তামিলনাড়ুর তুতিকোরিন জেলায় খননকার্য চালিয়ে পাওয়া অতিপ্রাচীন লোহার সামগ্রী। ছবি: সংগৃহীত।
একটি শবাধার, সঙ্গে লোহার কিছু অতিপ্রাচীন সামগ্রী। সম্প্রতি তামিলনাড়ুর তুতিকোরিন জেলায় খননকার্য চালিয়ে এগুলিই পাওয়া গিয়েছে। শুনতে নেহাত সাধারণ হলেও এগুলির ঐতিহাসিক গুরুত্ব কম নয়। পুরাতত্ত্ববিদেরা বলছেন, তুতিকোরিনে পাওয়া পুরাতাত্ত্বিক উপাদানের সময়কাল নির্ণয় করে বোঝা গিয়েছে, আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৩০০ বছর আগেও সে রাজ্যে লোহার বহুল ব্যবহার ছিল! তা-ই যদি হয়, তা হলে সারা বিশ্বে তামিলনাড়ুই হবে লৌহযুগের পথপ্রদর্শক। বদলে যাবে পৃথিবীর এত দিনের ইতিহাস!
বৃহস্পতিবার ‘অ্যান্টিকুইটি অফ আয়রন’ নামে সাম্প্রতিক একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে তামিলনাড়ু রাজ্য পুরাতত্ত্ব বিভাগ (টিএনএসডিএ)। গবেষণাপত্রটি লিখেছেন আর শিবনন্থন এবং পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কে রাজন। ৭৩ পৃষ্ঠার ওই গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, আজ থেকে প্রায় ৫ হাজার ৩০০ বছর আগে তামিলনাড়ুতে লোহার প্রচলন ছিল। অ্যাক্সিলারেটর মাস স্পেকটোমেট্রি (এএমএস) এবং অপটিক্যালি স্টিমুলেটেড লুমিনেসেন্স (ওএসএল) পদ্ধতিতে তামিলনাড়ুর বিভিন্ন জায়গায় খননকার্য চালিয়ে পাওয়া নিদর্শনের সময়কাল যাচাই করার পর এই সিদ্ধান্তে এসেছেন প্রত্নগবেষকেরা। উল্লেখ্য, এই দুই পদ্ধতিই প্রচলিত কার্বন ডেটিংয়ের চেয়েও নির্ভুল ভাবে কোনও নিদর্শনের বয়স নির্ণয় করতে পারে।
এর আগে গবেষকদের সিংহভাগই বিশ্বাস করতেন যে, ১৩৮০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ২ হাজার ৩০০ বছর আগে হিটাইটরাই লোহার আবিষ্কার করে। হিটাইট রাজত্বের ভৌগোলিক অঞ্চলে (বর্তমান তুরস্ক) হেমাটাইট লোহার আকরিকও প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। তাই এই ধারণাটিই বহুল ভাবে গৃহীত হয়। যদিও পরে এ নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছে। পুরাতত্ত্ববিদ তথা অধ্যাপক রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘লৌহযুগ নিয়ে বিতর্ক বহু দিন ধরেই চলছে। আগে মনে করা হত বাইরে থেকে ভারতে লোহার আগমন। পরে সে নিয়েও চর্চা হয়। এর আগেও ভারতের নানা জায়গায় খ্রিস্টপূর্ব ১২০০ কিংবা ২০০০ অব্দের লোহার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। তবে এই গবেষণাপত্রে মেগালিথিক সংস্কৃতি এবং দ্রাবিড়ীয় সংস্কৃতির পাশাপাশি লৌহযুগের সংস্কৃতি নিয়েও আলোচনা রয়েছে।’’
নিদর্শনগুলি পাওয়া গিয়েছে তুতিকোরিনের শিবগালাই, মাঙ্গাদু, কিলনামান্ডি, থেলুঙ্গানুর এবং আদিচানাল্লুর থেকে। এর মধ্যে শিবগালাইয়ের নিদর্শনগুলির কোনও কোনওটি ২ হাজার ৯৫৩ থেকে ৩ হাজার ৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দের। অর্থাৎ, আজ থেকে প্রায় ৫,৩০০ বছরের পুরনো! আর এর পরেই শুরু হয়ে গিয়েছে জল্পনা, তবে কি বিশ্বে লৌহযুগের সূচনা হয়েছিল তামিলনাড়ুতেই? অধ্যাপক রূপেন্দ্রকুমারের কথায়, ‘‘একটি নিদর্শনের উপর ভিত্তি করে এখনই এত সরলীকরণ করা বাঞ্ছনীয় হবে না। তবে এই গবেষণা যে গুরুত্বপূর্ণ, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।’’
কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পুরাতত্ত্ববিদ দিলীপকুমার চক্রবর্তী বলছেন, ‘‘এই গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম। আমার মনে হয়, সেই সময়ের কিছু হরপ্পান সাইটেও লোহার নিদর্শন থাকা উচিত। গাঙ্গেয় উপত্যকার মালহার থেকে পাওয়া নিদর্শনগুলি প্রমাণ করে যে, খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দের সূচনাকালে ভারতের বিভিন্ন জায়গায় লোহা আদানপ্রদানের চল ছিল। এ নিয়ে আরও গবেষণা হওয়া উচিত। তবে এই আবিষ্কারের জন্য প্রত্নতাত্ত্বিকদের অভিনন্দন জানাই।’’