ইংলিশ চ্যানেলের পারে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাকিস্তানের ‘গ্রুমিং গ্যাং’! তাদের ভয়ে কাঁটা ব্রিটিশ শৈশব। নাবালক-নাবালিকাদের যৌন নির্যাতন থেকে শুরু করে মাদকাশক্তি বা ধর্ম পরিবর্তন, কিছুই নাকি বাকি রাখছে না পাক দুষ্কৃতীরা। নতুন বছরের গোড়ায় এই ইস্যুতে ব্রিটেনের কিয়ের স্টার্মার সরকারকে ‘ঠুঁটো জগন্নাথ’ বলে সুর চড়ালেন আমেরিকার ধনকুবের শিল্পপতি ইলন মাস্ক। হ্যারি পটার খ্যাত জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক জেকে রাউলিংকেও পাশে পেয়েছেন তিনি।
রদারহ্যাম কেলেঙ্কারিকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জে চড়ছে রাজনীতির পারদ। ক্ষমতাসীন লেবার পার্টির প্রধানমন্ত্রী স্টার্মারের পদত্যাগ চেয়ে সুর চড়াতে শুরু করেছে বিরোধী দলগুলি। আর এই ইস্যুতেই প্রকাশ্যে এসেছে পাক ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের প্রসঙ্গ, যাদের ধর্ষক ছাড়া আর কিছুই বলতে রাজি নন যুক্তরাষ্ট্রের ধনকুবের শিল্পপতি মাস্ক।
কী এই ‘গ্রুমিং গ্যাং’? কী ভাবেই বা ইংরেজ নাবালক-নাবালিকাদের যৌন নির্যাতনের শিকার বানাচ্ছে তারা? ব্রিটিশ পুলিশ একে সংগঠিত অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, এই দলের সদস্যদের নিশানায় মূলত স্কুল বা শিশু আবাসিক কেন্দ্রগুলি থাকে। সেখানেই গাড়ি এবং বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে ঘোরাঘুরি করেন তাঁরা।
‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের মধ্যে এমন কয়েক জন রয়েছেন, যাঁরা কথাবার্তায় বেশ পটু। নাবালক-নাবালিকাদের সঙ্গে দ্রুত বন্ধুত্ব পাতিয়ে ফেলেন তাঁরা। এর পর চকোলেট এবং বিভিন্ন উপহার দিয়ে তাদের বিশ্বাস অর্জন করেন। শেষে ওই কিশোর বা কিশোরীকে মদ-সিগারেট এবং অন্যান্য মাদকের নেশা ধরান তাঁরা। শেষ ধাপে তাদের তুলে নিয়ে গিয়ে চলে যৌন নির্যাতন। এর পাশাপাশি ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের বিরুদ্ধে রয়েছে ধর্মান্তরণের অভিযোগও।
ইংল্যান্ডের ইয়র্কশায়ারের রদারহ্যাম শহরে এই ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের হদিস পেয়েছে ব্রিটিশ পুলিশ। তদন্তকারীদের দাবি, ১৯৯৭ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে সেখানে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১,৪০০টি শিশু। এই সংখ্যা ৪০ হাজারে পৌঁছতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের হাত থেকে নিস্তার পায়নি ১১ বছরের কিশোরীও। মানব পাচারের সঙ্গেও এই দুষ্কৃতীরা জড়িত বলে গোয়েন্দা সূত্রে মিলেছে খবর।
রদারহ্যাম কেলেঙ্কারির তদন্তে প্রকাশ্যে এসেছে আরও কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য। জানা গিয়েছে, ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের সকল সদস্যই পুরুষ। তাঁদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পাক নাগরিক। তাঁদের সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় কিছু দুষ্কৃতী। তাদের শিকার হচ্ছে মূলত স্কুলে পড়া মেয়েরা। নির্যাতিতাদের অভিভাবকদের অভিযোগ, বিষয়টি নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশের দ্বারস্থ হয়েও লাভ হয়নি। এই নিয়ে একাধিক প্রতিশ্রুতি দিলেও নাবালিকাদের সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছেন ইংরেজ উর্দিধারীরা।
