মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতির দাবিতে অনড় ‘ইন্ডিয়া’। ছবি: পিটিআই।
অমিত শাহের ‘প্রস্তাব’ খারিজ করে দিল বিরোধীরা। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোমবার লোকসভায় জানিয়েছিলেন, বিরোধী শিবির সংসদে অচলাবস্থা সৃষ্টি না করলে মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় রাজি সরকারপক্ষ। কিন্তু মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতির দাবিতে অনড় ‘ইন্ডিয়া’ জোট সে প্রস্তাব মানতে রাজি হয়নি। মণিপুরকাণ্ড নিয়ে বিক্ষোভ দেখানোর ‘অপরাধে’ আম আদমি পার্টি (আপ)-র রাজ্যসভা সাংসদ সঞ্জয় সিংহকে সোমবার গোটা বাদল অধিবেশন পর্বের জন্য সাসপেন্ড করেন উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়। ফলে যুযুধান দু’পক্ষের তিক্ততা আরও বাড়তে পারে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন।
মণিপুরে গত পৌনে তিন মাসের হিংসাপর্ব এবং দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ভিডিয়ো (যার সত্যতা আনন্দবাজার অনলাইন যাচাই করেনি) এবং গণধর্ষণের অভিযোগ নিয়ে সোমবারও লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সরব হয়েছেন বিরোধী সাংসদেরা। বিক্ষোভ দেখিয়েছেন, সংসদ ভবন চত্বরেও। আর ‘জবাবে’ পশ্চিমবঙ্গ, রাজস্থান-সহ কয়েকটি বিরোধী শাসিত রাজ্যে নারী নির্যাতন নিয়ে অধিবেশনকক্ষের ভিতরে-বাইরে পাল্টা কর্মসূচি পালন করেছে বিজেপি। সংঘাতের এই আবহে সোমবারও মুলতুবি হয়ে গিয়েছে সংসদের বাদল অধিবেশনের তৃতীয় দিনও।
গত বৃহস্পতিবার বাদল অধিবেশনের সূচনার আগে প্রধানমন্ত্রী মোদীর বক্তব্যেই ইঙ্গিত মিলেছিল যে মণিপুরকাণ্ডে চাপের মুখে পড়ে পুরোদমে প্রতিআক্রমণের পথে হাঁটবে বিজেপি। গত পৌনে তিন মাস ধরে মণিপুরে ধারাবাহিক হিংসা এবং নারী নির্যাতনের ঘটনার জবাবে এ বার অ-বিজেপি রাজ্যগুলিতে মহিলাদের উপর সাম্প্রতিক কয়েকটি অভিযোগ ঘিরে পাল্টা প্রচারে নেমেছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে বাংলার পাশাপাশি রাজস্থান, বিহারের মতো রাজ্যকে নিশানা করেন স্মৃতি ইরানি, অনুরাগ ঠাকুর, লকেট চট্টোপাধ্যায়, অমিত মালবীয়রা।
প্রসঙ্গত, গত বুধবার তৃণমূলের সংসদীয় দলের মণিপুর সফরের সময়েই সে রাজ্যের থৌবল এবং কঙ্গপকপি জেলার সীমানায় দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ঘটনা বলে দাবি করা ওই ভিডিয়ো প্রকাশ্যে এসেছিল। ঘটনাচক্রে, মণিপুর প্রসঙ্গে নীরব প্রধানমন্ত্রী মোদী এর পরেই বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছিলেন বৃহস্পতিবার। সংসদ ভবনে ঢোকার আগে তিনি বলেছিলেন, ‘‘মণিপুরের ঘটনা যে কোনও সভ্য সমাজের পক্ষে লজ্জার।’’ পাশাপাশি, তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বাংলা, রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ের মতো বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। এর পর থেকেই শুরু হয়েছে দু’পক্ষের চাপানউতর।
যৌথ বিক্ষোভে কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম
মণিপুর নিয়ে সোমবার সকাল থেকেই বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির বিক্ষোভে উত্তাল সংসদ চত্বর। বেঙ্গালুরুতে জন্ম নেওয়া ২৬টি বিরোধী দলের জোট ‘ইন্ডিয়া’র ব্যানারেই অবিজেপি দলগুলি এককাট্টা হয়ে মণিপুরের পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদীর সংসদের উভয় কক্ষে বিবৃতির দাবিতে সরব হন। সেই বিক্ষোভেই অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে দেখা গেল বাংলার দুই সাংসদ কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী এবং সিপিএমের বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যকে। রাজ্যে তৃণমূলের তীব্র সমালোচক হিসাবে পরিচিত কংগ্রেসের লোকসভার দলনেতা তথা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর এবং সিপিএমের রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশ সোমবার অভিষেক, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, কাকলি ঘোষ দস্তিদারদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে স্লোগানও দেন। তবে যৌথ ধর্নায় অধীর তৃণমূল সাংসদদের থেকে কিছুটা দূরেই ছিলেন। তাঁর পাশে দেখা গিয়েছে দক্ষিণ ভারতের কংগ্রেস সাংসদদের। যেমন বিকাশের পাশে ছিলেন কেরলের তরুণ সিপিএম সাংসদ ভি শিবদাসন।
