ছোট থেকেই গাছকে সই পাতিয়েছিল মেয়েটা। ভালবাসত প্রকৃতি। তার পর এক দিন যখন শুনলেন তাঁর প্রাণের প্রিয় সইকেই কেটে ফেলা হবে, তখন আর স্থির থাকতে পারলেন না। গাছের প্রাণ বাঁচাতে সটান চড়ে বসলেন মগডালে।
মেয়েটা তখন সদ্য তেইশে পা দিয়েছে। যে কোনও মূল্যে সইয়ের প্রাণ বাঁচাবেন, এমন পণ করে ফেললেন তিনি। ফলে এক-দু’দিন নয়, পাক্কা দু’বছর গাছের উপরে কাটাতে হয় তাঁকে। শেষে তাঁর জেদের কাছে হার মানে পুলিশ-প্রশাসন। রণে ভঙ্গ দিয়ে এলাকা ছাড়ে গাছ কাটার বরাত পাওয়া সংস্থা।
গল্পের মতো মনে হলেও বাস্তবে এই ঘটনা ঘটেছিল আমেরিকার উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ায়। গাছ কাটা বন্ধ করতে মগডালে দু’বছর কাটানো ওই তরুণীর নাম জুলিয়া হিল। ১৯৭৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মিসৌরিতে জন্ম হয় তাঁর। ভ্রাম্যমাণ প্রচারক হিসাবে জুলিয়ার পরিবারের খ্যাতি ছিল সর্বত্র।
২৩ বছর বয়সে উত্তর ক্যালিফোর্নিয়ার একটি পরিবেশবিদদের দলে যোগ দেন জুলিয়া। ওই সময়ে গাছ কাটার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন তাঁরা। প্রকৃতিপ্রেমী জুনিয়াও কোমর বেঁধে তাঁদের সঙ্গে সেই কাজে লেগে পড়েন।
ওই সময়ে প্রাচীন রেডউড গাছ কাটার বরাত পায় আমেরিকার নামজাদা ‘প্যাসিফিক লুম্বার কোম্পানি’। ক্লিয়ার-কাট-লগিং প্রকল্পের আওতায় তাঁদের এই কাজ দেওয়া হয়েছিল। যার প্রতিবাদে নামে জুলিয়াদের দল।
গাছ কাটা ঠেকানোর এই আন্দোলনের পদ্ধতিটি ছিল সরল। পরিবেশপ্রেমী সংগঠনটির সদস্যেরা গাছের মগডালে চড়ে বসতেন। ফলে সেটি কাটতে এলে ফিরে যেতে হত কর্মীদের।
এই মগডালে চড়ে গাছের প্রাণরক্ষাকারীদের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ট্রি সিটার’। তাঁদের পরিকল্পনা ছিল এক এক জন দু’দিন করে গাছে থাকবেন। তার পর তিনি নেমে এলে অন্য কেউ উঠবে ওই গাছে। এই ভাবে প্রাচীন গাছগুলিকে পাহারা দেওয়া হবে।
কিন্তু পরিবেশপ্রেমী সংগঠনের নেতা-নেত্রীদের ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ হয়নি। তাঁরা চেয়েছিলেন, অন্তত এক সপ্তাহ করে একজন একটি গাছে থাকুক। কেউই এগিয়ে না এলেও প্রস্তাব শোনার সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে যান জুলিয়া।
ট্রি সিটার হিসাবে গাছে ওঠার পর এক সপ্তাহে নীচে নেমে আসেননি বছর ২৩-এর ওই তরুণী। দু’বছরের বেশি মগডালেই কাটিয়ে দেন তিনি। যত ক্ষণ পর্যন্ত না গাছ কাটা রুখতে পারছেন, তত ক্ষণ মাথা ঝোঁকাতে রাজি ছিলেন না তিনি।
আমেরিকার সংবাদপত্রগুলির দাবি, গাছের উপর পাক্কা ৭৩৮ দিন ছিলেন জুলিয়া। আর সেটা ছিল হাজার বছরের প্রাচীন অতিকায় একটা রেডউড মহীরুহ। এলাকাবাসীরা আদর করে বনস্পতিটির নাম দিয়েছিলেন ‘লুনা’।
জুলিয়ার কাছে গাছের উপর দু’বছর কাটানো মোটেই সহজ ছিল না। এই সময়সীমার মধ্যে হেলিকপ্টারের হয়রানি সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। এ ছাড়া হাড়কাঁপানো শীত, মুষলধারার বৃষ্টি ও অসুস্থতা— কোনও কিছুই জুলিয়াকে দমাতে পারেনি। সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে গিয়েছেন তিনি।
