আর্থিক দিক থেকে দেউলিয়া হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে দেশ। প্রায় খালি হয়ে এসেছে বিদেশি মুদ্রার ভান্ডার। কিন্তু, ভারতের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির সেনাকর্তাদের দেখলে তা বোঝার জো নেই! দিব্যি ঠাটবাট বজায় রেখেছেন তাঁরা। শুধু তা-ই নয়, বেতন কাঠামোর নিরিখে সেখানকার ফৌজি অফিসারদের ঈর্ষা করতে পারে দুনিয়ার তাবড় শক্তিধর রাষ্ট্র।
সম্প্রতি কাবুলের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। সীমান্ত সংঘর্ষে জড়িয়েছে দুই দেশ। কাবুলের বর্তমান তালিবান শাসকদের পূর্ণ সমর্থন মেলায় পাক সৈনিকদের ক্রমাগত নিশানা করে চলেছে ‘তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান’ (টিটিপি) নামের জঙ্গি গোষ্ঠী। তাঁদের সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধে এঁটে উঠতে না পেরে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছেন রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা।
এই আবহে ফের এক বার পাক সেনার সামরিক শক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলে খোঁচা দিতে শুরু করেছে আফগান তালিবান। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই খবরের শিরোনামে চলে এসেছে ইসলামাবাদের সেনার গঠনতন্ত্র। পাশাপাশি, সাধারণ সৈনিক থেকে শুরু করে কর্তাদের বেতনের দিকটিও জানা গিয়েছে।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর মতো পাক ফৌজেও রয়েছে তিন পদমর্যাদার সৈনিক। তাঁরা হলেন, নন কমিশন্ড অফিসার (এনসিও), জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার (জেসিও) এবং অফিসার। এ দেশের মতোই মূল বেতনের (বেসিক পে) সঙ্গে একাধিক ভাতা (অ্যালাউন্স) পান তাঁরা। রয়েছে অন্যান্য কিছু সুযোগ-সুবিধাও।
পাক ফৌজের একেবারে নীচের স্তরে থাকেন এনসিও পদমর্যাদার সৈনিক। চাকরি জীবনের সূচনায় মূল বেতন হিসাবে পাক মুদ্রায় ১৮ থেকে ৩০ হাজার টাকা পান তাঁরা। তবে নির্দিষ্ট কিছু কাজ বা অপারেশনের ক্ষেত্রে মেলে অতিরিক্ত অর্থ।
এনসিও পদের শুরুতে রয়েছে সিপাহী বা জওয়ান র্যাঙ্ক। এর পর পদোন্নতি হলে ক্রমে ক্রমে ল্যান্স নায়েক, নায়েক এবং হাবিলদার হিসাবে কাজ করার সুযোগ পান তাঁরা। চাকরি জীবনের বেশ কয়েক বছর অতিবাহিত হলে এনসিও থেকে জেসিওতে উন্নীত হওয়ার সুযোগ রয়েছে পাক ফৌজে।
পাক সেনার জেসিওদের মূল বেতন সাধারণত স্থানীয় মুদ্রায় ২০ হাজার থেকে ৪০ হাজারের মধ্যে ঘোরাফেরা করে। এতে নায়েব সুবেদার, সুবেদার এবং সুবেদার মেজরের মতো পদ রয়েছে। ঘোড়সওয়ার বাহিনীর জেসিওরা অবশ্য সামান্য বেশি বেতন পেয়ে থাকেন।
পাক সেনায় তিন ধরনের অফিসার রয়েছেন। নীচের স্তরে থাকেন জুনিয়ার অফিসারেরা। মাঝের স্তরে সিনিয়র অফিসারদের রেখেছে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর। আর ফৌজের একেবারে সর্বোচ্চ স্তরে রয়েছেন জেনারেল অফিসারেরা। এঁদের বেতন সবচেয়ে বেশি।
জুনিয়র অফিসার শ্রেণিতে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, লেফটেন্যান্ট এবং ক্যাপ্টেনদের রেখেছে ইসলামাবাদ। পাক সেনার ক্যাপ্টেনরা মূল বেতন হিসাবে মাসে স্থানীয় মুদ্রায় পান ৫০ হাজার থেকে ৯০ হাজার টাকা। অন্য দিকে মাঝারি স্তরের মধ্যে প্রথমেই থাকবেন মেজর পদমর্যাদার অফিসার। তাঁদের বেতন মাসে ৬০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকা ধার্য করেছে ইসলামাবাদ।
ক্যাপ্টেনের ঊর্ধ্বতন হিসাবে পাক ফৌজে রয়েছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল এবং কর্নেল পদ। এঁরাও ফৌজের মাঝারি শ্রেণির অফিসার। কর্নেল র্যাঙ্কে পাক মুদ্রায় মাসে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত মূল বেতন ধার্য করা রয়েছে। জেনারেল পদমর্যাদার সূচনা ব্রিগেডিয়ার দিয়ে। এতে মাসে মূল বেতন বাবদ মেলে দেড় লক্ষ টাকা।
