World Autism Awareness Day

‘অটিজম আমার সন্তানকে অস্বাভাবিক নয়, অসাধারণ বানিয়েছে’

অটিস্টিক মানুষেরা প্রতি মুহূর্তে এমন কিছু শিখিয়ে যায়, যা আসলে আমাদের স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সেই স্বাভাবিকের চেয়ে এতই দূরে চলে এসেছি যে, ওদের ‘অস্বাভাবিক’ বলে থাকি।

Advertisement
দেবপ্রতিম দাশ
দেবপ্রতিম দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০২১ ১১:৪৮
ওদের প্রয়োজন সাহায্য

ওদের প্রয়োজন সাহায্য

অটিজম হল একটি অন্য ধারার জীবনবোধ। অন্য ধারার কথাটাও ঠিক নয়। অটিস্টিক মানুষেরা প্রতি মুহূর্তে এমন কিছু শিখিয়ে যায়, যা আসলে আমাদের স্বাভাবিক হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমরা সেই স্বাভাবিকের চেয়ে এতই দূরে চলে এসেছি যে, ওদের ‘অস্বাভাবিক’ বলে থাকি। ‘অটিজম স্পেক্ট্রাম ডিজঅর্ডার’ আছে যাদের, তাদের অনেকগুলি স্তর থাকে। যেমন কেউ অল্প কথা বলে। কেউ একেবারেই কথা বলে না। কারও সামাজিক যোগাযোগ একেবারেই নেই, বা কেউ সেটা করতে পারে না।

তাদের মধ্যে যারা অল্পবিস্তর কথা বলে, তারা ‘আমি’ বা ‘আমার’ মতো শব্দ ব্যবহার করে না। যেমন আমাদের একমাত্র সন্তান আহীর তার প্রয়োজনীয়তা বোঝানোর সময়ে বলে ‘আহীর খাবে’ বা ‘আহীর যাবে’। নিজস্বী তোলা এবং আত্মবিজ্ঞাপনের যুগে যা প্রায় অকল্পনীয়। নিজের ছেলেকে বড় করতে গিয়ে এমন অনেক কিছুই দেখি। আর ভাবতে বাধ্য হই। ভেবে দেখলে বোঝা যায়, অটিস্টিক মানুষদের বাচনভঙ্গিতে এক ধরনের সমাজবোধ রয়েছে। তারা মোটেই সমাজ থেকে মুখ ফেরায় না। অথচ, তেমনই তো মনে করা হয়ে থাকে সাধারণ ভাবে। ঠিক এ রকমই অসংখ্য উপলব্ধি হয়ে চলেছে গত দশ বছর ধরে। আহীরের জন্মের পর থেকে।

Advertisement

এক জন শিক্ষক হিসেবে দেখি, প্রতিটি শ্রেণিতেই কিছু পড়ুয়া থাকে, যারা বাকিদের সঙ্গে পেরে ওঠে না পড়াশোনায়। আমরা ফাঁকিবাজ বা সে রকম কিছু উপমা দিয়ে তাদের চিরকালের জন্য পিছনে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করি। বাড়িতে আহীর বুঝতে শেখায়, সেই ছাত্রেরা পারছে না বলে পিছনে আছে। ইচ্ছা করে নয়। আমাদের আর একটু মনোযোগ পেলে তারাও হয়তো এগিয়ে আসতে পারবে। ঠিক সে ভাবেই আহীরদেরও প্রয়োজন সাহায্য। এই সাহায্যের প্রথম স্তর হল বাবা ও মা। আমাদেরই পারতে হবে সন্তানকে হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যেতে। সন্তানের সুবিধা-অসুবিধার দিকগুলো বুঝে ও মেনে নিয়ে। কিন্তু মেনে নেওয়া তো দূর, সন্তানের প্রয়োজনটা বুঝতেই বড় দেরি করে ফেলেন বহু বাবা-মা। এর পরের স্তরে থাকে বৃহত্তর পরিবার ও পরিজন। নিকটাত্মীয়েরা আরওই সময় নিয়ে থাকেন কিছু ক্ষেত্রে। অনেক ক্ষেত্রে তাঁরা কখনওই মেনে নিতে পারেন না আহীরদের। ওদের উপস্থিতি তাঁদের অভ্যাসে পরিণত হয়, তবে হৃদয়ে ঢোকে না। তৃতীয় স্তর হল সমাজ। তা হল সবচেয়ে কঠিন। আজ, এই দিনটি আলাদা ভাবে পালন করা হয় সেই সমাজকে মাথায় রেখেই। আহীরদের নিয়ে সমাজের সচেতনতা বৃদ্ধিই একমাত্র উদ্দেশ্য।

