International Women's Day 2023

জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি আসছে পুরুষদের জন্য! লিঙ্গের বিভেদ ঘুচিয়ে এমন সাম্য চান তো তাঁরা?

কোনও বিষয়কে কি 'মেয়েলি' বলে দাগিয়ে দেওয়া যায়? পেশা কিংবা শিল্প, নারী এবং পুরুষ কি হাত ধরাধরি করে চলতে পারে না? নারী দিবসে এমন কিছু প্রশ্নের উত্তর খুঁজল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement
অঙ্কিতা দাশ
শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২৩ ১০:০২
Symbolic image of contraceptive pill

জন্মরোধ করার দায় কি শুধু জন্মদাত্রীর? সময় এসেছে ভেবে দেখার। গ্রাফিক- সৌভিক দেবনাথ

‘লেডিস ফার্স্ট’, ‘লেডিস সিট’, ‘মেয়েদের আইপিএল’, ‘লেডিস কোটা’ বা ‘লেডিস কামরা’— চারদিকে শুধুই মেয়েদের জয়জয়কার। তা সত্ত্বেও নারী দিবস নিয়ে এত আদিখ্যেতা কেন? সমানাধিকার, ক্ষমতায়ণ এবং লিঙ্গসাম্যের কথা বললেও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নির্ধারিত একটি দিনের বাইরে নারীরা কি আদৌ উদ্‌যাপন করতে পেরেছেন তাঁদের স্বাধীনতা? যদিও রাষ্ট্রসঙ্ঘ এই দিনটিকে স্বীকৃতি দিয়েছে মহিলাদের লড়াইয়ের প্রতীক হিসাবে। যদি তা-ই হয়, তবে একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে জন্ম নিয়ন্ত্রণের দায় শুধু মেয়েদের উপরই বর্তাবে কেন? সন্তানধারণে সমস্যা হলে প্রথমেই মহিলাদের ‘বাঁজা’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হবে কেন? প্রশ্নগুলি জমতে থাকে বছরের পর বছর। এত দিন ‘জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি’ বা ‘কনট্রাসেপটিভ পিল’ খাওয়ার দায় ছিল শুধুমাত্র মেয়েদরই। সেই নিয়মে বোধ হয় এ বার একটু বদল ঘটতে চলেছে। গবেষণা সফল হলে খুব তাড়াতাড়ি কিনতে পাওয়া যাবে পুরুষদের জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রক ওষুধ। তা নিয়ে কাজ চলছে দেশবিদেশের গবেষণাগারে। কানে শুনতে কেমন যেন ঠেকছে না? এত দিন যা শুধু মেয়েদের ব্যবহার করার জিনিস ছিল, তা হঠাৎ পুরুষদের জন্য কেন?

এমন জিনিস এলে সমাজের যে পৌরুষ নিয়ে ধারণা, তাতে কোনও ঘা লাগবে না তো? কী মনে করে তরুণ প্রজন্ম? একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে এই সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরুষরা ‘পিল’ বা জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি সম্পর্কে ঠিক কী ভাবেন, খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement
Image of Actor Rwitobrata Mukherjee

জন্ম নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র মহিলাদেরই সচেতন থাকতে হবে, এমনটা মনে করেন না ঋতব্রত। ছবি- সংগৃহীত

কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে গিয়েও কি বার বার পিছিয়ে আসতে হয়নি মহিলাদের? পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অদৃশ্য সব দায় কি চাপিয়ে দেওয়া হয়নি মেয়েদের উপর? জন্ম নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে সন্তান না হওয়া— সব কিছুর বিরুদ্ধে একা লড়াই করে গিয়েছেন মেয়েরা। বাংলা ছবির এক উত্তরসূরি অভিনেতা ঋতব্রত মুখোপাধ্যায় বলেন, “ব্যক্তিগত ভাবে আমার মনে হয়, লিঙ্গ নিয়ে এই রাজনীতিটা বন্ধ হওয়া উচিত। জন্ম নিয়ন্ত্রণে শুধুমাত্র মহিলাদেরই সচেতন থাকতে হবে, পুরুষদের কোনও দায় থাকবে না, এটা হতে পারে না। আর এইটা যদি সত্যি হয়, তা হলে বলব যুগান্তকারী ঘটনা হবে। তবে কে কোন জন্ম নিয়ন্ত্রক পদ্ধতি বেছে নেবেন, সেটা কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ।”

