পতন হয়েছে বাশার আল আসাদের ২৪ বছরের সাম্রাজ্যের। বিদ্রোহের মুখে সিরিয়া ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছেন তিনি। রাজধানী দামাস্কাস দখল করে নিয়েছেন বিদ্রোহীরা। বাশারকে মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে রাশিয়া। খবর, দেশ ছেড়ে সপরিবার সেখানেই রয়েছেন তিনি।
২০০০ সালে সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসেছিলেন বাশার। এর আগে তাঁর বাবা দীর্ঘ দিন ওই কুর্সিতে ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে সিরিয়ায় বাশার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
প্রথম থেকেই এই যুদ্ধে বিদ্রোহীদের সমর্থন করেছিল আমেরিকা। অন্য দিকে, সিরিয়া সরকার রাশিয়া এবং ইরানের সহায়তা পেয়েছিল। গত ১৩ বছর ধরে কড়া হাতে যাবতীয় বিদ্রোহ দমন করেছে বাশারের প্রশাসন।
কিন্তু বাশারের পতনের সূচনা হয় গত ২৭ নভেম্বর। মাত্র ১২ দিনে তাঁর সরকার পড়ে যায়। পরিস্থিতি তাঁকে দেশ ছাড়তেও বাধ্য করে।
তবে বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, আসাদের পতনের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল ১৩ বছর আগেই। আর তার সূচনা করেছিল ১৪ বছর বয়সি এক কিশোর। অনেকের দাবি, সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর নেপথ্যেও হাত ছিল ওই কিশোরের। কিন্তু কী ভাবে?
২০১১ সালের গোড়ার দিকের কথা। আসাদ-শাসনের বিরুদ্ধে তখন ধীরে ধীরে জনরোষ তৈরি হচ্ছে সিরিয়ার অলিতে গলিতে।
সেই সময় দক্ষিণ সিরিয়ার দারার এলাকায় পরিবারের সঙ্গে বসবাস ছিল মোউয়াইয়া সিয়াসনের। অন্য অনেক পরিবারের মতো ১৪ বছর বয়সি ওই কিশোরের পরিবারেও আসাদ-বিরোধী সুর শোনা যাচ্ছিল।
ছোট্ট মোউয়াইয়ার ‘গ্রাফিটি’র শখ ছিল। এর মধ্যেই প্রতিবাদস্বরূপ দারার রাস্তার ধারে একটি দেওয়ালে স্প্রে-পেন্ট দিয়ে একটি গ্রাফিটি বানিয়েছিল কিশোর। ওই গ্রাফিটির ছবি প্রকাশ্যে আসতেই নাকি সিরিয়ার দিকে দিকে বিদ্রোহের দামামা বেজে ওঠে। আর তার পরেই গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।
কিন্তু কী লেখা ছিল সেই গ্রাফিটিতে? মোউয়াইয়া লিখেছিল, ‘এজাক এল ডোর, ইয়া ডক্টর (এ বার আপনার পালা ডাক্তার)’। আসাদ পেশায় চিকিৎসক ছিলেন। সিরিয়ার রাজনীতিতে উত্থানের আগে সেনা-চিকিৎসক হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
আর তাই কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি গ্রাফিটিতে কোন ‘ডক্টর’-এর কথা লেখা হয়েছিল। গ্রাফিটির সেই লেখা অনুঘটকের মতো ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে। আসাদের শাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলে মানুষ রাস্তায় নামে। আসাদ সরকারও বিদ্রোহী দমনে তৎপর হয়। শুরু হয় গৃহযুদ্ধ।
কিন্তু কেন ওই গ্রাফিটি এঁকেছিল কিশোর মোউয়াইয়া? অনেকের দাবি, আসাদ সরকারের পুলিশের উপর বিরক্তি থেকে। আবার কেউ কেউ বলেন নিছক মজা থেকে। তবে গ্রাফিটি নজরে পড়তেই মোউয়াইয়া এবং তার কয়েক জন বন্ধুকে নাকি জোর করে তুলে নিয়ে দিয়েছিল বাশারের পুলিশ। সিরিয়ার গোপন পুলিশ বা ‘মুখাবরাত’ তাদের ৪৫ দিন আটকে রাখে।
