বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ৫০তম প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ নিলেন ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড়। প্রধান বিচারপতি হিসাবে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নাম প্রস্তাব করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আগের প্রধান বিচারপতি উদয় উমেশ ললিত। ‘আনুষ্ঠানিক’ ভাবে উত্তরসূরির নাম প্রস্তাব করে কেন্দ্রের হাতে চিঠি তুলে দিয়েছিলেন ললিত। বুধবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হিসাবে শপথ গ্রহণ করলেন চন্দ্রচূড়। এক নজরে চিনে নিন দেশের পরবর্তী প্রধান বিচারপতিকে।
বিচারপতি চন্দ্রচূড় ১৯৫৯ সালের ১১ নভেম্বর মুম্বইয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা যশবন্ত বিষ্ণু চন্দ্রচূড়ও ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি দেশের প্রধান বিচারপতি ছিলেন। এখনও পর্যন্ত তিনিই ছিলেন ভারতের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধান বিচারপতি।
বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের মা প্রভাদেবীর অবশ্য আইন নিয়ে বিশেষ আগ্রহ ছিল না। বেশির ভাগ সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত নিয়েই মেতে থাকতেন তিনি।
বিচারপতি চন্দ্রচূড় ছোট থেকেই বাবার মতো আইন নিয়ে উৎসাহী ছিলেন।
মুম্বইয়ের ক্যাথিড্রাল অ্যান্ড জন কোনন স্কুল থেকে পড়াশোনা শেষ করার পর বিচারপতি চন্দ্রচূড় দিল্লির সেন্ট কলম্বাস স্কুলে ভর্তি হন।
১৯৭৯ সালে দিল্লির সেন্ট স্টিফেন্স কলেজ থেকে অঙ্ক এবং অর্থনীতিতে স্নাতক হন। কিন্তু অঙ্ক বা অর্থনীতি নিয়ে কাজ করার কোনও ইচ্ছা তাঁর ছিল না। বাবার মতোই দেশের বিচারব্যবস্থা নিয়েই তিনি বেশি আগ্রহী ছিলেন।
১৯৮২ সালে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতক হন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। পরে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। হার্ভার্ড থেকেই আইন নিয়ে গবেষণাও করেন।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই চন্দ্রচূড় শিক্ষানবিশ আইনজীবী হিসাবে কাজ শুরু করেন।
১৯৯৮ সালে চন্দ্রচূড় বম্বে হাইকোর্টের সিনিয়র আইনজীবী হন। দু’বছর পর বম্বে হাইকোর্টেরই বিচারপতি নিযুক্ত হন তিনি।
এর পর ২০১৩ সালে ইলাহাবাদ হাই কোর্টের বিচারপতি নিযুক্ত হন চন্দ্রচূড়। ২০১৬ সালের ১৩ মে নিযুক্ত হন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসাবে। দেশের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেলের দায়িত্বও তিনি সামলান।
সুপ্রিম কোর্টে আধার মামলায় বেঞ্চের সদস্য ছিলেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। মামলায় রায় দিয়ে বিচারপতি চন্দ্রচূড় সতর্ক করেছিলেন, প্রতিটি তথ্যভান্ডারের সঙ্গে আধার যুক্ত হলে ব্যক্তি অধিকারে আঘাত লাগতে পারে। আধারের বর্তমান ব্যবস্থার ১০টি গলদের কথাও তিনি শুনানির সময় উল্লেখ করেছিলেন।
রাম জন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার জন্য সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চেও ছিলেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। এই বেঞ্চের নেতৃত্বে ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ। ২০১৯-এর ৯ নভেম্বর দেশের সবচেয়ে বিতর্কিত মামলার রায় দিয়ে ইতিহাস রচনা করেন তিনি।
সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের অপব্যবহার নিয়েও কড়া সুর শোনা গিয়েছিল বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের গলায়। ২০২১ সালে আমেরিকা ও ভারতের আইনি সম্পর্ক নিয়ে এক অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করার সময় বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানান, অসন্তোষের স্বর চাপা দিতে সন্ত্রাস-বিরোধী আইনের অপব্যবহার যেন না হয়।
