
সূর্যের থেকে ২১৫০ গুণ বড়। দূরত্ব পৃথিবী থেকে আনুমানিক ২০,০০০ আলোকবর্ষ। আকাশগঙ্গা ছায়াপথে অবস্থিত নক্ষত্রগুলির মধ্যে লাল বর্ণের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রটি অন্যতম। ব্রহ্মাণ্ডের এখনও পর্যন্ত আবিষ্কৃত সবচেয়ে বড় নক্ষত্রটি এ বার মৃত্যুর মুখে।

লাল রঙের দৈত্যাকার নক্ষত্রটির নাম হল স্টিফেনসন ২-১৮। এটি স্টিফেনসন ২ ডিএফকে১, আরএসজিসি ২ এবং এসটি ২-১৮ নামেও পরিচিত। আকাশগঙ্গা ছায়াপথের স্কুটাম নক্ষত্রমণ্ডলের স্টিফেনসন ২ নামের নক্ষত্রপুঞ্জে এর অবস্থান।

স্টিফেনসন ২-১৮-এর ব্যাসার্ধ আনুমানিক ২,১৫০ সৌর ব্যাসার্ধ। এই অনুমান থেকে বলা যেতে পারে এই নক্ষত্রটির আয়তন সূর্যের থেকে বহু গুণ বড়। এর গড় তাপমাত্রা ৩,২০০ কেলভিন।

স্টিফেনসন ২-১৮ শুধু আকারেই বড় নয়, এর উজ্জ্বলতাও নজরকাড়া। আকাশগঙ্গা ছায়াপথে অবস্থিত উজ্জ্বলতম নক্ষত্রগুলির মধ্যে স্টিফেনসন ২-১৮ অন্যতম। সূর্যের থেকে ৪৪ হাজার গুণ বেশি আলো ছড়ায় এই নক্ষত্রটি।

১৯৯০ সালে আমেরিকান জ্যোর্তিবিদ চার্লস ব্রুস স্টিফেনসন নক্ষত্রপুঞ্জটি আবিষ্কার করেছিলেন। তিনিই লাল রঙের এই দৈত্যাকার নক্ষত্রটি চাক্ষুষ করেন। মহাকাশে বিশেষ অংশে পর্যবেক্ষণ চালাতে গিয়ে তাঁর নজরে আসে এই বিশাল লাল বর্ণের নক্ষত্র। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির অভাবে সেই তারার ঠিকুজি বার করতে অসমর্থ হন তিনি।

সেই মুহূর্তে নক্ষত্রটিকে স্টিফেনসন নক্ষত্রপুঞ্জের অংশ হিসাবে গণ্য করা হয়নি। কিন্তু তারাটির উজ্জ্বল লাল রং এবং গতিপ্রকৃতি দেখে বোঝা গিয়েছিল যে, নক্ষত্রটি লাল দৈত্যাকার শ্রেণির অর্ন্তগত।

পরবর্তী কালে গবেষকেরা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে এর বৈশিষ্ট্যগুলি শনাক্ত করেন। অস্ট্রেলিয়া টেলিস্কোপ কম্প্যাক্ট অ্যারের দ্বারা পরীক্ষা করে বোঝা যায় যে, এটি স্টিফেনসন নক্ষত্রপুঞ্জের অর্ন্তগত একটি দৈত্যাকার লাল তারা। আমেরিকান জ্যোর্তিবিদ চার্লস ব্রুস স্টিফেনসনের নাম অনুসারে এর নামকরণ করা হয়েছে স্টিফেনসন ২-১৮।

উজ্জ্বল আলোকরশ্মির বলয় তারাটির সৌন্দর্য দ্বিগুণ বৃদ্ধি করলেও আদতে ধীরে ধীরে দিন ঘনিয়ে আসছে এই নক্ষত্রটির। নক্ষত্রজীবনের উপান্তে এসে দাঁড়িয়েছে স্টিফেনসন ২-১৮। কোনও নক্ষত্র প্রসারিত হতে হতে নিজের ভর বিকিরণ করতে থাকলে সেই পরিস্থিতিতে সুপারনোভা তৈরি হয়। এসটি ২-১৮-এর ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে সে রকমই এক মহাজাগতিক নিয়ম।

কোটি কোটি বছর ধরে জ্বলতে জ্বলতে একটি নক্ষত্র তার জীবনের শেষ পর্যায়ে প্রবেশ করে দপ করে জ্বলে ওঠে। প্রতিনিয়ত নিজের ভর বিকিরণ করে চলেছে তারাটি। সেই ক্ষেত্রে বলা যায় এসটি ২-১৮ তার জীবনকালের শেষ সময়ে এসে পড়েছে।

