সংঘর্ষের পর এই ভাবে মালগাড়ির উপর উঠে গিয়েছে করমণ্ডল এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন। নিজস্ব চিত্র।
ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে দুর্ঘটনাগ্রস্ত করমণ্ডল এক্সপ্রেসে রেলদুর্ঘটনা রোখার ‘কবচ’ প্রযুক্তি থাকলেও কি দুর্ঘটনা এডানো যেত? ওই দুর্ঘটনায় একশোরও বেশি প্রাণহানি হওয়ার অব্যবহিত পরে এ নিয়ে কেউই কিছু বলতে পারেননি। তবে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের প্রায় দেড় হাজার রুটে ওই পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে চালু হয়েছে বলে রেলের তরফে জানানো হয়েছিল। এখন প্রশ্ন, করমণ্ডলে কি ‘কবচ’ পদ্ধতি ছিল? না-থাকলে কেন তা এমন একটি জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনে ব্যবহার করা হয়নি? ব্যবহার করা হলেও কি তা দুর্ঘটনা রোধ করতে পারত? দুই বা ততোধিক ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ রোধ করতে ‘কবচ’ প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব দাবি করেছিলেন, এই প্রযুক্তি বা পদ্ধতি প্রয়োগ করলে ১০ হাজার বছরে মাত্র এক বার দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে!
‘কবচ’ প্রযুক্তি ট্রেনে-ট্রেনে সংঘর্ষ রোধ করতে পারে— সাধারণ ভাবে এটিই সকলে জানেন। কিন্তু তা শুধু দু’টি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ রোধ করে, না একই লাইনে একটি ট্রেনের পিছনে অন্য একটি ট্রেন গিয়ে ধাক্কা মারলে তা-ও রুখতে পারে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে। আবার একইসঙ্গে বলা হচ্ছে, ‘কবচ’ পদ্ধতি তখনই কাজ করবে, যখন সংশ্লিষ্ট দু’টি ট্রেনেই ওই পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে। একটি ট্রেনে থাকলে সংঘর্ষ রোখার ক্ষমতা ওই প্রযুক্তির নেই। যাত্রিবাহী ট্রেন ছাড়া মালবাহী ট্রেনে ‘কবচ’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হবে, এমন কোনও পরিকল্পনাও এখনও রেলের নেই। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, শুক্রবার সন্ধ্যায় করমণ্ডল এক্সপ্রেস ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে একই লাইনে দাঁড়িয়ে-থাকা একটি মালগাড়ির পিছনে ধাক্কা মেরে লাইনচ্যুত হয়েছে। তা-ই এ ক্ষেত্রে ‘কবচ’ প্রযুক্তি কাজ করার কথাও ছিল না। কিন্তু এই দুর্ঘটনার পরে মালগাড়িতেও ‘কবচ’ প্রযুক্তি ব্যবহার করা প্রয়োজনীয় কি না, সেই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
ভারতীয় রেলের ইতিহাসে বহু রেলদুর্ঘটনা হয়েছে। প্রাণহানি হয়েছে প্রচুর মানুষের। গত বছরের ১৩ জানুয়ারি জলপাইগুড়ির ময়নাগুড়ির দোমহনিতে দুর্ঘটনায় পড়ে আপ বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস। লাইনচ্যুত হয় মোট ৮টি কামরা। ওই দুর্ঘটনায় প্রাণ যায় ৯ যাত্রীর। ময়নাগুড়িতে গিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী। উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত শুরু হয়েছিল। তখনই শুরু হয়েছিল অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ‘কবচ’-এর মাধ্যমে ওই ধরনের দুর্ঘটনা রুখে দেওয়ার চিন্তাভাবনা। তার কয়েক মাস পরেই ভারতীয় রেল জানিয়ে দেয় ‘প্রযুক্তি তৈরি’। দেশের ৩ হাজার কিলোমিটার রেলপথে পর্যায়ক্রমে ওই ব্যবস্থা চালু হচ্ছে পর্যায়ক্রমে। কিন্তু শুক্রবার ওড়িশার বালেশ্বরের কাছে চেন্নাইগামী করমণ্ডল এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা ‘কবচ’ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে! ওই ব্যবস্থা কি দক্ষিণ-পূর্ব রেলে কার্যকর করা গিয়েছে? গেলেও সেই কাজের গতিপ্রকৃতি এখন কেমন?
