ট্রিঙ্কাজ়ের সান্ধ্য মজলিস। ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।
সিংহাসনে অভিষেকের আগে রহস্যজনক ভাবে ‘ভ্যানিশ’ হবু রাজা শঙ্কর সিংহ। তাঁকে খুঁজতে আর কোথায় বা যেতেন ঝিন্দের ফৌজি সর্দার ধনঞ্জয় ক্ষেত্রী! এমনই বছরশেষের মরসুমে দক্ষিণ কলকাতার একটি ক্লাবে হারানো রাজকুমারকে দেখে বিগলিত তিনি। ঝিন্দের সেই রাজপুত্র কে, বা তার পরে কী ঘটেছিল— সে গল্প অনেকেরই জানা! তবে শরদিন্দু বা তপন সিংহের ‘ঝিন্দের বন্দী’র প্লটে কলকাতার চিরতরুণ বড়দিন বা বর্ষবরণের গরিমাও লেপ্টে আছে। সিনেমায় ঝিন্দের ফৌজি সর্দার স্পষ্ট বলছেন, “বড়দিনের সময়ে দেশের সব রাজারাজড়া কলকাতায় রেস আর পোলো খেলতে আসেন, তাই খুঁজতে খুঁজতে এখানেই চলে এলাম!”
ছবির দৃশ্যে রাজকীয় ক্লাব লাউঞ্জে টাই, ডিনার-জ্যাকেট খচিত প্রবীণ-নবীন সম্ভ্রান্ত সমাগম। বাঙালি, পাগড়িধারী সর্দার থেকে শ্বেতাঙ্গ সাহেব, মেমসাহেবরা হাঁ করে জমিদার গৌরীশঙ্কর রায় ওরফে উত্তমকুমারের নিপুণ তরোয়াল চালনা দেখছেন। গোয়ালিয়ারের উস্তাদ থেকে ইটালিয়ান অসি বিশারদের কাছে জমিদার নন্দনের অস্ত্রশিক্ষার কথাও ফলাও করে বলেছেন শরদিন্দু।
১০০ বছর বা তারও আগের কলকাতার বর্ষশেষ মানে এমনই শৌর্যময় এক ঋতু। সে যুগে তামাম ভারতবর্ষ থেকে বিলেত পর্যন্ত কাঁপানো এক রাজপুত্তুর, রাজকন্যের জমকালো প্রেমকাহিনি জুড়েও কলকাতার সাতরঙা শীতের উত্তাপ। বরোদার রাজকুমারী ইন্দিরা রাজেকে পটাতে ‘কুচবিহারের রাজপুত্তুর’ তথা কেশবচন্দ্র সেনের দৌহিত্র জিতেন্দ্র নারায়ণ কলকাতার ক্রিসমাসের লোভ দেখাচ্ছেন। ইন্দিরার মা, বাবাকে লুকিয়ে ঠিকানায় বিলিতি ছদ্মনাম লিখে গোপন চিঠি পাঠাতেন স্মার্ট সুপুরুষ জিতেন্দ্র। তার ছত্রে ছত্রে কল্লোলিনীর জমকালো সব পার্টি, ফ্যান্সি ড্রেস, বল ডান্সের আসর, কুলীন পোলো খেলুড়েদের মরসুমি আবির্ভাব আর ক্রিকেট ম্যাচের সাতকাহন। যেন রাজপুত্র নয়, কলকাতার প্রেমেই বাঁধা পড়তে চলেছেন বরোদার রাজকন্যে। ইন্দিরা-কন্যা, ভাবীকালের জয়পুরের মহারানি গায়ত্রী দেবী বহু বছর বাদে তাঁর স্বর্গগত মা, বাবার চিঠিতে এই কলকাতা-কাহিনির ফিরিস্তি পড়ে আপন মনে হেসেছিলেন খুব।
জয়পুরের মহারাজের সঙ্গে গায়ত্রীর নিজের প্রেমপর্বও শীতের কলকাতায় আলিপুর, ফার্পোজ়, পোলো মাঠের গ্যালারিতে বিকশিত। বয়সে তাঁর থেকে এক যুগের ছোট কলকাতা-কন্যা রোমা ভগতও আজ সে-কলকাতার কথায় উদ্বেল হয়ে ওঠেন। “ওহ ইট ওয়াজ় রিয়েলি গ্ল্যামারাস টু ডু ক্রিসমাস ইন ক্যালকাটা।” রডন স্ট্রিটের বাড়িতে বসে কবেকার স্মৃতির টানে মধ্যাহ্নভোজের বেলা বয়ে যায় ৯৪ বছরের তরুণীর।
মিলিয়নেয়ার্স ওয়েদার
প্যাচপেচে গরমে কলকাতা ছেড়ে দার্জিলিং, মুসৌরি বা কাশ্মীর পালাতে মরিয়া হয়ে ওঠা রেস্তদাররাই তখন শীতের শহরে ফিরতে মুখিয়ে থাকতেন। রেলের প্রবাদপ্রতিম ইঞ্জিনিয়ার বিআর সিংহের নাতনি রোমা-ও কলকাতার শীতকে ‘মিলিয়নেয়ার্স ওয়েদার’ বলেন। যেমনটির খোঁজে তাবড় বিত্তবানেরা আজ ফ্লোরিডার সাগরতটে গিয়ে ঘাঁটি গাড়েন। বিশ শতকের গোড়ার সেই কলকাতায় দেশের রাজধানী দিল্লিতে সরে যেতে পারে! তবু বড়লাটের শীতকালীন রিচুয়ালের নির্ঘণ্টে অপরিহার্য কলকাতা-সফর। আলিপুরের বেলভেডেয়ার এস্টেটে (আজ যেখানে ন্যাশনাল লাইব্রেরি) শীতের অন্তত দু’টি সপ্তাহ না-কাটালে লাটসাহেবের পেটের স্টেক, পুডিং হজম হত না!