জেলে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার এবং মারধরের অভিযোগ ওঠে। ইলেকট্রিক শক দেওয়া হত বলেও অভিযোগ। এর প্রতিবাদে মোউয়াইয়ার বাবা-মা, প্রতিবেশী এবং আন্দোলনকারীরা পথে নামলে তাঁদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাস এবং গুলি ছোড়ে পুলিশ। তবে শেষ পর্যন্ত মোউয়াইয়াদের মুক্তি দেওয়া হয়।
মুক্তি পেলেও তাদের মারধরের ছবি ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা সিরিয়া জুড়ে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন বিদ্রোহীরা। মোউয়াইয়ার গ্রাফিটি প্রতিবাদের আগুনে ঘি ঢালে। ২০১১ সালের ১৫ মার্চ আসাদের শাসনের অবসানের দাবিতে দেশব্যাপী ‘ক্ষোভের দিন (ডে অফ রেজ)’ পালিত হয়।
এর পর যে ধরপাকড় শুরু করেছিল আসাদ প্রশাসনের পুলিশ, বিশেষজ্ঞদের অনেকে তাঁকে ‘নৃশংস’ আখ্যা দিয়েছেন। সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভকারীদের উপরও গুলি চালানোর অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ ওঠে, ভিন্নমতাবলম্বীদের বন্দি করে নির্যাতন করার।
২০১১ সালের জুলাইয়ে আসাদের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করা সেনারা ‘ফ্রি সিরিয়ান আর্মি (এফএসএ)’ তৈরি করেন। আসাদের বিরোধিতা করলেও সংহতি এবং সম্পদের অভাবে সেই বিদ্রোহীরা গুরুত্ব হারান। এই শূন্যতা পূরণ করে জাভাত আল-নুসরা এবং ইসলামিক স্টেটের মতো চরমপন্থী দলগুলি।
এর পর দীর্ঘ ১৩ বছর কেটে গিয়েছে। সিরিয়ার বেশ কয়েকটি জায়গা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে পাঁচ লক্ষ মানুষের। এক কোটির বেশি মানুষ সিরিয়া ছেড়ে চলে গিয়েছেন।
তবে সম্প্রতি পূর্ব ইউরোপ এবং পশ্চিম এশিয়ায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সিরিয়া সরকারের অন্যতম দুই সমর্থকই যুদ্ধে ব্যস্ত। রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত। ইরান ব্যস্ত পশ্চিম এশিয়ায় ইজ়রায়েলের সঙ্গে সংঘর্ষে। সিরিয়ার সরকার ফেলার জন্য এই সময়টিকেই উপযুক্ত বলে মনে করেছিলেন বিদ্রোহীরা।
বিদ্রোহী দুই সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘হায়াত তাহরির আল-শাম’ (এইচটিএস) এবং তাদের সহযোগী ‘জইশ আল-ইজ্জা’র যৌথবাহিনীর সামনে কোণঠাসা হয়ে পড়ে সিরিয়ার সেনা। মিত্র দেশগুলির কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাননি বাশার। ফলে বিদ্রোহীদের আগ্রাসনের মুখে কোনও প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেননি তিনি।
বাশারের সরকার পড়ে গিয়েছে। বিদ্রোহী বন্দিদের মুক্ত করা হয়েছে। গত ৮ ডিসেম্বর বিদ্রোহী নেতা গোলানি দামাস্কাসের মসজিদে যান এবং জয় ঘোষণা করেন। রাশিয়া এবং ইরানের সংবাদমাধ্যমে দাবি করা হয়, বাশার সিরিয়া ছেড়ে রাশিয়ায় চলে গিয়েছেন। তাঁর পরিবারও সেখানেই রয়েছে। রাশিয়া তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে।
সিরিয়ার প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ গাজ়ি জালালি ইতিমধ্যেই সুর নরম করেছেন। জানিয়েছেন, সিরিয়া সরকার বিদ্রোহীদের সঙ্গে হাত মেলাতে এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে প্রস্তুত। ১৪ বছরের কিশোর মোউয়াইয়া এখন বছর সাতাশের যুবা।
ছবি: সংগৃহীত।