The Defeated

পরাজিতের পক্ষে গান-গল্প-কথা, শীর্ষেন্দু-স্বপ্নময়-জয়ের কথায় সমাজে উপেক্ষিতদের জয়ধ্বনি

প্রতিটি হেরে যাওয়ার পর অনিবার্য ভাবে মানুষ জিতে যায়, এই হাল না ছাড়াগুলি থেকে যায় কথায়-গানে-গল্পে। জিততে চাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা যখন এই সময়ের অসুখ, তখন এই পরাজিত মানুষেরাই আশ্বাস দেন।

Advertisement
আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৫ ১৮:৩৪
Kolkata based intellectuals celebrate the theme of the defeated in various forms

‘পরাজিতের পক্ষে’ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী এবং জয় গোস্বামী। —নিজস্ব চিত্র।

‘শেষ জয়ে যেন হয় সে বিজয়ী/ তোমারি কাছেতে হারিয়া।’

Advertisement

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের পংক্তি উচ্চারণ করে উঠলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। সমাজের পরাজিত, উপেক্ষিতদের পক্ষে কথা বলার সময়ে বড় আশ্রয় শেষ পর্যন্ত রবি ঠাকুরই। সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের পাশে আর এক সাহিত্যিক স্বপ্নময় চক্রবর্তী, তাঁর পাশে কবি জয় গোস্বামী। ত্রয়ী বসে আছেন মঞ্চে। আলোচনা চলছে পরাজিতদের নিয়ে। কলকাতায় আয়োজিত এই সভার বক্তব্যের বিষয়, ‘কলম পরাজিতের পক্ষে’।

কারা এই পরাজিতেরা? যাঁরা সমাজে শ্রেষ্ঠ আসন পাননি? যাঁরা বড় বড় সংস্থায় উচ্চপদে চাকরিরত নন? যাঁরা প্রেমে অসফল? যাঁরা মস্ত গাড়িতে চেপে বড় হোটেলে খেতে যেতে পারেন না? যাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়? সমাজে তো তাঁরা উপেক্ষিতই। কিন্তু তাঁরা কি আদৌ পরাজিত?

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় সেই মানুষদের কথাই তুলে আনলেন সভায়। রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে যখন এই উপেক্ষিত মানুষদের দিকে চোখ পড়ত, তখন তাঁর মনে হত, প্রত্যেক দিনের ভাত জোগানোটাই তো আসল এঁদের কাছে। পেট ভরলেই তাঁরা ভাবেন, ‘‘এই তো বেশ আছি।’’ উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভেসে যান না। আর তাই হেরে যাওয়ার অবকাশও তৈরি হয় না। লেখকের প্রশ্ন, ‘‘কিন্তু যাঁরা আমলা হতে চান? যাঁরা দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে চান? সবার কি স্বপ্নপূরণ হয়? তাঁদের জীবনে তো হতাশা বেশি। হেরে যাওয়ার বোধ বেশি। উচ্চাশা যতটা, ততটাই পরাজয়ের অনুভব।’’

রবি ঠাকুরের পংক্তি দিয়েই শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন, জয়-পরাজয়, সাফলতা ও নিষ্ফলতা অত সহজে চিহ্নিত করা যায় না। একই ভাবে স্বপ্নময় চক্রবর্তীর সোজাসাপটা কথা, ‘‘পরাজয় তো জয়েরই একটা অংশ। জয় এবং পরাজয় একে অপরের বিপরীতার্থক শব্দ নয়।’’ আবার জয় গোস্বামী আপাত ভাবে ‘পরাজিত’ এমন দুই মানুষের কথা বললেন, যাঁদের অবদান তাঁর কবিজীবনে অনঃস্বীকার্য। তিন সাহিত্যিকের কলমে যেমন ভাবে বার বার পরাজিতদের কাহিনি উঠে এসেছে, তেমনই এ দিনের আলোচনাতেও উপেক্ষিতদের জিতিয়ে দিলেন ত্রয়ী।

Kolkata based intellectuals celebrate the theme of the defeated in various forms

উৎসবের উদ্বোধনে সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী এবং কবি জয় গোস্বামী। —নিজস্ব চিত্র।

শীর্ষেন্দু বলছেন, ‘‘পৃথিবীতে হেরো মানুষের সংখ্যাই বেশি। তাই আমি লেখার সময়ে তাঁদের নিয়েই লিখতাম, তাঁদেরই জিতিয়ে দিতাম। আর আমিও তাঁদেরই দলে। দৌড়ে গিয়েছে সকলের মতো। কিন্তু আমার আগে তো আরও কত মানুষ প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, তাঁরাও তো দৌড়ে চলেছেন। সবাই কি আর জেতেন? আজ ভাবি, সবাই জিতে গেলে, পৃথিবী চলত কী ভাবে?’’