আদালত কক্ষের শুনানি চলাকালীন কথোপকথন সমাজমাধ্যমে অন্য ভাবে ব্যাখ্যা করা হয় বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। তিনি মন্তব্য করেন, রায় এবং সওয়াল-জবাবের পার্থক্য বোঝার ক্ষমতা নেই সমাজমাধ্যম ব্যবহারকারীদের।
বিচারপতিদের নিশানা করা নিয়েও বিচারপতি চন্দ্রচূড়কে সরব হতে দেখা গিয়েছিল। মহারাষ্ট্র ও উত্তরপ্রদেশে বিচারপতিদের আক্রমণ করার প্রবণতা বেশি বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি।
বিচারপতি চন্দ্রচূড় এক বার বলেছিলেন, ‘‘খাবারের জন্য কাউকে পিটিয়ে খুন করা হলে বা ব্যঙ্গচিত্রের জন্য কার্টুনিস্টের জেল হলে সংবিধানটাই ব্যর্থ হয়ে যায়। ধর্মীয় বিষয় নিয়ে মন্তব্য করায় যদি ব্লগারের জেল হয়, তা হলেও সংবিধান ব্যর্থ হয়।’’
সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হিসাবে বাবার দেওয়া রায়কেও খণ্ডন করেছিলেন চন্দ্রচূড়। বাবার ঘোষণা করা রায়ে ‘গুরুতর খামতি’ ছিল বলেও মন্তব্য করেন চন্দ্রচূড়।
১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থার সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকার সমস্ত মৌলিক অধিকার খর্ব করেছিল। সেই সিদ্ধান্তে সায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের এক বেঞ্চ। বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বাবা প্রাক্তন বিচারপতি ওয়াইভি চন্দ্রচূড়ও সেই বেঞ্চেরই সদস্য ছিলেন। ১৯৭৬ সালের সেই মামলা বহুদিন চর্চায় ছিল।
সেই যুক্তিই খারিজ করে ২০১৭ সালে বিচারপতি চন্দ্রচূড় জানান, পাঁচ সদস্যের বেঞ্চে বিচারপতি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তার মধ্যে খামতি ছিল। তিনি বলেছিলেন, ‘‘জীবন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতা মৌলিক অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জীবন এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার পূর্ণ দখল কোনও সভ্য দেশ নিতে পারে না।’’ তিনি জানান, ব্যক্তিস্বাধীনতা মানুষের আদিম অধিকারের মধ্যে পড়ে। জীবন বা স্বাধীনতা— রাষ্ট্রের দেওয়া উপহারও নয়, সংবিধানও এই অধিকার তৈরি করে না বলেও মন্তব্য করেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়।
এর পর ২০১৮ সালেও বাবার দেওয়া অন্য একটি রায়ের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন বিচারপতি চন্দ্রচূড়। ১৯৮৫ সালে বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বাবা প্রাক্তন বিচারপতি ওয়াইভি চন্দ্রচূড় বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ককে ‘অসাংবিধানিক’ বলেছিলেন।
এর ৩৩ বছর পর বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেন, ‘‘ভারতীয় দণ্ডবিধির ৪৯৭ নম্বর ধারার মূল ভিতেই রয়েছে লিঙ্গবৈষম্যের ছাপ। সেখানে চালু ধারণাকে মেনে নেওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে। যেন মেনে নেওয়া হয়েছে যে, বিয়ের পর স্বামী সব কিছুতেই তাঁর স্ত্রীর প্রভু।’’ তাঁর প্রশ্ন ছিল, বিয়ের পর স্ত্রী অন্য কাউকে তাঁর যৌনসঙ্গী করতে চাইলে, সে ব্যাপারে তাঁকে কেন স্বামীর সম্মতি নিতে হবে? বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের বলেন, ‘‘এটা তো পুরুষতান্ত্রিক ঝোঁক। এই আইন চলতে পারে না।’’
ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আলোচনা করা একেবারে পছন্দ করেন না বিচারপতি চন্দ্রচূড়। ২০০৮ সালে তাঁর বাবা মারা যান। এর এক বছর আগে মারা যান স্ত্রী রশ্মিও। এর কয়েক বছর পর মুম্বইয়ে নিজ বাসভবনে ব্যক্তিগত পরিসরে ফের বিয়ে করেন তিনি।
বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের দুই সন্তান। তবে তাঁদের মধ্যে কেউই আইনের প্রতি আগ্রহী নন। তাঁর দুই সন্তানের এক জন লেখক।