Art Exhibition

এক সূত্রে বেঁধে বেঁধে থাকা

প্রকৃতিগত ভাবে প্রতিটি মানুষই প্রাণবন্ত রঙের সমাহার। সেই অর্থে বিভিন্ন মেজাজের আনন্দ ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী শেখর রায় অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করেন।

Advertisement
পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫ ০৫:৪৮
বিড়লা অ্যাকাডেমি আয়োজিত বেঙ্গল আর্ট গ্রুপের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

বিড়লা অ্যাকাডেমি আয়োজিত বেঙ্গল আর্ট গ্রুপের প্রদর্শনীর চিত্রকর্ম।

সম্প্রতি বেঙ্গল আর্ট গ্রুপের নিবেদনে দ্বিতীয় প্রদর্শনী হয়ে গেল বিড়লা অ্যাকাডেমি অব আর্ট অ্যান্ড কালচারের তৃতীয় তলে। ন’জন শিল্পীযুক্ত শো-টির নাম ‘উই নাইন’। জন্মলগ্ন অনুসারে গ্রুপটির বয়স কম হলেও, স্বতন্ত্র ভাবে অংশগ্রহণকারীদের কাজের পরিচিতির বয়স কিছু কম নয়। প্রত্যেকেই নিজ নিজ সৃষ্টিতে যথেষ্ট সফল।

Advertisement

গ্রুপের অন্যতম বিশিষ্ট শিল্পী সমীর সরকারের ছবির মূল আলোচ্যবস্তু বন্ডেজ। ৮৪-৪৮ ইঞ্চি দীর্ঘ একটি ক্যানভাসে ভেঙে যাওয়া সম্পর্ককে ‘আয় বেঁধে বেঁধে রাখি’র আহ্বানে তৈরি হয়েছে ‘দ্য ফ্রেন্ডশিপ’। বাদামি বর্ণের সঙ্গে কিছু সম্পর্কিত রং ছাড়া, পেলব স্বচ্ছতায় আঁকড়ে ধরার প্রতিটি মুখভঙ্গিতে ‘হতাশা’ নামক মারণব্যাধি বহু দূরে সরে গিয়েছে। জলরঙের মতো পাতলা করে অ্যাক্রিলিক চাপানোর মতো টেক্সচারে শূন্যতা বলে কিছু নেই। গাঢ় পোশাকের অবয়ব ছাড়া, ব্যাকগ্রাউন্ড স্পেসে দেখা যায় মিনিয়েচার ঘেঁষা মূল ছবির উপপাদ্য। এ ছাড়া ফিগারে হেডগিয়ার অঙ্কনে মিশে গিয়েছে মিশরীয় উষ্ণীষের রাজকীয় স্টাইল— যা পাওয়া, না পাওয়ার প্রতীক হিসেবে রচিত।

প্রকৃতিগত ভাবে প্রতিটি মানুষই প্রাণবন্ত রঙের সমাহার। সেই অর্থে বিভিন্ন মেজাজের আনন্দ ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী শেখর রায় অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে উজ্জ্বল রং ব্যবহার করেন। ফ্ল্যাট টেকনিকে আলোছায়া রেখে আয়তাকার ক্যানভাসে প্রতিষ্ঠিত ছবিগুলি বাংলার বাদ্যযন্ত্র অলঙ্কারের পূর্ণাঙ্গ রসচিত্র। এই বিষয়ে শিল্পী জানান, বাড়িতে চর্চিত বাউল, কীর্তন, লোকসঙ্গীতের মধ্যে বেড়ে ওঠার ফলে ছবির প্রতিটি স্থান বাদ্যমুখর কলতানে সজ্জিত। সংঘর্ষজনিত রঙিন ফোকাসে রাজস্থানি ও দেহাতি গঠন মিশ্রিত নারীর নব্য ভঙ্গিমায় বৈষ্ণব পদাবলীর সুর তৈরি হয় অচিরেই।

ট্রাইবাল কিশোর-কিশোরী নিয়ে বিশেষ স্বাক্ষরিত নমুনায় সুব্রত দাসের সিরিজ় থাকলেও, চারটি ভিন্ন অভিব্যক্তি নিয়ে মুখের কাজ ছিল চোখে পড়ার মতো। সাম্প্রতিক ঘটনার মধ্য দিয়ে টিকে থাকার যে যন্ত্রণা, তাতে আমরা মানসিক ভাবে ব্লকড হয়ে যাচ্ছি। চতুর্দিকের মুখগুলি শয়তানের প্রতিচ্ছবির মতো ধেয়ে আসছে— সেই ভাবনা থেকেই ইয়েলো সারফেসে, ইমপ্যাস্টো স্টাইলে ফাটল তৈরির জোরালো প্রকাশে ছিলেন শিল্পী সুব্রত।