সংসদ ভবন চত্বরে গান্ধীমূর্তির তলায় বিক্ষোভ দেখানোর কথা ছিল বিরোধী সাংসদদের। কিন্তু সেখানে গিয়ে তাঁরা দেখতে পান, আগেই সে এলাকাটি বিজেপি সাংসদদের দখলে চলে গিয়েছে। এর পর ‘ইন্ডিয়া’-র সাংসদেরা কিছুটা দুরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। বাংলা, বিহার, রাজস্থানে নারী নির্যাতনের অভিযোগে বিজেপি সাংসদদের বিক্ষোভ কিছু ক্ষণ শেষ হলে তাঁরা চলে যান। এর পরে সেখানে বিক্ষোভ দেখান অধীররা।
সাসপেন্ড সঞ্জয়, সতর্কিত ডেরেক
মণিপুর নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি চেয়ে বিরোধী দলগুলির বিক্ষোভের জেরে বাদল অধিবেশনের তৃতীয় দিনে সানপেশনের ঘটনা ঘটল সংসদে। মণিপুর নিয়ে আলোচনার দাবিতে সোমবার রাজ্যসভার ওয়েলে নেমে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন আপের রাজ্যসভার সাংসদ সঞ্জয় সিংহ। ‘সাংসদ পদের অবমাননা’ করার কারণে গোটা বাদল অধিবেশনের জন্য তাঁকে সাসপেন্ড করেন উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যান জগদীপ ধনখড়। এর পাশাপাশি, ২৬৭ নম্বর ধারায় মণিপুর নিয়ে আলোচনা চেয়ে বিক্ষোভ দেখানোর জন্য তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও’ব্রায়েনকে সতর্ক করেন ধনখড়।
সোমবার সঞ্জয়কে সাসপেন্ড করার প্রস্তাব পেশ করেন রাজ্যসভার নেতা তথা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পীযূষ গয়াল। ধ্বনিভোটে সেই প্রস্তাব পাস হয়। তার পরেই সঞ্জয়কে সাসপেন্ড করার কথা জানান রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ধনখড়। বিরোধী দলগুলির বক্তব্য, তাদের কোনও কথা না শুনেই, তাদের মতামত না নিয়েই চেয়ারম্যান সঞ্জয়কে সাসপেন্ড করেছেন। এর পর চেয়ারম্যানের কক্ষে বিরোধী দলের নেতারা গিয়ে সাসপেনশনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। দুপুর ১টার সময় চেয়ারম্যান সমস্ত দলের নেতাদের নিজের কক্ষে ডাকেন। সেখানে আপের তরফে ছিলেন রাঘব চাড্ডা এবং তৃণমূলের পক্ষ থেকে শান্তনু সেন। অভিযোগ, ধনখড় খুব রূঢ় ভাবে তাঁদের দু’জনকে বৈঠক থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন। যার প্রতিবাদে সমস্ত বিরোধী দলের নেতারা ওই বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান।
শাহের প্রস্তাবে ‘ইন্ডিয়া’র ‘না’
মণিপুরকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবৃতির দাবিতে সংসদে ধারাবাহিক বিক্ষোভ চালাচ্ছেন বিরোধী সাংসদেরা। এই আবহে সোমবার লোকসভায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বললেন, ‘‘মণিপুর পরিস্থিতি নিয়ে সংসদে আলোচনা করতে সরকারের কোনও আপত্তি নেই।’’ যদিও সেই আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী মোদী অংশ নেবেন কি না, সে বিষয়ে কিছু বলেননি তিনি। কোন ধারায় সেই আলোচনা হবে, সে বিষয়েও সুস্পষ্ট ভাবে কিছু জানাননি তিনি। এর পর কংগ্রেস-সহ বেশ কয়েকটি বিরোধী দল জানিয়ে দিয়েছে, মণিপুরকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতির দাবি নিয়ে কোনও আপস করা হবে না।
২৬৭ ধারায় লোকসভা এবং রাজ্যসভায় সব কর্মসূচি বন্ধ রেখে দুই মহিলাকে বিবস্ত্র করে হাঁটানোর ‘ঘটনা’-সহ মণিপুরের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে ভোটাভুটি-সহ আলোচনার দাবিতে শুক্রবার নোটিস দিয়েছিল কংগ্রেস-সহ কয়েকটি বিরোধী দল। কিন্তু তাতে রাজি হয়নি মোদী সরকার। কেন্দ্রীয় সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ জোশী ২৬৭ ধারার পরিবর্তে ১৭৬ ধারায় আলোচনা চেয়েছিলেন। কিন্তু বিরোধীরা তাদের দাবিতে অনড় রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে শাহ সোমবার বলেন, ‘‘আমরা সভায় এই বিষয়ে আলোচনার জন্য প্রস্তুত। আমি বিরোধীদের অনুরোধ করছি এই বিষয়ে আলোচনা করতে দিন। এই স্পর্শকাতর বিষয়ে দেশ যাতে সত্য জানতে পারে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’’ সেই সঙ্গে তাঁর আক্ষেপ, ‘‘আমি জানি না, কেন এমন সংবেদনশীল বিষয়ে আপনারা (বিরোধী পক্ষ) আলোচনা হতে দিতে চান না।’’ শাহি প্রস্তাব খারিজ করার কথা ঘোষণা করে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ সোমবার বিকেলে বলেন, ‘‘খবরের শিরোনামে থাকতেই এখন উনি এ সব করছেন।’’