অন্য দিকে জুলিয়া যে গাছে ছিলেন, সেটাকে কাটতে মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছে প্যাসিফিক লাম্বারও। সংস্থাটির নিরাপত্তারক্ষীরা মহীরুহটিকে ঘিরে রেখেছিলেন। গাছ কাটার দলও সেখানে পৌঁছে যান। নীচ থেকে ক্রমাগত জুলিয়াকে ভয় দেখাচ্ছিলেন তাঁরা। এই ভাবে টানা ১০ দিন চলার পর একরকম রণে ভঙ্গ দেন তাঁরা।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, একরকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যেই জুলিয়া বেঁচে ছিলেন। খালি পায়ে তাঁকে হাঁটাচলা করতে হত। দড়িতে বেঁধে নীচ থেকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী গাছের উপরে তুলে নিতেন তিনি। ছোট্ট একটি স্টোভে করতেন রান্না। নিজেকে গরম রাখার জন্য স্লিপিং ব্যাগ ব্যবহার করেছিলেন এই ‘গাছ-কন্যা’। বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সৌরশক্তিচালিত সেলুলার ফোন ব্যবহার করতেন জুলিয়া। মজা করে নিজেকে ‘বৃক্ষবাসী’ সংবাদদাতা বলে উল্লেখ করতেন তিনি।
এই ভাবে চলার পর অবশেষে আসে কাঙ্ক্ষিত জয়। সমস্ত আশা ছেড়ে দিয়ে লুনা-সহ অন্যান্য প্রাচীন রেডউড গাছ রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেয় প্যাসিফিক লাম্বার। এই মহীরুহগুলিকে ঘিরে ২০০ ফুটের বাফার জ়োন তৈরিতে রাজি হয়েছিল সংশ্লিষ্ট সংস্থা। সালটা ছিল ১৯৯৯।
প্যাসিফিক লাম্বার পুরোপুরি হার স্বীকার করার পরেই গাছ থেকে নেমে আসেন জুলিয়া। সেই সময়ে তাঁর পায়ে জুতো ছিল না। মাটিতে নামার পর তিনি কিছুটা টলছিলেন। তবে তত ক্ষণে খবরের শিরোনামে চলে এসেছেন জুলিয়া। পরে গাছপ্রেমী এই তরুণী জানিয়েছিলেন, বিশ্বে প্রাচীন বনাঞ্চলের মাত্র তিন শতাংশ অবশিষ্ট রয়েছে। আর সেগুলিকে রক্ষা করার জন্য পর্যাপ্ত যত্নের প্রয়োজন।
জুলিয়ার এই জয় সত্ত্বেও এক বছরের মধ্যেই লুনার উপর আঘাত নেমে এসেছিল। একটি চেইন-করাত দিয়ে প্রাচীন রেডউড গাছটিতে তিন ফুট গভীর গর্ত করা হয়েছিল। এর অর্ধেকের বেশি ডালপালা ছেঁটে ফেলা হয়। তবে শেষ পর্যন্ত লুনার জীবন রক্ষা করা গিয়েছিল। মহীরুহটিকে বাঁচাতে এক দিনের মধ্যে এটিকে ঘিরে ইস্পাতের রেলিং তৈরি করে দেওয়া হয়।
এই ঘটনা শোনার পর জুলিয়া ক্ষোভ উগরে দিয়েছিলেন। খবর পেয়েই দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছন তিনি। সেই ঘটনার ২০ বছর পর লুনা এখনও বেঁচে রয়েছে। এবং আরও অনেক বেশি সবুজ ও শক্তিশালী হয়েছে।
লুনাকে বাঁচাতে জুলিয়ার ‘ট্রি সিটার’ হওয়া ছিল একটা আন্দোলনের সূচনা মাত্র। পরবর্তী কালে দক্ষিণ আমেরিকার ইকুয়েডরে তেলের পাইপলাইন প্রকল্পের বিরোধিতা করেন তিনি। আন্দিজ পাহাড়ের বনাঞ্চল কেটে যা হওয়ার কথা ছিল।
এ ভাবেই ২০ শতকের গোড়ায় সমাজের সকলের চোখে নায়িকা হয়ে ওঠেন জুলিয়া। দরিদ্র পরিবারের একটা মেয়ে প্রকৃতিকে ভালবেসে কত দূর যেতে পারেন, তা প্রত্যক্ষ করেছিল গোটা দুনিয়া। তাঁকে নিয়ে একাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। যার মধ্যে ‘দ্য লিগেসি অফ লুনা’ অন্যতম।
সব ছবি: সংগৃহীত।