চিত্রকর্ম।

চিত্রকর্ম।

গোষ্ঠীর দুই ভাস্করের সৃষ্টির স্ফুরণ সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী। এতে নির্ণীত পেন্টিং-এর কিছুটা একপেশে স্টাইলের মাঝে দেখার রিলিফ তৈরি হয়। প্রথমেই আসি অসামান্য শিল্পী দেবব্রত দে-র নির্মাণের দিকে। মার্ক্সের আদর্শ মাথায় রেখে নির্মিত হয়েছে এক একটি ব্রোঞ্জের ঢালাই। ‘মাদারী, বাউল, চায়ের দোকান, অবসরে দুই রিকশাওয়ালার গল্প এবং ছাগলের পাল নিয়ে দিদির ঘরে ফেরা’ নিয়ে যায় অমূল্য অতীতের দিকে। ব্রোঞ্জের বডি ও উডের পরিচ্ছদ সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে দেয় ভাস্কর সুব্রত পালের গতি ও মায়ার গঠন। যেমন ‘দম্পতি যুগল, বেস্ট ফ্রেন্ড’ এ এক রকম মায়া, আবার গতির তির প্রকাশে ‘ফোর্স, ব্যালান্স বিটুইন লাভ, বিশেষত সার্ভাইভ’ কাজটির গাঠনিক ভারসাম্য সময়ের দলিল বলে চিহ্নিত হতে পারে।

কিউবিজ়ম স্টাইলে কমলা, সবুজ, হলুদ ও আল্ট্রামেরিন ব্লু-সরাসরি প্রকাশে শিল্পী ওম স্বামীর ‘স্প্লেন্ডার্স অব লভ’ এককথায় ফোক আর্টের ক্লাসিক সংস্করণ। গোটা প্রেমময় সিরিজ়ে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সিম্পলিফিকেশনের আবেশে শিল্পী ধরে রেখেছেন নির্ভরশীল সম্পর্কগুলিকে। জাতীয় ঘরানাকে আত্মস্থ করে বিশিষ্ট শিল্পী গৌতম মুখোপাধ্যায় তাঁর কাজকে চরম বনেদিয়ানায় নিয়ে গিয়েছেন। প্রয়োজন মতো আলোছায়া ব্যবহার করলেও, ছবিতে কোনও পারস্পেক্টিভ রাখার চেষ্টা করেননি। রাজস্থানি ঐতিহ্যের উপাদানে অলঙ্কৃত হয়েছে গৃহবধূ। বিশেষ রিদম নিয়ে আখ্যায়িত লক্ষ্মী, সরস্বতী, রাধার ডিটেলসের সমতায় শিল্পীর পরিশ্রম প্রশংসনীয়।

উত্তর আধুনিক যুগের কিউবিস্ট শিল্পের দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত জগন্নাথ পাল বিষয়গুলিকে সরলরেখায় আঁকেন। তাঁর কাজে নারীপুরুষের সম্পর্ক বিভিন্ন মেজাজের নাটকীয়তায় ফুটে ওঠে। ভিরিডিয়ান টেম্পারামেন্টে, কমলা, নীলের স্থায়ী আবেদনে আবৃত হয়েছে টুকরো টুকরো ফর্ম। লম্বা নাক, পুরু ঠোঁট ও মুদ্রিত চোখ গঠনে লক্ষ্য স্থির শিল্পী জগন্নাথের চিত্রপট স্বপ্নে হারিয়ে যাওয়া বিমূর্তায়নের এক একটি উপভোগ্য-শামিল। ভাস্কর রাও-এর গাছের বিষয় বস্তুগত হলেও, রঙের দিক থেকে অবচেতন মনের খেয়ালে সম্মিলিত হয়েছে জীবনের শিরা-উপশিরা।

প্রশস্ত গ্যালারির উক্ত সৃষ্টিকর্মগুলি ঝলকে যেটি ছড়িয়ে দেয়, তা হল চাক্ষুষ মুগ্ধতার দীর্ঘ রেশ। প্রত্যেকের কাজের ধারা ভিন্ন হলেও, কোথাও যেন গেঁথে যায়, ‘এক সূত্রে বাঁধিয়াছি’-র উপাস্য মন্ত্র।

Advertisement
আরও পড়ুন