রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী অশোক গহলৌত এবং কংগ্রেস নেতা সচিন পাইলটের সঙ্গে রাহুল গান্ধী। বৃহস্পতিবার রাজস্থানের চুরুতে। ছবি: পিটিআই।
ছবির নাম ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’। মুক্তি পেয়েছিল ১৯৯৯ সালে। প্রধান চরিত্রে ছিলেন সলমন খান, সইফ আলি খানেরা। পরিচালকের নাম সুরজ বারজাতিয়া। ছবির বেশ কিছু অংশের শ্যুটিং হয়েছিল রাজস্থানের যোধপুরে। অশোক গহলৌত সে বারই প্রথম রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। সচিন পাইলটের বয়স তখন মাত্র ২২ বছর। রাজনীতিতে তখনও পা দেননি। বিদেশ থেকে এমবিএ পাশ করে ভারতে ফিরে চাকরি-বাকরি করছেন।
রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনের প্রচার শেষের মাত্র এক সপ্তাহ আগে বৃহস্পতিবার ফের ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ মুক্তি পেল। এ বার প্রধান চরিত্রে অশোক গহলৌত ও সচিন পাইলট। পরিচালকের নাম রাহুল গান্ধী। এই ছবির শ্যুটিং-ও গত দু’দিন ধরে রাজস্থানেই চলছিল। অশোক গহলৌত এখনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মাঝে দু’বার ক্ষমতা হারিয়ে ফের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে তৃতীয় দফার মেয়াদ শেষ করতে চলেছেন। আর সচিন পাইলট এখন কংগ্রেসের মধ্যে সেই মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার।
এক মাস সাত দিন আগে রাজস্থানের ভোটের দিনক্ষণ ঘোষণা হয়েছে। ২৫ নভেম্বর ভোটগ্রহণ। প্রচার শেষ হতে আর মাত্র সাত দিন বাকি। এত দিন রাজস্থান কংগ্রেসের দুই নেতাকে কোনও ছবিতে এক ফ্রেমে দেখা যায়নি। রাহুল গান্ধীও এত দিন রাজস্থানে প্রচার করেননি। অবশেষে বৃহস্পতিবার সকালে রাহুল গান্ধী এক ফ্রেমে নিয়ে এলেন গহলৌত, পাইলটকে। রাজস্থানে প্রচারে নামার আগে রাহুল দুই যুযুধান নেতাকে পাশে নিয়ে বললেন, “দু’জনকে শুধু এক সঙ্গে দেখাই যাচ্ছে না, দু’জনে এক সঙ্গেই রয়েছেন। এক সঙ্গেই থাকবেন। আমরা রাজস্থান বিপুল ভোটে জিততে চলেছি।” দুই নেতাকে পাশে নিয়ে বৃহস্পতিবার রাহুল রাজস্থানে পরপর তিনটি জনসভাও করলেন। প্রথমে চুরু। তার পরে শ্রীগঙ্গানগর। শেষে হনুমানগড়। জনসভায় গহলৌত ও পাইলটকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে, দু’জনের হাতে হাত ধরিয়ে ছবিও তোলালেন। রাহুল গান্ধীর পরিচালনায় কংগ্রেস এই ছবিরই নামকরণ করল ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’।
‘ম্যায়নে প্যার কিয়া’ বা ‘হাম আপকে হ্যায় কউন’-এর মতো সাড়া না ফেললেও সুরজ বারজাতিয়ার ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ বক্সঅফিসে ‘হিট’ করেছিল। রাহুলের ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’ কি রাজস্থান নির্বাচনের বক্সঅফিসে ‘হিট’ করবে?