Image of Actor Rwittick Chakraborty

কে কোন পন্থা বেছে নেবেন, তা তাঁর ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ বলেই মনে করেন ঋত্বিক। ছবি- সংগৃহীত

পুরুষদের ক্ষেত্রে এই জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ির কাজ হল, সাময়িক ভাবে তাঁর ঔরসের তেজ কমিয়ে দেওয়া। অনেকের মনে হতেই পারে, এতে তাঁর পৌরুষ কমে যাবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুগ হয়তো আধুনিক হয়েছে, কিন্তু পৌরুষ ঘিরে সে সব ভাবনার পালে কি হাওয়া লেগেছে? এ প্রসঙ্গে নিজের ব্যক্তিগত পছন্দের কথা সংবাদমাধ্যমকে না জানাতে চাইলেও পুরুষদের নতুন এই পন্থা ব্যবহার করা নিয়ে অভিনেতা ঋত্বিক চক্রবর্তী বলেন, “বিষয়টা শুনতে তো ভালই লাগছে। কিন্তু পুরুষদের ইগোতে না লাগলেই হল!’’ ঋত্বিক ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কথা মনে রাখেন। সব ভেবে তিনি বলেন, ‘‘সমাজের বিভিন্ন স্তরের পুরুষরা এই পন্থা বেছে নেবেন কি না, তা এখনই বলা সম্ভব নয়। কারণ, এটা তো এখনও গবেষণার পর্যায়ে রয়েছে। এর জন্য যথেষ্ট প্রচার এবং প্রসারের প্রয়োজন।”

Image of Actor Sourav Das

জন্ম নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে সহজ যে পন্থা, সৌরভের পছন্দ সেটিই। ছবি- সংগৃহীত

বিয়ের কথা পাকা হওয়ার পর থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিতে বলা হয় মেয়েদের। বিয়ের তত্ত্বে মেয়ের সঙ্গে যে গোপন বাক্সটি যায়, তারই এক কোণে লুকোনো থাকে সেই জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি। বাড়ির বড় মহিলারা, বলা ভাল সম্পর্কে আত্মীয়ারাই নতুন কনেকে শিখিয়ে-পড়িয়ে দেন। সমাজের এই দায় জন্ম-জন্মান্তর ধরে নিয়ে আসছে মেয়েরা, সে-ও যে তাদের থেকে আলাদা নয় দেখিয়ে দেওয়া হয় চোখে আঙুল দিয়ে। এই প্রসঙ্গে অভিনেতা সৌরভ ‘মন্টু’ দাস বলেন, “সত্যিই তো মেয়েরা কেন এর দায় নেবে? আমি ব্যক্তিগত ভাবে ওষুধ খেতে পছন্দ করি না। আর এ ক্ষেত্রে দু’পক্ষকেই এই ধরনের ওষুধ খেতে বারণ করব। কারণ, এই সব ওষুধের যথেষ্ট পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমি নিজের কথা বলতে পারি। এত জটিলতায় যাওয়ার প্রয়োজন আছে বলেই আমি মনে করি না। সবচেয়ে সহজ যে পন্থা, আমি তো সেটিই বেছে নেব।” সৌরভের মতোই নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শহরের বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত এক যুবক সাফ জানালেন, ‘‘আমি নিজে ওষুধ খেতে খুব একটা পছন্দ করি না। তা ছাড়া গর্ভনিরোধক বড়ি খেলে মহিলাদের শারীরিক নানা রকম অসুস্থতার কথাও শুনেছি। সচেতন পুরুষ তো যৌন মিলনের সময় কন্ডোম ব্যবহার করেন। আমিও তার ব্যতিক্রম নই। তাই আলাদা করে গর্ভনিরোধক বড়ি খাওয়ার পক্ষপাতী আমি অন্তত নই।’’

