
এক মাসের মধ্যে দুটো তরতাজা প্রাণের রহস্যমৃত্যু। ঘটনার সূত্র ধরে এগিয়ে নাম পাওয়া যায় এক ব্যক্তির। ২০১২ সালের এই ভয়ঙ্কর ঘটনা নাড়িয়ে দিয়েছিল মুম্বইয়ের পুলিশ-প্রশাসন তথা হিন্দি সিনেমার জগৎকেও।

২৮ বছর বয়সি কর্ণ কক্কর দিল্লি থেকে মুম্বই এসেছিলেন চোখে হাজারো স্বপ্ন নিয়ে। তাঁর ইচ্ছা ছিল এক জন সফল প্রযোজক হওয়ার। কিন্তু ‘স্বপ্নের শহর’ মুম্বইয়ে এসেই তাঁর স্বপ্নের অবসান ঘটল। কর্ণের প্রাণ গেল নতুন শহরে এসে বানানো নতুন ‘বন্ধু’র হাতে।

২০১২ সালের ৫ মার্চ, অন্ধেরির লোখন্ডওয়ালার ওবেরয় স্প্রিংস আবাসন থেকে হঠাৎই উধাও হয়ে যান কর্ণ। কোথাও তাঁর হদিস পাওয়া যায় না। বাড়ির লোকেরা শত চেষ্টা করেও তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেননি।

কোনও খোঁজ না পেয়ে দিল্লি থেকে কর্ণের দাদা হানিশ এবং মা রীতা মুম্বই চলে যান। অম্বোলি থানায় তাঁরা কর্ণের নিখোঁজ ডায়েরি লেখালেন। কিন্তু অম্বোলি থানার পুলিশ ব্যাপারটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিল না। কর্ণের বাড়ির লোকের অভিযোগ, সেই মুহূর্তে পুলিশ তাঁদের কথায় কান দেয়নি। পুলিশ ঘটনাটির তদন্ত করেও দেখেনি বলে অভিযোগ কর্ণের দাদার।

এই ভাবে প্রায় এক মাস কেটে যায়। কর্ণের কোনও খোঁজ পাওয়া যায় না। পুলিশও কিছু জানাতে পারে না। কিন্তু আরও একটি খুন কর্ণের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় নতুন মোড় এনে দেয়। এই বার নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হয় পুলিশ।

কর্ণের মৃত্যু নিয়ে পুলিশের তদন্ত গতি পাওয়ার আগেই ২০১২ সালের ৭ এপ্রিল, মুম্বইয়ের ধনী ব্যাবসায়ী, ৬২ বছর বয়সি অরুণকুমার টিক্কুকে হত্যা করা হয়। ওশিওয়ারায় অরুণকুমারের সমর্থ অঙ্গন নামের আবাসনে তাঁকে হত্যা করা হয়।

অরুণকুমারের প্রতিবেশী তাঁর বাড়ির জানলা দিয়ে দেখতে পান যে, দু’জন তরুণ অরুণকুমারের বুকে ও পেটে এলোপাথাড়ি ছুরির কোপ বসাচ্ছেন। স্বাভাবিক ভাবেই হাড়হিম করা সেই দৃশ্য দেখে তিনি ভয় পেয়ে যান। তিনি তৎক্ষণাৎ পুলিশকে ফোন করে খবর দেন।

শুরু হয় তল্লাশি। পুলিশ জানতে পারে, এই খুনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে অন্ধকার জগতের বিখ্যাত নাম বিজয় পালান্ডের। শুধু তাই-ই নয়, পুলিশ আরও জানতে পারে যে, খুনটি হওয়ার সময় সেই বাড়িতে অরুণকুমারের ছেলে অনুজকুমারও উপস্থিত ছিলেন।

অনুজকুমারের স্বপ্ন ছিল সফল অভিনেতা হওয়ার। তিনি হিন্দি সিনেমাজগতের একজন উঠতি অভিনেতা ছিলেন। সেইখানেই অনুজের আলাপ হয় বিজয় পালান্ডের সঙ্গে। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বও হয়। অনুজ বিজয়কে তাঁর বাবার একটি ফ্ল্যাটে ভাড়াটে হিসাবে থাকতে দেন। কিন্তু অরুণকুমারের এই বিষয়ে সম্মতি ছিল না। এই নিয়ে ছেলে অনুজের সঙ্গে বাবা অরুণকুমারের ঝামেলাও হয়।

পুলিশ অরুণকুমারের ফ্ল্যাটের এক জন ভাড়াটে হিসাবে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য বিজয়কে ডাকেন। কিন্তু বিজয় পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে যান। কিন্তু তাঁর এই স্বাধীনতা স্থায়ী হয়নি। সেই দিনই গভীর রাতে তিনি আবার ধরা পড়েন। তাঁকে আবার পুলিশি হেফাজতে ফিরিয়ে আনা হয়।

