গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
মোদী সরকারের কেউ মুখ খুললেন না। আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোনও তদন্তও শুরু হল না।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শিল্পপতি গৌতম আদানির বিরুদ্ধে আমেরিকার আদালতে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ জমা পড়ার পরে দু’দিন কেটে গেলেও মোদী সরকার এ নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটে রইল। বিরোধীদের দাবি সত্ত্বেও সিবিআই, ইডি বা অন্য কোনও কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এ নিয়ে তদন্ত শুরু করেনি। অথচ আদানিদের বিরুদ্ধে ভারতেরই একাধিক রাজ্যে ঘুষ দিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বেচার বরাত আদায়ের অভিযোগ উঠেছে।
শুধু আদানি গোষ্ঠী কোনও তথ্য গোপন করেছিল কি না, শেয়ার বাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি বিভিন্ন স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে তা জানতে চেয়েছে বলে সূত্রের খবর। আমেরিকার আদালতে আদানি গোষ্ঠী সেবি-কে মিথ্যে তথ্য দিয়েছে বলেও অভিযোগ জমা পড়েছে। আদানিরা আমেরিকার শেয়ার বাজার সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য টাকা তুলেছে। কিন্তু সৌর বিদ্যুৎ বেচার বরাত যে ঘুষ দিয়ে আদায় করা হচ্ছে, তা গোপন করে গিয়েছে। একই ভাবে আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই যে গৌতম আদানির ভাইপো সাগরের ঠিকানায় তল্লাশি চালিয়েছিল, তা এ দেশে সেবি-র কাছে চেপে গিয়েছিল তারা। ২০২৩-এর ১৭ মার্চ এফবিআই সাগর আদানির ঠিকানায় হানা দিয়েছিল। শেয়ার বাজারে নথিভুক্ত সংস্থা হিসেবে ‘লিস্টিং অবলিগেশন অ্যান্ড ডিসক্লোজ়ার রিকোয়ারমেন্টস’-এর শর্ত মেনে আদানি গোষ্ঠীর তা সেবি-কে জানানোর দায়বদ্ধতা ছিল।
সূত্রের দাবি, আপাতত সেবি শুধু স্টক এক্সচেঞ্জের কাছে এ বিষয়ে আদানি গোষ্ঠীর খামতি ছিল কি না, তা জানতে চেয়েছে। এখনও আদানি গোষ্ঠী বা তার কোনও সংস্থার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়নি। আইন অনুযায়ী, এই খামতি ধরা পড়লে আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ, মোটা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু বিরোধীদের প্রশ্ন, সেবি-র প্রধান মাধবী পুরী বুচ নিজেই আদানিদের সঙ্গে জড়িত। আগেই সেই অভিযোগ উঠেছে। বিরোধীরা তাঁকে সেবি-র প্রধানের পদ থেকে সরানোর দাবি তুললেও মোদী সরকার কোনও পদক্ষেপ করেনি। মাধবীর নেতৃত্বে সেবি আদৌ আদানিদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করবে কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ ছাড়া, প্রতিযোগিতা কমিশনের চেয়ারপার্সন রভনীত কউর ইঙ্গিত দিয়েছেন, আদানি নিয়ে যদি কোনও অভিযোগ প্রতিযোগিতা কমিশনে জমা পড়ে তখনই তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হবে। কলকাতায় মার্চেন্টস চেম্বারের সভায় এ দিন তিনি বলেন, সংবাদমাধ্যমের রিপোর্টের উপরে ভিত্তি করে কোনও পদক্ষেপ করা হবে না। অথচ আমেরিকার ভারতীয় বংশোদ্ভূত আইনজীবী রবি বাত্রার মতে, ‘‘আমেরিকার অ্যাটর্নি ব্রেয়ন পিস গৌতম আদানি এবং আরও সাত জন অভিযুক্তকে গ্রেফতারি পরোয়ানা পাঠাতে পারেন, সে তাঁরা যে দেশেই থাকুন না কেন।’’
লোকসভার বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধী আজ ফের এ নিয়ে সরব হয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, গৌতম আদানি নরেন্দ্র মোদীকে অর্থ জোগান। তার বিনিময়ে মোদী আদানির হাতে দেশের সরকারি সম্পত্তি তুলে দেন। ওঁরা পরস্পরকে রক্ষা করেন। কিন্তু এর খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। আদানি ঘুষ দিয়ে বাজারের থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ বেচলে সেই দাম আমজনতাকে মেটাতে হচ্ছে। এই দুর্নীতি সামনে আসায় আদানির ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে রাখা শেয়ার দর পড়ে যায়। তাতেও সাধারণ লগ্নিকারীদের লোকসান হয়। যখন বন্দর, বিমানবন্দর, সিমেন্ট সংস্থা, প্রতিরক্ষা সংস্থা সব আদানির হাতে চলে যায়, তখন আদানির মুনাফার টাকা আমজনতার পকেট থেকে আসে। রাহুলের বক্তব্য, ‘‘এই খেলাটা বুঝতে হবে। এই খেলায় হার সব সময় জনতার হবে।’’
আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা ঘুষ দিয়ে ২০২০ থেকে ২০২৪-এর মধ্যে ওড়িশা, অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়, তামিলনাড়ু এবং জম্মু-কাশ্মীরে বেশি দামে সৌর বিদ্যুৎ বেচার বরাত আদায় করেছিলেন। এর মধ্যে ওড়িশায় তখন বিজু জনতা দলের সরকার, অন্ধ্রে ওয়াইএসআর কংগ্রেসের সরকার ছিল। ছত্তীসগঢ়ে ছিল কংগ্রেসের সরকার। ওড়িশা, ছত্তীসগঢ়ে এখন বিজেপি সরকার। অন্ধ্রে বিজেপির প্রধান শরিক চন্দ্রবাবু নায়ডুর তেলুগু দেশমের সরকার। অন্ধ্রের মুখ্যমন্ত্রী নায়ডু বলেছেন, তিনি আদানির বিরুদ্ধে চার্জশিট খতিয়ে দেখবেন। তার পরে পদক্ষেপ করবেন।
বিজেপি শিবিরের আশঙ্কা, চন্দ্রবাবু তাঁর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডিকে বিপাকে ফেলতে তদন্ত শুরু করতে পারেন। কারণ, আদানিরা জগন্মোহন সরকারের পদাধিকারীকেই ১৭৫০ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু সেই তদন্ত শুরু হলে আদানিদের চুক্তি, আদানির সঙ্গে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সোলার এনার্জি কর্পোরেশনের লেনদেন নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে।
বিরোধীদের অভিযোগ, একই কারণে ওড়িশা এবং ছত্তীসগঢ়ের বিজেপি সরকার তদন্তের কথা বলছে না। অথচ আদানিরা এই দুই রাজ্যেই ঘুষ দিয়ে বেশি দামে বিদ্যুৎ বেচেছে বলে অভিযোগ। আজ বিজু জনতা দল ঘুষের অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বিজু জনতা দলের নেতা তথা নবীন পট্টনায়ক সরকারের জ্বালানিমন্ত্রী পি কে দেবের দাবি, এই অভিযোগ ভিত্তিহীন।