
ভয়াবহ ভূমিকম্পে টলমল মায়ানমার ও তাইল্যান্ড। রাতারাতি মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়েছে ইরাবতীর কোলের সাবেক বর্মা। সেখানে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে নিহতের সংখ্যা। ইতিমধ্যেই তা দেড় হাজারের গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে খবরের শিরোনামে এসেছেন ভারতের এক তরুণ জ্যোতিষী। কারণ, তাঁর করা ভবিষ্যদ্বাণী নাকি অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে।

বছর কুড়ির ‘ত্রিকালজ্ঞ’ ওই তরুণের নাম অভিজ্ঞ আনন্দ। মায়ানমার এবং তাইল্যান্ডে বিপর্যয় নেমে আসার অন্তত ২১ দিন আগে দুনিয়াকে সতর্ক করেন তিনি। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করা একটি ভিডিয়োয় ভূমিকম্পের পূর্বাভাস দেন অভিজ্ঞ। তাঁর কথা অবশ্য তখন কেউ সে ভাবে পাত্তা দেয়নি।

চলতি বছরের ১ মার্চ অভিজ্ঞর ইউটিউব চ্যানেলে ভিডিয়োটি আপলোড করা হয়। সেখানে তিনি বলেন, আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে বা এ বছরের মাঝামাঝি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তিন সপ্তাহ পর ২৮ এবং ২৯ তারিখ কেঁপে ওঠে মায়ানমার এবং তাইল্যান্ডের মাটি।

কর্নাটকের মায়সুরুর বাসিন্দা অভিজ্ঞের সর্বকনিষ্ঠ জ্যোতিষী হিসাবে বেশ নামডাক রয়েছে। মাত্র সাত বছর বয়সে সম্পূর্ণ ভাগবত গীতা কণ্ঠস্থ করে ফেলেন তিনি। খুব অল্প বয়স থেকে সংস্কৃত ভাষার চর্চা শুরু হয় তাঁর। এতে মা তাঁকে উৎসাহিত করতেন বলে জানিয়েছেন আনন্দ।

সংবাদমাধ্যমকে অভিজ্ঞ জানিয়েছেন, ১১ বছর বয়স থেকে জ্যোতিষশাস্ত্র নিয়ে চর্চা করছেন তিনি। ১২ বছর বয়সে বাস্তুশাস্ত্রে স্নাতকের ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০১৮ সালে ‘প্রজ্ঞা জ্যোতিষ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন তিনি। বর্তমানে সেখানে ১২০০ শিশু-কিশোরকে জ্যোতিষের পাঠ দিচ্ছেন অভিজ্ঞ।

নিজের ইউটিউব চ্যানেলে এর আগেও একাধিক ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন মায়সুরুর এই তরুণ জ্যোতিষী। তাঁর দাবি, ২০২০ সালের কোভিড অতিমারি, ২০২২ সালের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়া এবং ২০২৩ সালে ইজ়রায়েলে প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের আক্রমণের সঠিক পূর্বাভাসও নাকি দিয়েছিলেন তিনি।

গত বছরের অগস্টে গণঅভ্যুত্থানে বাংলাদেশে ক্ষমতা হারান আওয়ামী লিগ নেত্রী শেখ হাসিনা। ঢাকা থেকে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন তিনি। অভিজ্ঞের দাবি, পূর্বের প্রতিবেশী দেশে যে এমন কাণ্ড ঘটতে চলেছে, জ্যোতিষ গণনায় তা আগেই বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। সেইমতো ভবিষ্যদ্বাণীও করেন মায়সুরুর তরুণ ‘ত্রিকালজ্ঞ’।

২১ শতকে ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাওয়ার নিরিখে অবশ্যই তালিকার শীর্ষে থাকবে পল নামের একটি অক্টোপাস। ২০১০ সালের পুরুষদের ফিফা বিশ্বকাপ ফুটবল প্রতিযোগিতায় প্রাণীটির করা ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ ভাবে সত্যি হওয়ায় দুনিয়া জুড়ে হইচই পড়ে যায়। তবে রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না পলের।

২০০৮ সালে জার্মানির ওবেরহাউসেন সি লাইফ সেন্টারের একটি ট্যাঙ্কে জন্ম হয় অক্টোপাস পলের। পরবর্তী কালে তাকে ফুটবল ম্যাচের ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য ব্যবহার করা শুরু করেন ওই প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা। তার পদ্ধতিটি ছিল ভারী চমৎকার।

