ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস দীর্ঘ এবং রক্তক্ষয়ী। ভারতকে ব্রিটিশরাজ থেকে মুক্ত করতে দেশের অগণিত বীর সেনা শহিদ হয়েছিলেন। তবে এমনও অনেকে ছিলেন, যাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিলেও তাঁদের উল্লেখ ইতিহাসের পাতায় সে ভাবে পাওয়া যায় না।
স্বাধীনতা সংগ্রামের এ রকমই এক জন বীরাঙ্গনার নাম ছিল নীরা আর্য। যিনি আইএনএ (ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মি, পরে নাম হয় আজাদ হিন্দ ফৌজ)-র এক জন যোদ্ধা ছিলেন। ‘ঝাঁসির রানি’ রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন তিনি। ইতিহাসবিদের একাংশের মতে, নীরা আইএনএ-র হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন।
ভারতের স্বাধীনতার সাত দশক পেরিয়েছে। কিন্তু নীরার জীবন সম্পর্কে এবং কী ভাবে তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছিলেন— তা অনেকেরই জানা নেই।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯০২ সালের ৫ মার্চ উত্তরপ্রদেশের বাগপত জেলার খেকরা শহরে জন্মগ্রহণ করেন নীরা। নীরা ছিলেন সেখানকার বিশিষ্ট ভারতীয় ব্যবসায়ী শেঠ ছাজুমলের কন্যা। খুব কম বয়স থেকেই দেশের প্রতি ভালবাসার কারণে স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ নেন নীরা।
মেয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে হাত মেলাতে পারে মনে করে ছাজুমল নাকি শীঘ্রই মেয়ের জন্য উপযুক্ত পাত্র খুঁজতে শুরু করে দেন। ঔপনিবেশিক ভারতের এক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্তা শ্রীকান্ত জয়রঞ্জন দাসের সঙ্গে বিয়ে দেন নীরার।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিয়ের পর পরই স্বামীর পেশার কারণে অর্ন্তদ্বন্দ্ব তৈরি হয় নীরা এবং শ্রীকান্তের মধ্যে। শ্রীকান্ত ব্রিটিশ সরকারের হয়ে কাজ করতেন এবং অনুগত ছিলেন। অন্য দিকে, নীরা চাইতেন ব্রিটিশদের শৃঙ্খল থেকে ভারতের স্বাধীনতা।
দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে বিয়ের পর নীরা নাকি আজাদ হিন্দ ফৌজের ‘ঝাঁসির রানি’ রেজিমেন্টে যোগদান করেন। এই রেজিমেন্ট তখন সক্রিয় ভাবে দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য কাজ করছিল।
১৯৪৩ সালে ২১ অক্টোবর ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ তৈরি করেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। ভারত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে উৎখাত করার জন্য ১৯৪২ সালে রাসবিহারী বসু এবং মোহন সিংহের নেতৃত্বে আইএনএ সেনাবাহিনী প্রথম তৈরি হয়েছিল। পরে নেতাজির হাত ধরে তারই নাম হয় ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’।
নীরার স্বামী শ্রীকান্ত শীঘ্রই নাকি স্ত্রীর আজাদ হিন্দ ফৌজে জড়িত থাকার বিষয়ে জানতে পারেন। শ্রীকান্তকেই নেতাজির উপর গুপ্তচরবৃত্তি করার এবং তাঁকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। অন্য দিকে, নীরাও নাকি স্বামীর কাছ থেকে ব্রিটিশদের গোপন তথ্য বার করতে ‘গুপ্তচরবৃত্তি’ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।
নীরা যে কোনও মূল্যে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ’ এবং নেতাজিকে বাঁচাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। ইতিহাসবিদদের একাংশের মতে, শ্রীকান্ত নেতাজিকে হত্যার ছক কষলে নীরাই নাকি তাঁর স্বামীকে ছুরির কোপ মেরে হত্যা করেন।
সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ব্রিটিশ সরকারের কর্মচারীকে খুনের দায়ে নীরাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়। নীরা আর্যকে কারাবাসের জন্য আন্দামানে পাঠানো হয়েছিল। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, নীরার উপর প্রতি দিন অকথ্য অত্যাচার করা হত। তাঁকে ছোট একটি কুঠুরিতে লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছিল।
নেতাজি সম্পর্কে তথ্য ফাঁস করার জন্য বিভিন্ন রকম প্রলোভনও নাকি দেখানো হয় নীরাকে। কিন্তু দেশের প্রতি গভীর ভালবাসা এবং নেতাজির প্রতি শ্রদ্ধার কারণে তিনি ব্রিটিশ সরকারকে কোনও রকম তথ্য দেননি। ইতিহাসবিদদের কেউ কেউ মনে করেন, নীরা শেষ পর্যন্ত নেতাজি এবং আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে কোনও তথ্য দিতে রাজি না হওয়ায় তাঁর স্তন কেটে ফেলা হয়।
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইএনএ-র গুপ্তচর হিসাবে কারাগারে বন্দি রাখা হয়েছিল নীরাকে। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি জেল থেকে মুক্তি পান। বাকি জীবন সব্জি বিক্রেতা হিসাবে হায়দরাবাদে কাটিয়েছিলেন।১৯৯৮ সালে তিনি হায়দরাবাদেই মারা যান।
কন্নড় চলচ্চিত্র পরিচালক রূপা আইয়ার সম্প্রতি নীরার জীবন নিয়ে একটি ছবি তৈরির কথা ঘোষণা করছেন। এই ছবিতে নীরার চরিত্রে তিনিই অভিনয় করছেন বলেও জানা গিয়েছে।
ছবি: সংগৃহীত।