গ্রাফিক: সনৎ সিংহ।
প্রতি বছর আমেরিকার ‘মেট গালা’ সারা বিশ্বের ফ্যাশন-বোধ নিয়ে নতুন ধারণা তৈরি করে। বিভিন্ন দেশের শৌখিনীরা সেখানে নিজেদের বিশেষ সাজ দেখান। হাজির হন হলিউডের নায়ক-নায়িকা, গায়ক-গায়িকা থেকে তামাম দুনিয়ার বিশিষ্টজনেরা। আগে ভারতীয়দের বিশেষ দেখা যেত না। এখন ধীরে ধীরে আলিয়া-দীপিকাদের মতো বলিউডের তারকাদেরও দেখা যায় সেখানে। বিদেশি তারকাদের ভিড়ের মাঝে নিজেদের প্রিয় নায়িকাদের দেখে এ দেশের অনেকের মধ্যে আলোচনাও হয়। শুধু কাঁটা হয়ে রয়ে যায় নগ্নতা।
ফ্যাশনে হাওয়াবদল যে হয়েছে, তা মেট গালা ভালই বোঝায়। এককালে বিলাসবহুল সাজের মূল চিহ্ন ছিল অঢেল কাপড়। এখন নগ্নতা। এ বছরের মেট গালা অন্তত তেমনটাই দেখাল। আমেরিকার র্যাপার দোজ়া ক্যাটের কথাই ধরা যাক না। সারা শরীর কাপড়ে ঢাকা। কিন্তু সাদা রঙের সেই টি-শার্টের মতো পোশাকের চেয়ে বেশি নগ্ন সাজ এ যাবৎ কালে দুনিয়ায় দেখা যায়নি বলেই রব উঠেছে। চপচপে ভেজা, গায়ের সঙ্গে লেপ্টে থাকা প্রকৃত অর্থে স্বচ্ছ সে পোশাক গত দু’দিন ধরে ফ্যাশন জগতে চর্চার কেন্দ্রে।
নগ্নপ্রায়। এটিই এখন ফ্যাশনের সংজ্ঞা। অন্তত মেট গালা পরবর্তী হাওয়ায় সে কথাই ভাসছে। আমেরিকার অভিনেত্রী এলি ফ্যানিং থেকে কানাডার অভিনেত্রী টেলর রাসেল কিংবা আমেরিকার শৌখিনী কিম কারদাশিয়ান— খোলামেলা পোশাকের সাজ দাপিয়ে বেড়িয়েছে এ বছরের মেট গালায়।
কিন্তু এ বছর মেট গালায় গিয়েছিলেন তো অনেকেই। সকলেই কি তেমন করলেন? তা তো বলা যায় না। তবে এমন কথা কেন ভাসছে? ফ্যাশন সচেতন বহু জনের বক্তব্য, এক সময়ে খোলামেলা পোশাক, শরীর দেখানো নিয়ে অনেক রকম ছুতমার্গ ছিল। এখন তা একেবারেই উল্টে গিয়েছে কি? মেট গালার গালিচায় গায়িকা রিটা ওরা যেমন অতি-স্বল্প বসনে হাজির হয়েই চর্চার কেন্দ্রে যান। হইহই শুরু হয় তাঁর পোশাক নিয়ে।
সেই গালিচায় হেঁটেছেন কিন্তু ভারতীয় অনেকেই। ভিড়ের মধ্যে ছিলেন স্বয়ং আলিয়া ভট্টও। বলিউডের সেরা সুন্দরীদের মধ্যে তাঁর নাম। এ দেশের জনতাও খুশি হল। কিন্তু আমেরিকায় চর্চা হল কাকে নিয়ে? মোনা পটেল! কে তিনি? গুজরাতের মেয়ে, এখন আমেরিকাবাসী। ব্যবসায়ী।মোনাকে যে আগে অনেকে চিনতেন, তেমন নয়। ব্যবসার জন্য যতটুকু পরিচিতি হয়, ততটুকুই ছিল। সে সূত্রেই মেট গালায় পা রাখা। কিন্তু সাজের জন্য বিশেষ নাম করেননি এর আগে। আলিয়ার মতো বলিউড তারকাকে ছাপিয়ে রাতারাতি তাঁর সাজ গায়ের রঙের কাছাকাছি রঙের গাউন, হাতে প্রজাপতির মতো গয়না দেওয়া সাজ নিয়ে শুরু হয়েছে হইচই। আর তার ব্যাখ্যা হিসাবে সেই ফিরে ফিরে আসছে খোলামেলা সাজের প্রসঙ্গ।
