Burima's Chocolate Bomb

‘বুড়িমার চকলেট বোম’ তো কিনেছেন, সেই রূপকথার পিছনে আছে এক ছিন্নমূলের লড়াই

সর্বজনীন এই ‘বুড়িমা’র আসল নাম অন্নপূর্ণা দাস। জন্মেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। দেশভাগ ছিন্নমূল করে দেয়।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২২ ১৬:৫১
এক লড়াইয়ের নাম বুড়িমা।

এক লড়াইয়ের নাম বুড়িমা। ছবি: সংগৃহীত

‘বুড়িমার চকলেট বোম’। এক সময় জনপ্রিয়তার তুঙ্গে ছিল। এখনও আতশবাজির ক্ষেত্রে বুড়িমার নাম মনে আসে। বেশি করে বুড়িমাকে মনে পড়ে কালীপুজোর আগে।

তিনি সবার কাছেই ‘বুড়িমা’। বাবারও, ছেলেরও। তাঁর চকোলেট বোম না হলে তো কারও কালীপুজোই জমত না একটা সময়ে। এখন ডেসিবেল ধরে বাজির শব্দ মাপার যুগে সে নাম অনেকটাই মলিন। তবে এক বড় সময় জুড়ে বুড়িমাই শব্দবাজির সাম্রাজ্য চালাতেন। শুধুই কালীপুজোয় নাকি! ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচেও শচীন-সৌরভদের জয় মানেই ‘বুড়িমা’-র গর্জন। কোহালি, রোহিতদের আমলে সেটা কমেছে।

Advertisement

সর্বজনীন এই ‘বুড়িমা’র আসল নাম অন্নপূর্ণা দাস। জন্মেছিলেন বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। দেশভাগ ছিন্নমূল করে দেয়। ভিটেছাড়া হয়ে চলে আসেন তখনকার পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ধলদিঘি সরকারি ক্যাম্পে। উদ্বাস্তুদের পার্মানেন্ট লায়াবিলিটি ক্যাম্প থেকে এক সময়ে হাওড়া জেলার বেলুড়ে স্থায়ী ঠিকানা হয় তাঁর। তবে তার মাঝে অনেক লম্বা লড়াই ছিল। গরিব ঘরের লড়াকু মেয়ে পরবর্তী জীবনে হয়ে ওঠেন সফল ব্যবসায়ী ‘বুড়িমা’। এখনও সেই ব্যবসা চলছে অন্য মালিকানায়।

স্বামী সুরেন্দ্রনাথের মৃত্যু হয় পূর্ব পাকিস্তানে থাকার সময়। তিন মেয়ে এক ছেলের মা অন্নপূর্ণা বর্তমান বাংলাদেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় নেন। সেটা ১৯৪৮ সাল। ধলদিঘির বাজারে রাস্তায় সব্জি বিক্রি করে সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন অন্নপূর্ণা। পরিবার সূত্রে জানা যায়, ধলদিঘি থেকে এক সময়ে গঙ্গারামপুরে চলে যান। তার আগে কিছু দিন বিড়ি বাঁধার কাজও করেন। পরে নিজের বিড়ির ব্যবসা শুরু করে দেন।

তবে বেশি দিন গঙ্গারামপুরে থাকা হয়নি। সেখানে থাকতেই মেয়ের বিয়ে দেন হাওড়ার বেলুড়ে। সেই সূত্রে বেলুড়ের প্যারীমোহন মুখার্জি স্ট্রিটে একটা দোকান-সহ বাড়ি কেনেন। বিড়ির সঙ্গে যুক্ত হয় আলতা, সিঁদুরের ব্যবসা। বিশ্বকর্মা পুজায় ঘুড়ি, দোলে রং, কালীপুজোর বাজি— এমন ছোটখাটো নানা ব্যবসাই শুরু করেন অন্নপূর্ণা। নিজে অবশ্য কিছুই তৈরি করতেন না তখন। অন্যের থেকে কিনে এনে বিক্রিই ছিল ব্যবসা।

তত দিনে রীতিমতো বয়স হয়েছে অন্নপূর্ণার। কিন্তু নতুন কিছু করার তাগিদে তরুণদেরও হার মানান। এই সময়েই নাকি তাঁর দোকানে ক্রেতারা এসে অন্নপূর্ণাকে ‘বুড়িমা’ বলে সম্বোধন করতেন। ধীরে ধীরে তিনি সবার ‘বুড়িমা’ হয়ে যান।

বাজির ব্যবসা শুরুর পিছনেও রয়েছে লড়াইয়ের কাহিনি। এক সময় তিনি লক্ষ করলেন, বাজি কিনে বিক্রি করার থেকে অনেক বেশি লাভ তৈরি করতে পারলে। যেমন ভাবনা, তেমন কাজ। শুরু করেন বাজি তৈরি। কারখানাও বানান। তবে তাঁর জন্য আইনি ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে তাঁকে। সে সব সামলে এক সময়ে লাইসেন্সও পেয়ে যান। শোনা যায়, তিনি বাজি তৈরি শিখেছিলেন আকবর আলি নামে বাঁকড়ার এক ব্যবসায়ীর থেকে। বিভিন্ন জায়গা থেকে নিজেই খোঁজ করে নিয়ে আসেন কারিগরদের। নিজের নতুন নামেই তৈরি করলেন ব্র্যান্ড। ‘বুড়িমা’ ব্র্যান্ড হয়ে ওঠে বাজির বাজারে। সবচেয়ে বেশি নাম করে ‘বুড়িমার চকলেট বোম’।

এখানেই শেষ হয়নি অন্নপূর্ণার সফর। অন্ধ্রপ্রদেশের শিবকাশীতে একটি দেশলাই কারখানা তৈরি করেন। ডানকুনিতে চলতে থাকে তাঁর বাজির কারখানা। ১৯৯৫ সালের ৩ জুন মৃত্যু হয় বুড়িমার। তার পরে একমাত্র পুত্র সুধীরকুমার দাস ব্যবসা চালান। এখনও চলছে ‘বুড়িমা ফায়ার ওয়ার্কস’। পৌত্র সুমন দাস আনন্দবাজার অনলাইনকে বলেন, ‘‘এখনও সমান ভাবে ব্যবসা চলছে। আমরা এখন বেলুড়ের কারখানায় শব্দদূষণ হয় না এমন বাজি বানাই। আর এখন ব্যবসা দেখেন আমার ছেলে, মানে বুড়িমার পুতি (প্রপৌত্র) সুমিত দাস।’’

শব্দদূষণের কারণে চকোলেট বোম এখন লুপ্তপ্রায়। কিন্তু ‘বুড়িমা’ বেঁচে আছেন কিংবদন্তি হয়ে।

আরও পড়ুন
Advertisement