স্বপ্নময়ের কথায় উঠে এল গ্রিক ট্র্যাজেডির নায়কদের কথা। তারাও এই পরাজিতদেরই দলে। যাদের গল্পে জয় নেই। যে বেদনার আখ্যানগুলিই মানুষের প্রিয়। তাদের হেরে যাওয়ার সঙ্গেই একাত্ম হতে পারেন দর্শক থেকে পাঠকেরা। আর এখানেই জিতে যায় হ্যামলেট থেকে ম্যাকবেথ। আনন্দজনক পরাজয়ই তো ট্র্যাজেডির মূল কথা।

জয় গোস্বামী তাঁর কবিতায়, উপন্যাসে বা গল্পে যে ভাবে ম্লান চরিত্রদের উজ্জ্বল করে তোলেন, সেই কথার সূত্র ধরেই উঠে আসে এমন দু’জন মানুষের কথা, যেই দুই মানুষকে সমাজ চেনে না, নাম জানে না। তাঁরা হয়তো পরাজিতদেরই দলে। দু’জনই সঙ্গীতগুণী। প্রথম জন প্রকাণ্ড বাড়ির এক মাত্র বাসিন্দা এক মহিলা, দ্বিতীয় জন বিবাহ বাসরের সানাইবাদক। দু’জনেই জানেন, তাঁদের সঙ্গীত কারও কানে পৌঁছোচ্ছে না, তাঁরা উপেক্ষিত। কিন্তু জয় গোস্বামী তাঁদের সঙ্গীতের গুণমুগ্ধ। কবি মনে করেন, সমস্ত শিল্পের জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজনের আড়ালে থেকে যাঁরা নির্জনে সাধনা করে চলেন, তাঁরাই আসলে জয়ী।

প্রতিটি হেরে যাওয়ার পর অনিবার্য ভাবে মানুষ জিতে যায়, এই হাল না ছাড়াগুলি থেকে যায় কথায়-গানে-গল্পে। জিততে চাওয়ার প্রবল আকাঙ্ক্ষা যখন এই সময়ের অসুখ, তখন এই পরাজিত মানুষেরাই আশ্বাস দেন। তাঁদের নির্লিপ্তি আসলে হার-জিতের ঊর্ধ্বে।

শহর কলকাতায় তিন দিনব্যাপী উৎসবের মুখ্য চরিত্রে ‘হেরে যাওয়া’ মানুষেরা। কলকাতা সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভিটি (কেসিসি)-র আয়োজনে ১১ এপ্রিল থেকে শুরু হল সাংস্কৃতিক পার্বণ, ‘বৈঠকখানা’। এই নিয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পা। অনুষ্ঠানের থিম ‘হেরো’। প্রথম দিন সূচনা ভাষণের পর উৎসবের উদ্বোধন করেন সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী এবং কবি জয় গোস্বামী।

১২ এপ্রিল কেসিসি বৈঠকখানায় বেশ কিছু বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের পরাজয়ের চিঠি পাঠ করলেন অনির্বাণ ভট্টাচার্য এবং স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায়। ১৩ এপ্রিল, শেষ দিন ‘পরাজিতের গান’ গাইবেন কবীর সুমন। এ ছাড়া অন্যান্য আলোচনায় অংশগ্রহণ করবেন নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী, দেবশঙ্কর হালদার, শ্রীজাত, অভীক মজুমদারের মতো বিশিষ্ট জনেরা। দেবদাস থেকে দ্রৌপদী, মেঘনাদ থেকে কর্ণ, এমনই কয়েকটি চরিত্রের কথা উঠে আসবে বাকি দিনে, যাঁরা পরাজিত হয়েও চিরজীবী।

Advertisement
আরও পড়ুন