২০২২ সালের ডিসেম্বরে রাজ্যসভায় এই সংক্রান্ত প্রশ্নের লিখিত জবাব দিয়েছিলেন রেলমন্ত্রী। তিনি জানিয়েছিলেন, দক্ষিণ-পূর্ব রেলের ১,৪৪৫টি রুটে ইতিমধ্যে পর্যায়ক্রমে ‘কবচ’ কার্যকর হয়েছে। ৫ মাস আগে রেলমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘এখন দিল্লি-মুম্বই এবং দিল্লি-হাওড়া করিডরে (৩,০০০ কিলোমিটার) কাজ চলছে।’’ কেন পর্যায়ক্রমে ওই কাজ হচ্ছে? জবাবে রেলমন্ত্রী জানান, এমন অত্যাধুনিক ব্যবস্থা কার্যকর করার মতো সব রেলপথ জুতসই নয়। তাই আগে রেলপথের আধুনিকীকরণ করতে হচ্ছে। তার পরে সংঘর্ষরোধী অত্যাধুনিক ‘সিস্টেম’ কার্যকর করা যাবে। সে জন্যই ধাপে ধাপে কাজ চলছে। সেই কাজ এখন কতটা এগিয়েছে, তা অবশ্য অজানা।
‘কবচ’ ঠিক কী? কী ভাবে তা সংঘর্ষ রোখে?
অত্যাধুনিক ইলেকট্রনিক সিস্টেমে নকশা-করা একটি স্বয়ংক্রিয় ট্রেন সুরক্ষা পদ্ধতির পোশাকি নাম ‘কবচ’। পরিভাষায় বলা হয় ‘অটোমেটেড ট্রেন প্রোটেকশন সিস্টেম’। দেশীয় প্রযুক্তিতে ‘রিসার্চ ডিজ়াইন অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশন’-এর মাধ্যমে তৈরি এই সেন্সরভিত্তিক স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ট্রেনের ব্রেকিং সিস্টেম কাজ না-করলে বা চালক জরুরি পরিস্থিতিতে ট্রেন থামাতে ব্যর্থ হলেও সংশ্লিষ্ট ট্রেনটি নিজে থেকেই থেমে যাবে। এর ফলে যে কোনও ধরনের বিপদ থেকে রক্ষা পাবে ট্রেনটি। শরীরে ‘কবচ’ ধারণ করলে বিপদ-আপদ কেটে যায় বলে অনেকে বিশ্বাস করেন। তেমনই বড় কোনও দুর্ঘটনা থেকে এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা ট্রেনযাত্রীদের রক্ষা করবে বলে বিশ্বাস করে মোদী সরকার। তা-ই এমন নাম। শুধু বিপদের সময় পরিত্রাণ দেওয়াই নয়, বলা হয়েছিল, এই ব্যবস্থায় বিপদ সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য আগেই ট্রেনের চালক পেয়ে যাবেন। ‘আপডেট মেশিন ইন্টারফেস’ মাধ্যমে লোকো পাইলট সতর্ক থাকতে পারবেন। এখানেই শেষ নয়। কোনও ট্রেন অতিরিক্ত গতিতে দৌড়লেও স্বয়ংক্রিয় ব্রেকের মাধ্যমে ট্রেনটির গতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। দু’টি ইঞ্জিনের মধ্যে সংঘর্ষ রোখা যাবে। এই পদ্ধতির আর একটি সুবিধা হল, নেটওয়ার্ক পদ্ধতিতে ট্রেন চলাচলের গতিবিধির উপর সরাসরি নজর রাখা যাবে।
দেখুন, সংঘর্ষ হল না!
২০২২ সালের মার্চ মাসে ‘কবচ’ ট্রেনকে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচাতে পারে কি না, তার পরীক্ষা চলছিল। সেই পরীক্ষামূলক যাত্রায় একটি ট্রেনে ছিলেন স্বয়ং রেলমন্ত্রী। দু’টি লোকো একই লাইনে পরস্পরের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু তাদের অব্যর্থ পরিত্রাণ দিয়েছিল ‘কবচ’। ধাক্কা লাগার আগেই একটি ইঞ্জিন অপরটির চেয়ে ৩৮০ মিটার দূরত্বে থেমে গিয়েছিল। কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি। তার ভিডিয়ো টুইটারে পোস্ট করেন রেলমন্ত্রী বৈষ্ণব। জানান, পরীক্ষা ১০০ শতাংশ সফল। উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি টুইটে লিখেছিলেন, ‘‘লেভেল ক্রসিংয়ের কাছাকাছি ট্রেন আসতেই হুইস্ল বাজছে। ট্রেনের চালককে কিচ্ছু করতে হচ্ছে না। ‘অটো-হুইস্ল টেস্ট’ সফল। মুখোমুখি সংঘর্ষ রোখার পরীক্ষাও সফল।’’