
বিশ্বের অন্যতম সেরা শহর। শহর জুড়ে ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং আধুনিকতার এক অসাধারণ মিশেল। শহরটা দেখলে মনে হবে কোনও বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা ছবির মতো। নাগরিক জীবনের সমস্ত স্বাচ্ছন্দ্য হাতের মুঠোয়। এক সময়ে ছিল বিশ্বের বৃহত্তম ও সবচেয়ে প্রভাবশালী নগরী। সে সময় শহরটি সুবৃহৎ ও সমৃদ্ধশালী ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর কেন্দ্রবিন্দুও ছিল।

এক সময় ধনীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল টেম্স নদীর তীরে গড়ে ওঠা এই শহর। মোহিনী এই শহরের মায়ায় জড়িয়ে এখানে শিকড় গেঁথেছিল বহু ধনী অভিজাত পরিবার। ইংল্যান্ডের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর লন্ডন। স্থাপত্যের দিক থেকে এই শহরের খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বহু সংস্কৃতি ও ধারণার সঙ্গমস্থল। ৯০ লক্ষের বেশি মানুষের বাস এখানে।

বৈশ্বিক শহর হিসাবে পরিচিত লন্ডন সংস্কৃতি, সঙ্গীত, শিক্ষা, রাজনীতি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক রাজধানী। লক্ষাধিক ইতিহাসবিজড়িত স্থান রয়েছে এখানে। ইতিহাসের পাতায় চোখ রাখলে জানা যায়, রোমান যুগে ৪৭ খ্রিস্টাব্দে রোমান সম্রাট ক্লডিয়াস টেম্স নদীর ধারে লন্ডিনিয়াম নামে এক শহরের স্থাপনা করেন। কালক্রমে সেই লন্ডিনিয়াম রূপান্তরিত হয় আজকের লন্ডনে।

এক সময় ধনীদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল লন্ডন। প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো এই শহরের আকর্ষণ নাকি কমছে বিত্তবানদের কাছে। ইংল্যান্ডের রাজধানীর মুকুট থেকে খসে পড়েছে একটি পালক। বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ধনী শহরের তকমা হারিয়েছে লন্ডন। এক সময় লন্ডন ছিল বিশ্বের ধনীতমদের আবাসস্থল। সেই লন্ডন ছেড়ে যাচ্ছেন তাঁরা। এই সংখ্যাটা কয়েকশোয় সীমাবদ্ধ নেই।

যুদ্ধবিধ্বস্ত রাশিয়ার রাজধানী মস্কো থেকেও বেশি বিত্তবান লন্ডন ছেড়েছেন। সবচেয়ে বেশি কোটিপতিকে হারানো শহর হিসাবে তালিকার শীর্ষে রয়েছে ব্রিটিশ রাজধানী। গত এক দশকে লন্ডন তার ১২ শতাংশ ধনী বাসিন্দাকে হারিয়েছে।

‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’-এর একটি নতুন প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ১১ হাজারেরও বেশি বিত্তবান ব্রিটিশ রাজধানী ছেড়েছেন। ধনীদের লন্ডন ছাড়ার প্রবণতা কয়েক বছর ধরেই চলছে। তবে তা এখন উদ্বেগজনক অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছে বলে প্রকাশিত হয়েছে রিপোর্টে।

এই ধনপতিদের বেশির ভাগই এশিয়া এবং আমেরিকার বিভিন্ন শহরকে বসবাসের জন্য বেছে নিয়েছেন। ধনীদের দেশত্যাগের প্রধান কারণ হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি বিষয়। তার মধ্যে রয়েছে ক্রমবর্ধমান কর, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং ব্রেক্সিট অর্থাৎ ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত।

যদিও এই অভিবাসন প্রবণতা লন্ডনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নতুন নয়। তবে এই প্রবণতা গত বছর থেকেই উল্লেখযোগ্য ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে রিপোর্টে বলা হয়েছে। বিশেষজ্ঞেরা পর্যবেক্ষণ করেছেন যে, খুব কম সময়ের মধ্যে বহু বিত্তবানই অন্য দেশে থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। এই ঘটনাটি বিশ্বব্যাপী সম্পদের কেন্দ্র হিসাবে পরিচিত লন্ডনের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ণ করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

এক বছরের মধ্যে লন্ডনে মোট বিত্তবানের সংখ্যা ২ লক্ষ ২৭ হাজার থেকে কমে ২ লক্ষ ১৫ হাজার ৭০০-এ দাঁড়িয়েছে। ফলস্বরূপ, কয়েক দশকের মধ্যে প্রথম বারের মতো শহরটি বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ ধনী শহরের তালিকা থেকে বাদ পড়েছে। ‘হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স’ ও ‘নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়েল্থ’-এর যৌথ ভাবে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুসারে, লন্ডনের স্থান দখল করছে আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলস।