পলকে দিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করানোর জন্য ওবেরহাউসেন সি লাইফ সেন্টারের কিপাররা একটি জারের মধ্যে দু’টি আলাদা আলাদা পাত্রে খাবার রাখতেন। পাত্রগুলির গায়ে যে দুই দেশের মধ্যে ফুটবল প্রতিযোগিতা হবে, তাদের পতাকা আঁকা থাকত। পল যে পাত্রটি বেছে নিত, সেই দল বিজয়ী হবে বলে জানিয়ে দিতেন সংশ্লিষ্ট কিপারেরা।

পলের ভবিষ্যদ্বাণী করার পদ্ধতিতে যে কোনও জালিয়াতি নেই, তা প্রমাণ করতে ঘটনার সময়কার ভিডিয়ো প্রকাশ করা হয়। জন্মের বছর, অর্থাৎ ২০০৮ সালের ইউরো কাপে প্রথম বার নিজের ‘জ্যোতিষ-শক্তি’র প্রমাণ দেয় ওই অক্টোপাস। সে বছরের ইউরো কাপে জার্মানির ছ’টি ম্যাচের মধ্যে চারটিতে বিজয়ী দলের পতাকা চিহ্নিত বাক্স বেছে নিয়েছিল পল।

২০১০ সালের পুরুষদের ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপে ১০০ শতাংশ সাফল্য পায় পল। ওই টুর্নামেন্ট চলাকালীন মোট সাতটি ভবিষ্যদ্বাণী করে ওই অক্টোপাস। আশ্চর্যজনক ভাবে সব ক’টি মিলে গিয়েছিল। তার মধ্যে ছিল ১১ জুলাইয়ে স্পেন এবং নেদারল্যান্ডসের মধ্যে হওয়া ফাইনাল ম্যাচ।

খেলা শুরুর আগে অক্টোপাস পল স্পেনকে বেছে নেয়। বাস্তবে ঠিক তা-ই হয়েছিল। বিশ্বকাপ ফাইনালে ১-০ গোলে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ট্রফি ছোঁয়ার স্বাদ পায় ‘আর্মাডার দেশ’। ভবিষ্যদ্বাণীর নিরিখে অক্টোপাসটির সামগ্রিক সাফল্য ৮৬ শতাংশ বলে জানা গিয়েছে।

২০১০ সালের ২৬ অক্টোবর মারা যায় অক্টোপাস পল। মাত্র দু’বছরের জীবদ্দশায় করা তার ভবিষ্যদ্বাণীগুলি নিয়ে বিতর্ক কম হয়নি। ওঠে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগও। যদিও সবটাই উড়িয়ে দেয় ফিফা এবং জার্মানির সি লাইফ সেন্টারের কর্মকর্তারা।

ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যাওয়ার নিরিখে অভিজ্ঞ আনন্দর তুলনা অক্টোপাস পলের সঙ্গে করা ঠিক হবে কি না, তা নিয়ে অবশ্য প্রশ্ন রয়েছে। কারণ কর্নাটকের ‘ত্রিকালজ্ঞ’ মূলত রাজনৈতিক এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংক্রান্ত পূর্বাভাস দিয়ে থাকেন। আগামী বছরগুলিতে আরও বড় ঘটনা ঘটতে পারে বলে ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি।

উল্লেখ্য, ভূমিকম্পে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া মায়ানমারে ইতিমধ্যেই ‘অপারেশন ব্রহ্মা’ শুরু করেছে ভারত। পাঠানো হয়েছে বিপুল ত্রাণসামগ্রী। ধ্বংসস্তূপের ভিতরে আটকে পড়াদের উদ্ধারের চেষ্টা করা হচ্ছে। সেখানে অস্থায়ী হাসপাতালও তৈরি করেছে ভারতীয় সেনা।

জ্যোতিষচর্চার বিজ্ঞানভিত্তি রয়েছে কি না, তা নিয়ে যুক্তি এবং পাল্টা যুক্তির শেষ নেই। তবে সাহিত্যে এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। ইতিহাসবিদদের একাংশ মনে করেন বৈদিক এবং গুপ্ত যুগে এ দেশে জ্যোতিষচর্চা উন্নতির শিখরে ওঠে। অভিজ্ঞের সাফল্য এর জনপ্রিয়তাকে কয়েক গুণ বাড়িয়ে দেবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।