গত তিরিশ বছর ধরে রাজস্থানের বিধানসভা নির্বাচনের একটিই নিয়ম। একবার বিজেপি ক্ষমতায় আসে, একবার কংগ্রেস। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পালাবদল। সেই নিয়ম মানলে এ বার কংগ্রেসকে সরিয়ে রাজস্থানে বিজেপির ক্ষমতায় আসার কথা। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপিকে ধাক্কা দিতে গোটা কংগ্রেস এ বার প্রবল ভাবে চাইছে, তিন দশকের নিয়ম পাল্টে রাজস্থানে এ বার কংগ্রেস ক্ষমতায় আসুক। কিন্তু তাতে প্রধান বাধা, রাজস্থান কংগ্রেসের দুই প্রধান চরিত্রের দ্বন্দ্ব।
গোলাপি শহর জয়পুরের সন্ধ্যায় বিখ্যাত আড্ডাখানা হল সিন্ধি ক্যাম্প এলাকায় ‘গুলাবজি চায়ওয়ালে’-র দোকান। ১৯৪৬-এ চায়ের দোকান খুলেছিলেন গুলাব সিংহ। এখন তাঁর দুই নাতি মিলে দোকান সামলান। এক জন ছেলের ঘরের নাতি, অন্য জন মেয়ের ঘরের নাতি। পুরনো কলকাতার মতো কাঁচের সরু লম্বা গ্লাসে চায়ে চুমুক দিয়ে কংগ্রেসের এক নেতা আফসোস করছিলেন, “গুলাবজির দুই নাতি যদি ঝগড়া না করে এত পুরনো ব্যবসা সামলাতে পারে, তা হলে আমাদের দুই নেতা একসঙ্গে কাজ করতে পারেন না কেন?”
তিন বছর আগে সচিন পাইলট মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিতে বিদ্রোহ করেছিলেন। গহলৌত তখন ‘নিষ্কর্মা’, ‘অপদার্থ’ কিছুই বলতে বাকি রাখেননি। গত বছর যখন সনিয়া গান্ধী গহলৌতকে কংগ্রেস সভাপতি করে পাইলটকে মুখ্যমন্ত্রী করতে উদ্যোগী, তখন গহলৌতের ইশারায় তাঁর অনুগামীরা বিদ্রোহ করেছিলেন। তার পরে কংগ্রেস হাইকমান্ডের নির্দেশে দুই নেতা আর ঝগড়া করেননি। কিন্তু অশান্তি মেটেনি।
পাইলটকে প্রশ্ন করলে তিনি বলছেন, “আমি তো হাইকমান্ডের নির্দেশে সবাইকে ক্ষমা করে দিয়েছি। যা হয়ে গিয়েছে, তা মিটে গিয়েছে ভেবে ভুলে গিয়েছি। আমি তো রাজ্য সরকারের কাজ নিয়ে সরব হয়েছিলাম। হাইকমান্ডের নির্দেশ অমান্য করিনি। সেটা করে আসলে বিদ্রোহ কে করেছিলেন?” কংগ্রেস কোনও ‘মিরাকল’ করে ক্ষমতায় এলে মুখ্যমন্ত্রী কে হবেন? গহলৌত বলছেন, “আমি তো মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি ছাড়তেই চাই। কুর্সিই আমায় ছাড়তে চায় না।” পাইলট বলছেন, “কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরলে কংগ্রেস হাইকমান্ড ঠিক করবে, কে মুখ্যমন্ত্রী হবেন।” গহলৌত তা শুনে বলছেন, “পাইলটই তো এখন কংগ্রেস হাইকমান্ড। দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য।”
সনিয়া, রাহুল গান্ধী গত দু’দিন ধরে জয়পুরে। তাঁদের সাক্ষী রেখে কে সি বেণুগোপাল দুই নেতার দ্বন্দ্ব মেটানোর চেষ্টা করেছেন। তারই পরিণতি বৃহস্পতিবারের ছবি ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’। তাতে কি লাভ হবে? জয়পুরে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরের এক পোড়খাওয়া নেতা মনে করিয়ে দিলেন, মনে পড়ে, ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’-এর শ্যুটিংয়ের সময় সলমন খান জোড়া কৃষ্ণসার হরিণ শিকার করে ফেঁসে গিয়ে জেলে গিয়েছিলেন। কংগ্রেসের ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’-এর শ্যুটিংয়ের সময় কে কাকে শিকার করল, কে ফেঁসে গেল, সেটাই আসল প্রশ্ন!