সেই রিপোর্ট বলছে, গত ১০ বছরে বিত্তবানদের মধ্যে পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সিসকো এবং সিলিকন ভ্যালি-সহ সমুদ্রের উপকূলের এলাকাগুলি।

এই বিত্তবানদের সম্পত্তির পরিমাণ কত? এঁদের আর্থিক সম্পত্তির পরিমাণ ১ কোটি ডলারেরও বেশি। অর্থাৎ, ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ৮৬ কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ সম্পত্তির মালিক যে ধনকুবেররা, তাঁদের সংখ্যা কোন দেশে বেশি সেই নিয়েও একটি তালিকা প্রকাশ করেছে সংস্থা দু’টি। সেই তালিকায় ১০টি শহরের উল্লেখ রয়েছে।

কোটিপতির সংখ্যার নিরিখে শীর্ষ ১০টি শহরের মধ্যে সাতটিই আমেরিকা অথবা এশিয়ার। তালিকার প্রথম পাঁচে রয়েছে নিউ ইয়র্ক সিটি, আমেরিকার সান ফ্রান্সিসকোর উপকূলবর্তী অঞ্চল, টোকিয়ো, সিঙ্গাপুর, লস অ্যাঞ্জেলস।

তালিকায় লন্ডনের ঠাঁই হয়েছে ষষ্ঠ স্থানে। এ ছাড়াও সেই তালিকায় রয়েছে প্যারিস, হংকং, সিডনি ও শিকাগো। এই শহরগুলির মধ্যে সান ফ্রান্সিসকো বে এরিয়ায় কোটিপতি বাসিন্দার সংখ্যা ৯৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানে এশিয়ার সিঙ্গাপুরে কোটিপতির সংখ্যা ৬২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিত্তশালী লোকের বাস আমেরিকাতেই। অধিকাংশ প্রযুক্তি কোম্পানির আঁতুড়ঘর আমেরিকা। অ্যামাজ়ন, ফেসবুক, মাইক্রোসফ্ট, গুগ্ল-সহ বহু সংস্থার মালিক রয়েছেন মার্কিন ধনকুবেরের তালিকায়। পৃথিবীর ২১৫৮ জন ধনকুবেরের মধ্যে ৫৮৫ জনই আমেরিকার বাসিন্দা।

‘নিউ ওয়ার্ল্ড ওয়েল্থ’-এর প্রধান গবেষক অ্যান্ড্রু অ্যামোইলসের মতে, বিত্তশালীদের লন্ডন ত্যাগ করার একাধিক কারণ রয়েছে। প্রযুক্তিগত বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এশিয়া এবং আমেরিকার ক্রমবর্ধমান আধিপত্য বেশ কয়েক জন উদ্যোগপতিকে আস্তানা পরিবর্তনের বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য করেছে।

সংবাদ সংস্থা এএফপিকে দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি জানিয়েছেন, ব্রেক্সিটের ফলে আরও খারাপ প্রভাব পড়েছে। অ্যামোইলস উল্লেখ করেন যে, লন্ডনের উচ্চ কর কোটিপতিদের এই শহর থেকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে। ব্রিটেনে কর এবং সম্পত্তি শুল্কের হার বিশ্বে সর্বোচ্চ। এই করের ভারে হাঁসফাঁস করছেন কোটিপতিরা।

লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের পতন আরও একটি উদ্বেগজনক লক্ষণ বলে চিহ্নিত করেছেন অনেকে। তাঁদের মতে, লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের গুরুত্ব হ্রাস পাচ্ছে। বাজারি মূলধনের দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি স্টক এক্সচেঞ্জের মধ্যে এখন আর নেই লন্ডনের স্টক এক্সচেঞ্জ।

উন্নত কর নীতি, নানা আর্থিক সুযোগ-সুবিধা এবং ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগের সুবিধার কারণে এশিয়ার দুবাইয়ের মতো আর্থিক কেন্দ্র এবং ফ্রাঙ্কফুর্টের মতো ইউরোপীয় শহরগুলি দ্রুত বিত্তশালীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছে। দুবাই ছাড়াও প্যারিস, জেনিভা, ফ্রাঙ্কফুর্ট এবং আমস্টরডামের মতো নিকটবর্তী আর্থিক কেন্দ্রগুলির ক্রমাগত উত্থানের ফলে ইউরোপের শীর্ষ আর্থিক কেন্দ্র হিসাবে লন্ডনের মর্যাদা হ্রাস পেয়েছে।
সব ছবি: সংগৃহীত।