পরেশ মাইতি।
জলের শব্দ শোনা যায় তাঁর ছবি দেখে। দুষ্টু লোকেরা বলতে পারেন, এতে আর আশ্চর্য হওয়ার কী আছে!
জলছবি বা ওয়াটার কালার অনেকটা একচক্ষু হরিণের মতো। সারা পৃথিবীতে অধিকাংশ জলছবি হয় জল আর নৌকা নিয়ে। পরেশ মাইতি খুব বেশি ব্যতিক্রম নন। যদিও এক-একটি হলুদ ট্যাক্সি দেখা যায় পরেশের পৃথিবীতে। কখনও ভেসে যায় ভেনিসের গন্ডোলা, কখনও দেখা দেয় কাশীর ঘাট। বিদেশি নদীর ধারের ছোট ছোট গল্পও ফুটে ওটে জলরঙে।
পরেশের পৃথিবী কিন্তু ভেনিস নয়। কাশীও নয়। নানা পর্বতমালা, সিন্ধু দেখেছেন তিনি। তবে ঘরের কাছের শিশিরবিন্দুটিই এখনও তাঁর জগৎ।
গোটা বিশ্ব ঘুরেছেন পরেশ। ২৭ বার ভেনিস গিয়েছেন। লন্ডন বুঝি তারও বেশি। গত ৩১ বছর ধরে দিল্লিতেই সংসার। সে শহরই এখন পরেশের ঘরবাড়ি। তবু কিছু দিন অন্তর ফিরে যান তমলুকে। সেখানে তাঁর বড় হওয়া। সেখানেই ঘটেছে প্রথম অনেক কিছু। মানসিক ভাবে এখনও যেন সেই তমলুকেরই বাসিন্দা তিনি।
মা আছেন তমলুকে। রয়েছে বাকি পরিবারও। সেটাই কি টানে শুধু? শিল্পী জানান, তমলুকের নিজস্ব টান আছে। গোটা জগতের শত চাকচিক্য তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না। বলেন, ‘‘তমলুকে ফিরে যাই শিল্পের জন্যেও। সেখানেই তো শুরু। সেই শহর থেকেই কত কিছু শেখা। প্রায় সবটাই পাওয়া।’’ কলকাতায় ৪০ বছরের কাজ নিয়ে প্রদর্শনী শুরু হলে সেখানেও থাকে মেদিনীপুরের স্পর্শ। তমলুক থেকে প্রদর্শনীতে আসেন পরেশের মা আর বোন। শীত-শুরুর সিমা গ্যালারিতে বাস্তব আর শিল্পের সঙ্গে যোগাযোগ দেখা যায়।
কাজ শেখা শুরু করেছিলেন মেদিনীপুরের শিল্পীদের দেখেই। পরেশ বলছিলেন, ‘‘আমার বাড়ির পাশেই একটা পাড়ায় প্রতিমা বানানো হয়। ছোটবেলায় দুর্গাপুজোর আগে সেই কাজ দেখতে যেতাম। সেখানেই মাটির পুতুল বানানো শিখি। সেখান থেকেই এই পথে চলার শুরু।’’
আঁকা শিখতেন না তিনি তমলুকে? আঁকা শেখা শুরু হয়েছে পরে। তা-ও সে ভাবে নয়। হ্যামিলটন হাইস্কুলে পড়ার সময়ে আঁকার মাস্টারমশাই যতটুকু দেখাতেন, তা থেকেই হয়েছে পেন্সিল-তুলি ধরার শিক্ষা। পরেশ বলেন, ‘‘তার চেয়েও অনেক বেশি শেখা হয়েছে পরিবেশ ও প্রকৃতি থেকে। চারপাশে যা দেখতাম, তা-ই মাটি দিয়ে বানানোর চেষ্টা করতাম। সেই মাটির পুতুল মেলায় বিক্রিও করতাম।’’ এখনও প্রতি পুজোয় সেখানে যাওয়ার চেষ্টা করেন খ্যাতনামা শিল্পী। পুজোর আগে বাড়ির পাশে প্রতিমা গড়া দেখতে এখনও ভাল লাগে। স্ত্রী-পুত্র সকলকে সে সব কাজ দেখাতেও ইচ্ছা করে।
শুরু তো এ ভাবে অনেকেরই হয়। কিন্তু সে জায়গার কথা মনে রাখেন ক’জন? প্রয়োজনই বা হয় কত? লন্ডন-প্যারিস দেখে অনুপ্রেরণা পাওয়ার সুযোগ আছে যে শিল্পীর, তিনি কেনই বা মেদিনীপুরে ফিরে ফিরে যাবেন? তা-ও নাকি বছরে বেশ কয়েক বার!
কারণ পরেশ যেখানেই যান, যা-ই দেখেন, ছবি আঁকেন সেই তমলুকেরই। নানা ছবিতে বুঝিয়ে দেন, তমলুকে যে শিল্পচেতনা বাড়তে শুরু করেছিল তাঁর অন্তরে, তা-ই আরও সমৃদ্ধ হয়েছে বৃহত্তর সমাজে গিয়ে। তাই বার বার জলের কথা ফিরেও আসে তাঁর ছবিতে। তিনি বলেন, ‘‘আমার দেশের বাড়ির চারপাশে অনেক খাল-বিল-নদী আছে। সে সবের মধ্যেই বড় হয়েছি। নৌকা ভেসে যাওয়া দেখতে ভাল লাগত। এখনও লাগে। এখনও বাড়ি গেলে দেখি জলের ধারে বসে। আর যে সব ছবি মনে দাগ কাটে, তা-ই তো ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করি।’’
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পরেশ কখনও পৌঁছে যান অন্য কোনও নদীর ধারে। কিন্তু মিসিসিপি, টেমস, ভোল্গার পাড়ে বসে যে সব ছবি আঁকেন তিনি, তা-ও সেই রূপনারায়ণ কিংবা গঙ্গার কথাই ধরে রাখে।
যে কোনও নদী, শহর, সভ্যতার মাঝেই নিজের মতো করে তমলুক খুঁজে পান পরেশ। তা সে ২০০৫ সালের ‘ইয়েলো রিভার’ হোক কিংবা ১৯৮৯ সালে ‘কোচিন হার্বার’— মেদিনীপুরের নদীর ধারের ঝলক ঠিকই ধরা থাকে সে সব ছবিতে। নিজের মাটির সঙ্গে যোগাযোগ থেকে যায় শিল্পীর।