পাক সেনায় জেনারেলের তিনটি পদ রয়েছে। সেগুলিতে মূল বেতন শুরু বার্ষিক দু’লক্ষ টাকা থেকে। বেতনের পাশাপাশি বিলাসবহুল বাংলো, স্বাস্থ্য খাতে বিপুল খরচের সুযোগ এবং নামীদামি ক্লাবের সদস্যপদ পেয়ে থাকেন তাঁরা। পাক ফৌজের এই পদগুলি হল মেজর জেনারেল, লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং জেনারেল।
পাক সেনার সর্বাধিনায়কের পদে থাকেন জেনারেল পদমর্যাদার অফিসার। বর্তমানে এই পদে রয়েছেন আসিফ মুনির। বাহিনীর মাঝারি শ্রেণির অফিসাররাও বিলাসবহুল বাড়ি, যাতায়াত ভাড়া এবং পরিবারের সদস্যদের চিকিৎসার খরচ সংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন।
এ ছাড়া রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতরের হাতে রয়েছে ইঞ্জিনিয়ারদের দল। এই পদেও উচ্চ বেতন দেয় ইসলামাবাদ। পাক মুদ্রায় বছরে ৬০ হাজার থেকে ১.২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত মূল বেতন পান তাঁরা। তথ্যপ্রযুক্তির কাজে যুক্তদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে বেতন দেয় পাক সেনা।
ভারতের মতো পাকিস্তানে নৌ এবং বায়ুসেনা প্রধানরাও রয়েছেন। রাওয়ালপিন্ডির জেনারেলদের মতোই বেতন পান তাঁরা। তবে ক্ষমতার নিরিখে তাঁদের কিছুটা খাটো করে দেখা হয়। স্বাধীনতার পর থেকে মোট চার বার সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে পশ্চিমের এই প্রতিবেশী দেশে। প্রতি বারই এর নেতৃত্বে ছিলেন স্থলসেনার জেনারেলরা।
১৯৫৮ সালে প্রথম বার পাকভূমিতে ঘটে সেনা অভ্যুত্থান। ইসকান্দার মির্জ়াকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল আয়ুব খান। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন তিনি। আয়ুব পদত্যাগ করলে জেনারেল ইয়া হিয়া খান তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। ইসলামাবাদে অব্যাহত থাকে সেনা শাসন। ১৯৭১ সালে জেনারেল ইয়া হিয়া ইস্তফা দিলে গণতন্ত্রের রাস্তায় ফেরে পাকিস্তান।
পাকিস্তানে তৃতীয় বার ফৌজি অভ্যুত্থান ঘটান জেনারেল জিয়া উল হক। ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোকে গদি থেকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল জিয়া। তাঁর আমলেই ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ‘পাকিস্তান পিপল্স পার্টি’ বা পিপিপির জন্মদাতা তথা সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোকে।
২০০১ সালে ফের সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাকিস্তানের গদিতে বসেন জেনারেল পারভেজ মুশারফ। ২০০৮ সাল পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন তিনি। পরে অবশ্য ক্ষমতা হারিয়ে দেশে ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে গা ঢাকা দেন মুশারফ। ১৯৯৯ সালের কার্গিল যুদ্ধের মাস্টারমাইন্ড ছিলেন এই পাক সেনাকর্তা।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে অফিসার এবং জওয়ান মিলিয়ে ৯৩ হাজার পাক সেনা ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করে। সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত সংঘর্ষ বৃদ্ধি পাওয়ায় এই নিয়ে কাবুলের তালিবান শাসকদের ইসলামাবাদকে বার বার খোঁচা দিতে দেখা যাচ্ছে। আত্মসমর্পণের ছবি পোস্ট করে হুমকিও দিয়েছেন তাঁরা। ফলে পাক সেনার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বাড়ছে বলেই মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
সব ছবি: সংগৃহীত।