সিমা গ্যালারিতে শুরু হল পরেশ মাইতির নতুন প্রদর্শনী ‘ইনফিনিট লাইট’। নিজস্ব চিত্র।
আলোর নানা রূপ থাকে। থাকে বর্ণ। সময়ের সঙ্গে বদলে যায় আলোর মাধুর্য। ভোরের আলো কোমল রঙা, তার আবেদন এক প্রকার। মধ্যাহ্নের রোদ অন্য রঙের আশা দেখায়। গোধূলির রং আবার কারও মনে মায়া ছড়ায়। আলোর রং, আলোর আবেদন নানা প্রান্তে নানা ভাবে ছড়িয়ে যায়। সে আলোর মানে বদলাতে থাকে। বিভিন্ন জনের উপর প্রভাব পড়ে ভিন্ন ধরনের। আর সে সব কখনও কখনও ধরা পড়ে কোনও শিল্পে। শিল্পীর চোখে ধরা পড়া আলোর নানা রূপ এ বার দেখা যাবে দক্ষিণ কলকাতার সিমা গ্যালারিতে। কখনও ক্যানভাসে, কখনও সেরামিকের উপর কাজে, কখনও আবার ভাস্কর্যে। পরেশ মাইতির নতুন প্রদর্শনী ‘ইনফিনিট লাইট’ এমনই প্রতিশ্রুতি নিয়ে হাজির হয়েছে শহরে। সোমবার সন্ধ্যায় হল তারই সূচনা। আনন্দবাজার অনলাইনকে প্রদর্শনী ঘুরিয়ে দেখাতে দেখাতে শিল্পী বললেন, ‘‘অনেকেই আমার তৈরি জল রং দেখে অভ্যস্ত। তবে আমি অন্য মাধ্যমেও সমান ভাবে কাজ করি। এই প্রদর্শনীতে নানা ধরনের কাজ রাখা হয়েছে।’’ তবে রকমারি মাধ্যম একসঙ্গে দেখানোই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। দিক-দিগন্তে ছড়িয়ে পড়া আলো আর তার আভা একসঙ্গে ফুটিয়ে তুলতেই পাশাপাশি স্থান পেয়েছে নানা মাধ্যম ব্যবহার করে তৈরি হওয়া শিল্প। পরেশবাবুর জন্ম পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে। সেখানেই কাজ শেখা শুরু। সপ্তম শ্রেণি থেকে শিল্পের মধ্যেই বিচরণ। তার পর ঘুরেছেন গোটা বিশ্ব। ভেনিস থেকে বারাণসী— সবই তাঁর আপন। শিল্পী বলেন, ‘‘গোটা বিশ্বই আমার ঘরবাড়ি। আমি তমলুকে জন্মেছি। দিল্লিতে অনেকটা সময় কাজ করি। কিন্তু তার মানে এমন নয় যে, অন্য শহর আমার নিজের নয়। মনে মনে আমি গোটা বিশ্বের নাগরিক। এক এক জায়গার এক এক রকম রূপ। সবটাই আমাকে টানে। ছবি আঁকতে অনুপ্রেরণা জোগায়।’’ আর সে ভাবনার সবটা তুলে ধরছে সিমা গ্যালারিতে প্রদর্শিত নানা শিল্পকর্ম।
এক পেন্টিং থেকে এক ভাস্কর্য পেরিয়ে তিনটি ড্রয়িংয়ের সামনে গিয়ে থামেন পরেশবাবু। পর পর তিনটি ফ্রেম। গঙ্গা। নানা ধাপে। পাশের দেওয়ালটি জুড়ে রয়েছে বারাণসীর ঘাট। ক্যানভাসের উপর তেল রং। ঘাটের দিকে তাকিয়ে শিল্পী বলেন, ‘‘বারাণসীর ঘাটে এক এক বেলায় এক এক রকম আলো দেখা যায়। তাতেই যেন বদলে যায় গোটা এলাকার চেহারা।’’ সঙ্গে নতুন নতুন রং পায় গঙ্গা। কিন্তু গঙ্গা দেখতে হলে তার উৎপত্তির কথাও ভাবতে হবে। সে গল্প ধরে রেখে পাশের দেওয়ালের তিনটি ড্রয়িং। পাহাড় ভেঙে নেমে আসছে নদী। সেখানকার জলে আলো পড়লেই তার রং, মেজাজ আবার আলাদা।
‘ইনফিনিট লাইট’ এ ভাবেই ব্যাপ্তির কথা বলে। সংযোগের গুরুত্ব তুলে ধরে। আর তারই সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যেন প্রদর্শনীর পরিকল্পনাও করা হয়েছে। শিল্পী নিজেই জানালেন, এ দেশের কোনও শিল্পীর সবচেয়ে বড় একক প্রদর্শনী এটি। টানা পাঁচ মাস ধরে চলছে প্রদর্শনী। দেখানো হচ্ছে দেশের চার চারটি শহরে। দিল্লি, মুম্বই, কলকাতা এবং বেঙ্গালুরু মিলিয়ে দেখানো হচ্ছে মোট ৪৫০টি শিল্পকর্ম।
গত ৩২ বছর ধরে নানা ধরনের শিল্পচর্চা করছেন পরেশবাবু। এই প্রদর্শনীতে রয়েছে শিল্পীর পথ চলার শুরুর সময়ের নানা কাজ। আবার একসঙ্গেই জায়গা করে নিয়েছে সাম্প্রতিক বিভিন্ন ড্রয়িং। শিল্পী জানান, প্রতিটি শহরের জন্য আলাদা ভাবে বাছাই করা হয়েছে সব কাজ। তিনি বলেন, ‘‘সামগ্রিক ভাবনা এক হলেও, প্রতিটি শহরের নিজস্ব মেজাজ আছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাজানো হয়েছে এক একটি শহরের গ্যালারি।’’ এই কাজে পরেশবাবুকে সঙ্গ দিয়েছেন রঞ্জিত হসকোটে। সিমা গ্যালারির তরফে অধিকর্তা রাখী সরকার জানান, কলকাতায় ‘ইনফিনিট লাইট’-এর যে অংশ দেখানো হচ্ছে, তাতে প্রাধান্য পেয়েছে বারাণসীকেন্দ্রিক কাজ। তিনি বলেন, ‘‘প্রাচীন ওই শহর পরেশের খুব আপন। বারাণসীর নানা রং ওঁর কাজে বিভিন্ন ভাবে ফুটে উঠেছে। জীবনের চরম সত্যের সন্ধানের চেষ্টা যেন দেখতে পাওয়া যায় সে সব কাজে।’’
শিল্পীর গত ৩২ বছরের যাত্রার নানা মোড়ে এক এক রূপে ফুটে উঠেছে আলো। তার ছটা ছড়িয়ে পড়েছে গ্যালারির নানা কোণে। অসীমকে নিজের মতো করে ফুটিয়ে তোলার সেই প্রদর্শনী চলবে ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত। প্রতি মঙ্গলবার থেকে শনিবার বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টার মধ্যে পৌঁছে গেলেই হল। সোমবার গ্যালারি খোলা থাকে বিকেল ৩টে থেকে।