ভারত কি তবে আসলে অনেকটা দূরে বিদেশের ফ্যাশন ভাবনার থেকে? তাই কি আলিয়া, দীপিকা, প্রিয়ঙ্কারা মেট গালায় গেলেও, তাঁদের নিয়ে কোনও কথা হয় না গোটা বিশ্বে? তাঁদের সাজ অন্য রকম। যেমন এ বার আলিয়া ভট্ট গেলেন সেখানে সব্যসাচী মুখোপাধ্যায়ের তৈরি ফুলেল শাড়ি পরে। মুকেশ-কন্যা ইশা অম্বানী দেখা দিলেন শাড়ি গাউনে। ভারতীয় নারীরা যেমন করে থাকেন বিশেষ বিশেষ জায়গায় দেখা দিলে, তেমনই রইল তাঁদের আচরণ। আর সেই আচরণের কারণেই কি হারিয়ে গেলেন তাঁরা? উঠছে প্রশ্ন। নগ্নতার ব্যাখ্যা দুনিয়াভর বদলে গেলেও কি তবে এখানে বদলাল না? তাই কি আলিয়া-দীপিকারা ফ্যাশন জগতের তাবড় নামেদের সঙ্গে গালিচায় পা রেখেও সাবধানি? এখনও কি অনেকটা ফারাক এ দেশ আর বিদেশের সৌন্দর্যের ব্যাখ্যায়? টলিপাড়ার নায়িকা সুস্মিতা চট্টোপাধ্যায় অবশ্য সে ভাবে দেখেন না বিষয়টিকে। সুস্মিতা বলেন, ‘‘আমি আলিয়ার সাজ দেখেছি। ভাল দেখাচ্ছিল মেট গালায়। সকলে কেন এক রকম সাজবেন! সাজ তো নিজের-নিজের মতো হবে।’’ নগ্নতা নিয়ে কোনও ছুতমার্গ নেই সুস্মিতার। নিজের কাজের প্রয়োজনে সবই করা যায় বলে মনে করেন। তবে সাজের বিষয়ে স্বাধীনতাতেও বিশ্বাস রাখেন।
পূর্ব ও পশ্চিমের সংস্কৃতির মধ্যেও অনেকটা ফারাক আছে। সে বিষয়টি মনে রাখার কথা বলেন কলকাতার আর এক অভিনেত্রী মধুমিতা সরকার। তিনি খোলামেলা পোশাকের বিপক্ষে নন। কিন্তু বলেন, ‘‘কোথায় যাচ্ছি, সে কথা তো মনে রাখতেই হবে। যদি বিদেশে যাই, সেখানে গিয়ে নিজের সংস্কৃতিকে তুলে ধরারই তো চেষ্টা করব।’’ মধুমিতার বক্তব্য, পশ্চিমে খোলামেলা পোশাক পরা নিয়ে তত ছুতমার্গ নেই। যেমন জেনিফার লোপেজ় মেট গালায় যে পোশাক পরে গিয়েছিলেন, তা সেখানে পরা সম্ভব। সে দেশের নারীদের নিয়ে নিন্দামন্দ তত হবে না। সে রকম পোশাক যদি এ দেশের কোনও নারী পরেন, তবে তা অন্য রকম হবে। আর সেই নিন্দা মাথায় নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই এ ক্ষেত্রে। কাজের প্রয়োজন হলে সেটা আলাদা কথা।আর সেই সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির ধন্দের মাঝেই আলিয়াদের ছাপিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেন মোনারা।