কলকাতার রমণীয় শীতের কাঁপনটুকুর রাজযোটক ছিল ইন্ডিয়ান পোলো অ্যাসোসিয়েশন চ্যাম্পিয়নশিপ কাপের আসরও। রোমার মনে আছে, মাথা খারাপ করার মতো হ্যান্ডসাম রইস বড়ঘরের পোলো খেলোয়াড়েরা রাতভর ‘ফার্পোজ়’-এর পার্টিতে মাততেন। তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রাক-পর্বে দুনিয়া বা দেশ কাঁপানো ঐতিহাসিক পট বদলের আবহে কলকাতা জ্বললে শীতের বড়লোকি আমেজে সামান্য ছন্দপতন ঘটে। বেঙ্গল ক্লাবের ভোগ-বিলাস ধাক্কা খেয়েছিল। যুদ্ধের বাজারে চিনির রসদে টান পড়ায় পুডিং, আইসক্রিম, কেক, সুইট মিনারেল ওয়াটার, কর্ডিয়ালের উৎপাদন সীমিত বলে ফিরপো কর্তৃপক্ষও মেনুকার্ডে দুঃখপ্রকাশ করেছেন।
আলিপুরে বেলভেডেয়ার এস্টেটের অন্তরঙ্গ ডিনারে এ দেশের কতিপয় রাজন্য বর্গ বিলিতি প্রভুর সান্নিধ্য পেয়েছেন। তবে স্বাধীন দেশেও দীর্ঘ দিন বেঙ্গল ক্লাব, টলি ক্লাবে বাদামি সাহেবদের প্রবেশাধিকার ছিল না। বৈষম্যের এই ক্ষোভ বুকে নিয়েই বড়দিনের ফুর্তির হাতছানি বঙ্গ হৃদয়ে পাকাপোক্ত বসত গড়ে তুলেছে।
ক্লাব-কাহিনি
রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি— কথাটা বেঙ্গল ক্লাবের বিষয়েও বলা যায়। প্রিন্স দ্বারকানাথ, প্রসন্নকুমার ঠাকুরেরা ভারতীয় বলেই সেখানকার সদস্যপদ পাননি। জনৈক ব্রিটিশ সাংবাদিকের ডাকে আসা তরুণ মোহনদাস কর্মচন্দ গান্ধীকেও লাউঞ্জে বসতে দেওয়া হয়নি। লজ্জিত আমন্ত্রণকর্তা ওঁকে ক্লাবে নিজের বেডরুমে নিয়ে গিয়ে বসান।
বেঙ্গল ক্লাবের জবাব হিসেবে স্যর আর এন মুকুজ্জেদের ক্যালকাটা ক্লাব পত্তনের ইতিহাস সুবিদিত। তবে স্যর বীরেন, লেডি রাণুর ভাগ্নির বৌমা, সমীর মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী অনিতার মনে পড়ে, ১৯৬০-এর দশকে ক্যালকাটা ক্লাবেও মহিলাদের সামনের ফটক দিয়ে ঢোকা দস্তুর ছিল না। বেঙ্গল পটারি খ্যাত গোপালকৃষ্ণ ভগতের জায়া ত্রিকালদর্শী ক্যালকাটান রোমা ভগত এখন হাসেন, ১৯৫০-এর দশকের টলি ক্লাবের বারে জার্মান ইহুদি বান্ধবীর সঙ্গে ঢুকলে ভারতীয় নারীকে দেখে সাহেবরা ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিল। আমেরিকান কনসুলেটের আধিকারিকের স্ত্রী আর এক বন্ধুর সঙ্গে বেঙ্গল ক্লাবে ঢুকেও বাধার মুখে পড়তে হয় রোমাকে। ডাইনিং রুম ছেড়ে পাশের দালানে সরতে হলেও মার্কিন বন্ধুটি টরটরিয়ে ক্লাবকে অনেক কথা শুনিয়েছিলেন। তবু শ্বেতাঙ্গ অধ্যুষিত ক্লাব কালচার মানেই আড়ষ্ট আনুষ্ঠানিকতা নয়। স্যাটারডে ক্লাব বা থিয়েটার রোডের নিশিঠেক থ্রি হান্ড্রেড ক্লাবের নিষিদ্ধ নষ্টামিরও নামডাক ছিল। রোমা-ই নিউ মার্কেটের কাছের বহু দিন বিস্মৃত ‘গোল্ডেন স্লিপার্স’-এর গল্প শোনালেন! ‘উইকেড প্লেস’ আখ্যাপ্রাপ্ত সেই নিশি-নিলয়ে বরের সঙ্গে জেদ করেই ঢুকেছিলেন। দেখেন, সুউচ্চ বার কাউন্টারে উঠে তখনকার এক নামজাদা ব্রিটিশ জকি ফ্রেঞ্চ ক্যান-ক্যানে মাতোয়ারা। নাচের উপযুক্ত স্কার্টের অভাবে ভদ্রলোক কোমরে টেবল ক্লথ বেঁধেই হিল্লোল তুলছেন। ঘরভর্তি উল্লাসের মত্ততায় কানফান লাল রোমার!