শুরুতেই লিখেছি আমরা ওদের অন্য ধারার বলে থাকি। ইংরেজিতে ‘ডিফারেন্টলি এব্‌লড’ বলা হয়। আমিও বলি নিরুপায় হয়ে। কিন্তু এই ‘অন্য’ বা ‘আলাদা’ বলার প্রয়োজন যত দিন থাকবে, তত দিন পরিস্থিতি বদলাবে না। বরং এ ভাবে কি ভাবা যায় না যে, সমাজে আমাদের মতোই আরও মানুষ আছে যাদের কিছু কাজ বা সামাজিকতার ক্ষমতা ক্লাসের লাস্টবয়ের থেকে আরাও একটু কম। তা হলেই আর আলাদা ভাবে বিশ্লেষণের প্রয়োজন পড়বে না। আহীরকে দেখার আগে আমারও এ বিষয়ে কোনও ভাবনা ছিল না। তবে আজকাল পত্রপত্রিকায় এ বিষয়ে লেখা হয়। তাই সচেতনতা বাড়ছে।

আমাদের দেশের স্কুলগুলোয় আহীরদের মতো মানুষদের ভর্তি নেওয়া বাধ্যতামূলক। বাকি শিশুদের মতোই যাতে অটিস্টিকেরাও শিক্ষার অধিকার পায়, অন্তর্ভুক্তিকরণের উদ্যোগ সে কারণেই। কিন্তু আমার সন্তানের মতো শিশুদের কিছুটা বিশেষ ধরনের যত্ন প্রয়োজন। ‘স্পেশ্যাল এডুকেশন’ দরকার। তার ব্যবস্থা থাকে না বেশির ভাগ স্কুলেই। বড় শহরে যদিও বা কিছু স্কুলে থাকে, ছোট শহর-মফস্‌সলে তো এই ব্যবস্থা অকল্পনীয়। তাই স্কুলে গিয়েও কিছু জিনিস না শেখাই থেকে যায়। আরও পিছিয়ে পড়ে আহীররা। বাধ্যতামূলক হলেও আবার সব স্কুলে ভর্তির সুযোগ পায় না আহীররা। রাস্তাঘাটে কুমন্তব্য শুনে আর গায়ে লাগে না কুভাষণে ভরা এই দেশে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে গিয়ে যখন তেমন কোনও মন্তব্য শুনতে হয়। যখন খারাপ কথা বলা হয় আহীরদের নিয়ে। তখন কষ্ট হয়। যেই শিক্ষকদের ছোঁয়া পেলে হয়তো একটু এগিয়ে যেত আমার ছেলে, তাঁরাই হাত বাড়িয়ে দিতে অস্বীকার করেন এখনও। প্রতিটি শিশুর প্রতি তো সমাজ ও সরকার দায়বদ্ধ। তাই সরকারের শুধু নিয়ম বানালেই চলবে না। তা পালন হচ্ছে কি না, তা-ও দেখা দরকার।

তবে গত দশ বছরে আহীরকে ঘিরে অনেক কিছুই শিখেছি আমরা। সন্তানকে যা যা শেখানোর ইচ্ছা ছিল, তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। বাবা-মা-সন্তানে মিলে নতুন পদ্ধতি তৈরি করছি রোজ। তিন জনেই করছি। আহীরও সাহায্য করছে প্রতি দিন নতুন ভাবে এগিয়ে যেতে। এমন যদি না হত, তবে কেমন হত? এ কথা কখনও যে মনে হয়নি, তেমন নয়। তবে সে ভাবনা ঢাকা পড়ে যায় যখন বহু দিনের চেষ্টায় কোনও নতুন শব্দ শেখে আহীর। তখন শুধুই আনন্দ। ধীরে এলেও অবশেষে আসে সেই মুহূর্তগুলো। আরও নতুন মুহূর্তের আশা দেখায়। তখন আমরা বুঝি, এমন না হলে এই আনন্দও আসত না। সমাজকে তখন মনে করাতে ইচ্ছা হয়, আহীররা অ-স্বাভাবিক নয়, অ-সাধারণ!

(লেখক আইআইটি গুয়াহাটির অধ্যাপক)

Advertisement
আরও পড়ুন