স্টিফেনসন ২-১৮ এর ভর অজানা। বর্তমানে স্টিফেনসন ২-১৮ তার কেন্দ্রে হিলিয়ামকে আরও ভারী মৌলে ভেঙে ফেলছে। এর ফলে ভর সঙ্কুচিত হচ্ছে এই লাল রঙের দৈত্যাকার নক্ষত্রটির।

এসটি ২-১৮ এর কেন্দ্রস্থলে থাকা উপাদানগুলি পুড়ে যাওয়ার ফলে এটি অবশেষে মারা যাবে। মহাকাশে ঘটবে একটি বিশাল বিস্ফোরণ এবং তৈরি হবে একটি বিশাল কৃষ্ণগহ্বর বা ব্ল্যাক হোল ও নিউট্রন নক্ষত্র।

কোনও কোনও গবেষকের মতে, এই দৈত্যাকার লাল তারাটি একটি উল্ফ-রায়েট তারা বা উজ্জ্বল নীল বর্ণের তারায় পরিণত হবে। কোনও কোনও নক্ষত্র তার শেষ জীবনে পৌঁছে উল্ফ-রায়ট নক্ষত্রে পরিণত হয়। সেই সময় নক্ষত্রটির গা থেকে নীল বর্ণের আলো বিচ্ছুরিত হয়।

একটি নক্ষত্র তার গোটা জীবনের গতিপথে হাইড্রোজেন পরমাণুকে হিলিয়ামে রূপান্তরিত করতে থাকে। এই প্রক্রিয়া চলতে থাকলে দৈত্যাকার লাল তারার অভ্যন্তরে হিলিয়াম ও তার বাইরে হাইড্রোজেনের স্তর তৈরি হয়। হাইড্রোজেন জ্বালানি শেষ হয়ে গেলে, অভিকর্ষের ক্রমাগত টানে নক্ষত্রটি ভেঙে পড়তে শুরু করে। অভ্যন্তর সঙ্কুচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার চারপাশের প্লাজ়মার ঢাল হাইড্রোজেন পোড়ানোর কাজ শুরু করে।

তারাগুলির ভিতরে ক্রমাগত পারমাণবিক ফিউশন চলার ফলে সেটি তার বাইরের হাইড্রোজেনের স্তর হারায়। নক্ষত্রের মূল অংশ সঙ্কুচিত হয় ও নক্ষত্রের বাকি অংশ প্রসারিত হতে শুরু করে। বাইরের হাইড্রোজেনের স্তরটি হারিয়ে ফেলে এই তারাগুলি প্রকৃতির মাঝে হিলিয়াম, কার্বন, নাইট্রোজেন এবং অক্সিজেনের মতো ভারী উপাদানগুলিকে উন্মুক্ত করে।

জ্বালানি ফুরোলেই নক্ষত্র অন্তিম দশার দিকে যাত্রা শুরু করে। মহাকাশে ঘটে একটি বিশাল বিস্ফোরণ, যাকে বলে সুপারনোভা। কোনও নক্ষত্র প্রসারিত হতে হতে নিজের ভর বিকিরণ করতে থাকলে সেই পরিস্থিতিকে সুপারনোভা বলা হয়। এই সুপারনোভার ফলে নির্গত হয় এক্স রশ্মি।

সুপারনোভার সময় তীব্র আলোর ছটা দেখা যায় মহাকাশে। কিন্তু সেই ছটার ঔজ্জ্বল্য বেশি দিন থাকে না। অনেক সময় সেই আলোর ছটা খালি চোখে পৃথিবী থেকেও দেখা যায়।

সুপারনোভার পর তারার দেহাবশেষ থেকে জোরালো অভিকর্ষ বলের টানে দু’ধরনের মহাজাগতিক বস্তুর জন্ম হতে পারে। এই বিস্ফোরণের ফলে এসটি ২-১৮ থেকে অসংখ্য ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর এবং নিউট্রন নক্ষত্র জন্ম নিতে পারে।

সাধারণত পৃথিবী থেকে ১৬০ আলোকবর্ষের মধ্যে অবস্থিত কোনও নক্ষত্র যদি মহাকাশে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, তবে তার প্রভাব পৃথিবীর উপরেও পড়ে। পৃথিবীর আবহাওয়া এর ফলে বদলে যেতে পারে। কিন্তু এসটি ২-১৮ মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়লে তার প্রভাব পৃথিবীর উপর পড়বে না, কারণ সেটি ২০,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। মহাকাশে ঘটতে চলা এই বিশাল বিস্ফোরণ পৃথিবী থেকে খালি চোখে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই।
সব ছবি: সংগৃহীত।