‘এইচআইভি’ বা অন্যান্য যৌনরোগের সংক্রমণ এড়াতে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সুরক্ষিত যৌন জীবনে অভ্যস্ত হওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। জন্ম নিয়ন্ত্রণের প্রচলিত পন্থা ছেড়ে পুরুষরা কি রাতে শুতে যাওয়ার আগে এই বড়ি খাওয়ার অভ্যাস করতে পারবেন? বছর ৫০-এর পিনাকী ঘোষ পেশায় সরকারি কর্মচারী। স্ত্রীর জন্য প্রতি মাসে মনে করে ডালহৌসি চত্বর থেকে লুকিয়ে জন্ম নিরোধক ওষুধ কিনে নিয়ে যান। জন্ম নিয়ন্ত্রক বড়ি যে পুরুষরাও খেতে পারেন, সে কথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন না। তাঁর মতে বংশের প্রদীপ জ্বালিয়ে রাখার দায় তো ছেলেদের, তাই তাঁদের এ সব থেকে বাদ রাখাই ভাল। পিনাকীবাবু বলেন, “কোনও দিন শুনেছেন যে ছেলেরা রাতে শোয়ার সময়ে এমন ওষুধ খাচ্ছেন? স্বামী-স্ত্রী যৌথ ভাবে যদি আর সন্তান না নেওয়ার কথা ভেবে থাকেন, সে ক্ষেত্রে মহিলাদেরই আগে অপারেশন করা হয়। ক’টা পুরুষ নাসবন্দি করান? ওই যে সেই সঞ্জয় গান্ধীর আমলে এক বার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে লাভ কি হল? বিশাল রাজনীতি আছে এই সব নিয়ে।”

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের তো এটাই বৈশিষ্ট্য। স্ত্রীর জমিতে বীজ বপন করবেন স্বামী। যুগ যুগ ধরে এই ভাবেই চলে আসছে। এর অন্যথা কেন হবে? পিনাকীবাবুর মতে, “মেয়েরা তো শুধু সন্তানধারণ করে, কিন্তু যে বীজের মধ্যে আগামী ঘুমিয়ে থাকে, তার যদি ক্ষতি হয়ে যায়, তখন কী হবে বলুন দেখি? যে সমাজের কথা বলেছেন সেই সমাজের পুরুষরা কন্ডোম ব্যবহার করেন কি না সন্দেহ। এই ধরুন না পরিযায়ী শ্রমিকদের কথা। লকডাউন ঘোষণা করার পর যখন তাঁরা দলে দলে নিজের রাজ্যে ফিরছেন, সেই সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে কন্ডোম বিলি করা হয়েছিল। ক’জন ব্যবহার করেছে বলুন তো? আগামী দিনে কী হবে, সেটা পরের বিষয়। তবে আমার কথা যদি জানতে চান, এই বয়সে দাঁড়িয়ে আমি যদি বান্ধবীর সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হই, আমি ওষুধ খেতে পারি। কিন্তু যদি স্ত্রীর প্রসঙ্গ আসে তা হলে আমি ঝুঁকি নেব না।”

তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত পেশায় ইঞ্জিনিয়ার রত্নাকর সরকার কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সব দায় ভাগ করে নেওয়ার পক্ষেই। তাঁর মতে, “সমানাধিকারের লড়াইয়ে যদি মেয়েদের এত পরীক্ষা দিতে হয়, তা হলে আধুনিক পুরুষরা পিছিয়ে থাকবেন কেন? মেয়েদের যদি ওষুধ খেতে হয়, ছেলেদেরও এই বিষয়ে এগিয়ে আসা উচিত। তবে, সমাজের সব স্তরে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে নির্ভর করবে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির উপর।” কে বেছে নেবেন, কে নেবেন না, তা সময় বলবে। তার আগে সেই বড়ি আসতে হবে বাজারে। কিন্তু রত্নাকরের মতো কিছু পুরুষ নিশ্চয়ই আছেন, যাঁরা সঙ্গীনীর পাশে সব ভাবে থাকতে প্রস্তুত। তা সে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি খাওয়াই হোক না কেন! বদলাতে থাকা সময়ের সঙ্গে হয়তো আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস সে সব পুরুষদের মন বোঝারও দিন হয়ে দাঁড়াবে।

Advertisement
আরও পড়ুন