তাঁহার কালের স্বাদগন্ধ
এ শহরের একটি গণস্মৃতি পুনরুদ্ধার প্রকল্প ট্রিঙ্কাজ় টাইমলাইন প্রজেক্টের সৌজন্যে সে কালের ট্রিঙ্কাজ়ের মর্নিং কফি কনসার্ট, লাঞ্চ কনসার্ট বা রেস্তরাঁয় কর্মরত সুইস কনফেকশনারের গল্প শুনতে পাই আজ। একটি অনলাইন নিলামের পোর্টালে দেখি পুজোর শারদ অর্ঘ্যের ধাঁচে ৪৫ আরপিএমের চাকতিতে ১৯৭৪-এর বাছাই পপ, রক, কান্ট্রি, ক্লাসিক। এইচএমভির ক্রিসমাস রিলিজ়। ফ্লুরিজ়, ট্রিঙ্কাজ় বা বেঙ্গল ক্লাব, ক্যালকাটা ক্লাবের ভোজ-বিলাস টিকে থাকলেও কালম্যানের নিজস্ব শৈলীর কোল্ডকাট বৈচিত্র না পেয়ে জীবন শূন্য লাগে।
ঐতিহ্যশালী ক্লাবের বছরশেষের পার্টিতে অর্বাচীন হিন্দি গানের অনুপ্রবেশ নিয়ে বিতর্ক বা গাম্ভীর্যমণ্ডিত কালো বো টাইয়ের বাড়াবাড়ি নিয়ে হাসাহাসিও আজ বঙ্গ জীবনের অঙ্গ। সেই ব্লু ফক্স, গানবাজনা নেই। রিপন স্ট্রিটের টমাস গডউইনের সূত্র খোঁজা খানিক কঠিন হয়েছে ফেলুদার জন্য। তবু পার্ক স্ট্রিটের আর্মেনিয়ান ক্লাবে পিকনিক গার্ডেনের ডেনিস অ্যান্টনির ঝালফ্রেজ়ি, বল কারি, কেক, ওয়াইনে শহরের পর্ক অ্যাডিক্টদের পিগমাস পার্টি অনেকগুলো যুগকে সজীব করে তোলে। প্রবাসী অপ্রবাসী বাঙালি, গুজরাতি, জার্মান, ইটালিয়ান পর্কপ্রেমীদের ভোজসভায় টেরিটিবাজারের জরাগ্রস্ত চিনা গির্জাও হঠাৎ তরুণী হয়ে ওঠে।
শীতযাপনে বাদামি, সফেদ সাহেবসুবোদের প্রত্যাবর্তনের এক অন্য অ্যাকশন রিপ্লেও চোখে পড়ে যায়। খবর পাই, টরন্টো থেকে ফিরে বন্ধ কারখানায় রেস্তরাঁ খোলার স্বপ্ন দেখছেন ট্যাংরার চিনা কন্যা। টিভোলি কোর্টের একা ফ্ল্যাটে অশীতিপর অনিতা মাসিমা দেখেন, তাঁদের বহু যুগ আগের কলকাতাবাসী ইটালিয়ান বন্ধু স্যালির নাতনি সোফিয়াও ঠিকানা খুঁজে সৌজন্য সাক্ষাতে হাজির। শীতের রোদ্দুরে তখন সোনালি ফাল্গুনের ছোঁয়াচ।
মডেল: জ্যোতির্ময়ী কুণ্ডু; ছবি: সায়ন্তন দত্ত; মেকআপ: দীপক শাহ; স্টাইলিং: তানিয়া দাস; পোশাক: ল্যাটিন কোয়ার্টারস, সাউথ সিটি মল; লোকেশন ও হসপিটালিটি:ফ্লুরিজ়, পার্ক স্ট্রিট