প্রসঙ্গত, ২০০৮ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্টার্মার। তাঁর সময়কালে রদারহ্যাম কেলেঙ্কারির বেশ কিছু মামলা প্রকাশ্যে আসে। মাস্কের অভিযোগ, ধর্ষকদের কঠিনতম শাস্তি দেওয়ার বদলে তাঁদের ছেড়ে দেন স্টার্মার। এই নিয়ে সমাজমাধ্যম এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) একটি পোস্টও করেছেন আমেরিকার এই ধনকুবের শিল্পপতি।
নিজের লেখায় নাম না করে স্টার্মারকে নিশানা করেন মাস্ক। পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘‘ক্রাউন প্রসিকিউশন সার্ভিসের প্রধান থাকাকালীন ধর্ষকদের বিচার না করে তরুণীদের শোষণের অনুমতি দিয়েছিল কে?’’ প্রসঙ্গত, রদারহ্যাম কেলেঙ্কারি নিয়ে সাংবাদিক স্যাম অ্যাশওয়ার্থ-হেইসের লেখায় ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বিস্তারিত প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। সেটির কথা উল্লেখ করে সুর চড়িয়েছেন সাহিত্যিক রাউলিং।
এক্স হ্যান্ডলে করা পোস্টে রাউলিং লিখেছেন, ‘‘ধর্ষকদের কেন গ্রুমিং গ্যাং বলব? এতে ছুরি দিয়ে খুনের পর আততায়ীকে ‘ছুরির মালিক’ বলে সম্বোধন করার সামিল। সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে পুলিশি দুর্নীতির অভিযোগও আনা হয়েছে। ব্রিটিশ পুলিশের এতটা অধঃপতন হয়েছে, সেটা বিশ্বাস করা বেশ কঠিন।’’
রদারহ্যাম কেলেঙ্কারিকে ‘সবচেয়ে ভয়ঙ্কর’ বলে বর্ণনা করেছেন হ্যারি পটারের স্রষ্টা। বিষয়টিতে মুখ খুলেছেন কনজ়ারভেটিভ পার্টির নেত্রী তথা সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লিস ট্রাস। তাঁর কথায়, ‘‘১১ বছরের নাবালিকার ধর্ষণ লজ্জাজনক ঘটনা। সারা বিশ্বের কাছে আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গিয়েছে। শুধু অপরাধীদের শাস্তি হলেই হবে না। ‘জাতিগত উত্তেজনা’ ছড়ানোর ভয়ে যাঁরা চোখ বন্ধ করে রয়েছেন, তাঁদেরও সজাগ হওয়ার সময় এসেছে।’’
পাক ‘গ্রুমিং গ্যাং’কে বাগে আনতে না পারার নেপথ্যে ব্রিটিশ ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার দিকে আঙুল তুলেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ট্রাস। অবিলম্বে ২০০৫ সালের আগের কড়া আইন ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি পুলিশ বিভাগের সংস্কারের কথা শোনা গিয়েছে তাঁর গলায়। মন্ত্রীদের হাতে সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্ট এবং পুলিশ অফিসারদের নিয়োগ ও বরখাস্ত করার ক্ষমতা থাকার বলেছেন ট্রাস।
অন্য দিকে ব্রিটিশ সাংবাদিক টমি রবিনসনের সমর্থনে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) পোস্ট করেছেন মাস্ক। বর্তমানে জেলবন্দি রয়েছেন তিনি। পাক ‘গ্রুমিং গ্যাং’য়ের কড়া সমালোচক ছিলেন তিনি। এই দুষ্কৃতী দলের জঘন্য কীর্তিকলাপ নিয়ে তাঁর লেখা একাধিক প্রতিবেদন ব্রিটেনে রীতিমতো শোরগোল ফেলে দিয়েছিল। এই সংক্রান্ত একটি তথ্যচিত্রও প্রকাশ করেছেন টমি।