তল্লাশি এগোলে পুলিশ জানতে পারে, যে তরুণদের অরুণের বুকে ছুরি মারতে দেখা গিয়েছিল তাঁদের নাম হল ধনঞ্জয় শিন্দে এবং মনোজ গজকোষ। ১১ এপ্রিল এই দু’জনকে মুম্বইয়ের বান্দ্রা এবং চিপলুন থেকে গ্রেফতার করা হয়। পুলিশি হেফাজতে আসার পর শিন্দে এবং গজকোষ স্বীকার করে নেন যে তাঁরা অরুণকুমারকে হত্যা করেছেন। তাঁরা আরও জানান, কর্ণ কক্করের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনাতেও তাঁদেরই হাত রয়েছে। এই সবের মাথা আর কেউ নন, স্বয়ং তাঁদের ‘গুরু’ বিজয় পালান্ডে। জিজ্ঞাসাবাদের মধ্যেই উঠে আসে আরও একটি নাম, বিজয়ের স্ত্রী সিমরন সুদ। তাঁকেও গ্রেফতার করে পুলিশ।

সিমরন পেশায় মডেল ছিলেন। বিজয় তাঁকে ‘হানি ট্র্যাপ’ হিসাবে ব্যবহার করে মুম্বইয়ের ধনী ব্যক্তিদের নিজের জালে ফাঁসাতেন। এর পর তাঁদের খুন করে সম্পত্তি হাতাতেন। কর্ণ কক্কর এবং অরুণকুমারের ছেলে অনুজ কুমার, দু’জনের সঙ্গেই সিমরনের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিল।

কর্ণের দাদা পুলিশকে জানান, তিনি তাঁর ভাইয়ের মুখে বহু বার সিমরনের কথা শুনেছিলেন। মুম্বই পুলিশের চার্জশিট অনুসারে, সিমরনই কর্ণের সঙ্গে বিজয়ের পরিচয় করিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব হয়। মুম্বই আসার কিছু দিনের মধ্যেই কর্ণ একটি বিলাসবহুল গাড়ি কেনেন। যেটি দেখে বিজয় ভেবেছিলেন কর্ণের প্রচুর টাকা। সেই কারণেই তাঁরা কর্ণকে খুন করেছিলেন। কর্ণকে খুন করে তাঁর সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়াই ছিল তাঁদের প্রধান উদ্দেশ্য।

অপরাধ দমন শাখা কর্ণের বিলাসবহুল আবাসন ওবেরয় স্প্রিংসের বাথরুমের ড্রেনের পাইপে জমাট বাঁধা রক্তের দলা খুঁজে পায়। পুলিশ সূত্রে জানতে পারা যায়, বিজয় এবং তাঁর দলবল ৫ মার্চ রাতে কর্ণের সেই আবাসনেই তাঁকে খুন করেন। তাঁরা প্রথমে তাঁকে খাবারের সঙ্গে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ান, তার পর তাঁকে খুন করেন।

কর্ণকে খুন করার পর তাঁর দেহ টুকরো টুকরো করে কেটে ফেলা হয়। তার পর কর্ণের সেই বিলাসবহুল গাড়ি নিয়ে বিজয়েরা চিপলুন যান। সেখানে যাওয়ার পথে কুম্ভারলী ঘাটে কর্ণের কিছু দেহাংশ ফেলে দেওয়া হয়, যেগুলি পরবর্তী কালে পুলিশ উদ্ধার করে। দেহাবশেষের সঙ্গে একটি খুলিও উদ্ধার হয়।

অন্য দিকে, মুম্বইয়ের নামজাদা ব্যবসায়ী অরুণকুমারের হত্যার নেপথ্যেও ছিল তাঁর সম্পত্তি হাতানোর মতলব। অপরাধ দমন শাখা সূত্রে খবর, অরুণকুমারের ছেলে অনুজ তাঁদের জানিয়েছিলেন যে, তাঁর বাবা ৫০ কোটি টাকার মালিক। অরুণকুমার মারা যাওয়ার পর এই বিপুল সম্পত্তির মালিকানা চলে আসবে অনুজের হাতে। সম্পত্তি হাতানোর লোভেই বিজয় অরুণকুমারকে হত্যা করেন। এই ঘটনাকে আত্মহত্যা হিসাবে সাজানোর জন্য তাঁর লকারে একটি সুইসাইড নোটও লিখে রেখে দেন।

অরুণকে মারার পর বিজয় অনুজকে কিছু দিন নিজের কাছে রেখে দিতে চেয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল অনুজকে নেশার ঘোরে রেখে তাঁর থেকে সব সম্পত্তি হাতিয়ে নেওয়ার। কিন্তু বিজয়ের দুই সঙ্গী ধনঞ্জয় এবং মনোজ ধরা পড়ে যাওয়ার ফলে তাঁর এই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

২০০২ সালেও বিজয়কে জোড়া খুনের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। তাঁকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। কিন্তু এক মাস পর তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়ে উধাও হয়ে যান। সেই ঘটনার ১০ বছর পর আবার জোড়া খুন করার অভিযোগে তাঁকে জেলে যেতে হয়।

পরবর্তী কালে বিজয় জামিনের জন্য আবেদন করলেও আদালত সেই আবেদন খারিজ করে দেয়। এই খুনের ঘটনায় তাঁর সঙ্গে জড়িত আর সকলে বর্তমানে ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। কিন্তু বিজয় এখনও পুলিশের হেফাজতেই রয়েছেন।
সব ছবি: সংগৃহীত।