তর-পূর্বের মণিপুরে কুকি ও মেইতেই জনজাতির রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের নেপথ্যেও উস্কানি রয়েছে ড্রাগনের। মায়ানমার থেকে মাদক পাচারের সেরা করিডর হিসাবে এই পাহাড়ি রাজ্যটিকে দীর্ঘ দিন ধরেই ব্যবহার করছেন মাদক দুনিয়ার রথী-মহারথীরা। এখানে অশান্তি তৈরি করে নয়াদিল্লির উপর চাপ তৈরির কৌশল নিয়েছে বেজিং।
মাদক পাচারের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে রয়েছে হাতিয়ারের চোরাচালান। মাদকের আনাগোনা বাড়লে সেই এলাকা যে সন্ত্রাসবাদীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে, তা বলাই বাহুল্য। আন্দামান থেকে বাংলার উপকূল খুব দূরে নয়। ধরপাকড় এড়াতে মাদক পাচারকারীদের নজর সেখানেও পড়তে পারে বলে সতর্ক করেছেন গোয়েন্দারা।
সব ছবি: সংগৃহীত।