রবিনসনের সমর্থকদের দাবি, সত্যি কথা বলার খেসারত দিতে হচ্ছে তাঁকে। মুখ বন্ধ রাখতে এবং অপরাধ চাপা দিতে তাঁকে জেলবন্দি করে রেখেছে সরকার। অবিলম্বে তাঁর মুক্তির দাবি করে সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেছেন মাস্ক। পাশাপাশি, ১১ বছরের ব্রিটিশ কিশোরীর ধর্ষণের মর্মান্তিক কাহিনি সেখানে ছড়িয়ে দিয়ে স্টার্মার প্রশাসনের উপর চাপ বাড়িয়েছেন টমিপ্রেমীরা।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী ট্রাসের মতো এ ব্যাপারে মুখ খুলেছেন গ্রেট ইয়ারমাউথের সাংসদ রুপার্ট লো। তিনি বলেছেন, ‘‘গ্রুমিং গ্যাং আসলে গণধর্ষকদের দল। এই সত্যিটা আমাদের মানতেই হবে। এই চক্রের সমস্ত বিদেশি নাগরিককে অবশ্যই নির্বাসন দিতে হবে। কেড়ে নিতে হবে দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকার।’’
ব্রিটিশ সরকার জানিয়েছে, রদারহ্যাম কেলেঙ্কারিতে এখনও পর্যন্ত মোট সাত জনকে জেলে পাঠানো হয়েছে। এই মামলায় ১১ এবং ১৫ বছর বয়সি দুই কিশোরীর যৌন নির্যাতনের কথা জানা গিয়েছে। সাজাপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছেন মহম্মদ অমর (৪২), মহম্মদ সিয়াব (৪৪), ইয়াসির আজ়াইবে (৩৯), মহম্মদ জমির সাদিক (৪৯), আবিদ সাদ্দিক (৪৩), তাহির ইয়াসিন (৩৮) এবং রামিন বারি (৩৭)।
তবে এই ঘটনায় আরও অনেকেই যে জড়িত রয়েছেন, তা এক রকম স্বীকার করে নিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। যদিও রদারহ্যাম কেলেঙ্কারি নিয়ে নতুন করে তদন্তের নির্দেশ দেননি দ্বীপরাষ্ট্রের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জেস ফিলিপস্। অন্য দিকে মাস্কের কথার জবাব দিয়েছেন স্টার্মার মন্ত্রিসভার সদস্য তথা ব্রিটেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ওয়েস স্ট্রিটিং। এক্স হ্যান্ডলের পোস্টে তিনি লিখেছেন, ‘‘না জেনে বেশ কিছু অভিযোগ করছেন টেসলা কর্তা।’’
কয়েক দিন আগেই মাস্কের বিরুদ্ধে ব্রিটেনের রাজনীতিতে নাক গলানোর অভিযোগ ওঠে। দ্বীপরাষ্ট্রের অতি দক্ষিণপন্থী অংশকে মদত দিয়ে সেখানে তিনি অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে দাবি করেছে ক্ষমতাসীন লেবার পার্টি। শুধু তা-ই নয়, এক বছর পূর্ণ না হওয়া ব্রিটেনের নির্বাচিত সরকারকে ফেলে সে দেশে নতুন করে ভোটের ডাকও সমাজমাধ্যমে দিয়ে বিষয়টি জটিল করে তুলেছেন এই ধনকুবের।
এই পরিস্থিতিতে আমেরিকাকে না চটিয়েও মাস্কের আচরণে ক্ষোভ জানিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। ইংল্যান্ডের পাশাপাশি জার্মানির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও হস্তক্ষেপের অভিযোগ উঠেছে যুক্তরাষ্ট্রের এই শিল্পপতির বিরুদ্ধে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তাঁর ‘পছন্দের প্রার্থী’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর থেকেই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আচমকা সক্রিয় হয়ে উঠেছেন তিনি।
সব ছবি: সংগৃহীত।