Parliament Security Breach

সকালে শহিদ স্মরণ, দুপুরে মৃত্যু-আতঙ্ক! সংসদের নয়া ভবনে ২০০ দিনের মধ্যেই নিরাপত্তাহীনতার আঘাত

লোকসভার অন্দরে রং বোমাকাণ্ড চলাকালীনই সংসদ ভবনের বাইরে ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’ স্লোগান তোলেন দুই বিক্ষোভকারী। তাঁদের মধ্যে এক মহিলাও ছিলেন। দ্রুত তাঁদের আটক করে পুলিশ।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৩ ২৩:৪৬
An image of Parliament Security Breach

বাঁ দিকে, দর্শক আসন থেকে ফ্লোরে ঝাঁপ মারার ঠিক আগের মুহূর্ত। ডান দিকে, রং বোমা ছোঁড়ার পর সাংসদদের মধ্যে হুলস্থুল। ছবি: পিটিআই এবং এক্স।

গত ২৮ মে বিপুল আড়ম্বরে নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ঐতিহাসিক রাজদণ্ড ‘সেঙ্গোল’। সেপ্টেম্বরে গণেশ চতুর্থীর দিনে শুরু হয়েছিল নতুন ভবনে অধিবেশন। কিন্তু উদ্বোধনের ২০০ দিন পেরনোর আগেই প্রশ্নে পড়ে গেল নয়া সংসদ ভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিজেপির এক সাংসদের দেওয়া প্রবেশপত্র পকেটে পুরে, জুতোয় রং বোমা লুকিয়ে সংসদ ভবনে ঢুকে পড়লেন দুই যুবক। তার পরে অধিবেশন চলাকালীন দুপুর ১টার কিছু পরে লোকসভার দর্শক আসন থেকে ফ্লোরে ঝাঁপ মেরে ছুড়তে থাকলেন সেই ‘স্মোক ক্র্যাকার’!

Advertisement

লোকসভার অন্দরে রং বোমাকাণ্ড চলাকালীনই সংসদ ভবনের বাইরে ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’ স্লোগান তোলেন দুই বিক্ষোভকারী। তাঁদের মধ্যে এক মহিলাও ছিলেন। দ্রুত তাঁদের আটক করে পুলিশ। যদিও লোকসভার ফ্লোরে ঝাঁপ মারা দু’জনকে ঠেকাতে মার্শাল বাহিনীকে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। লোকসভারই দুই সাংসদ, উত্তরপ্রদেশের মালুন নাগর (বহুজন সমাজ পার্টি) এবং রাজস্থানের হনুমান বেনীওয়াল (রাষ্ট্রীয় লোকতান্ত্রিক পার্টি) পাকড়াও করেন তাঁদের। এর পরে ওই দুই যুবককে কয়েক জন সাংসদ মিলে শারীরিক নিগ্রহ করেন বলেও অভিযোগ। লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীর চৌধুরী বলেন, ‘‘দু’জন গ্যালারি থেকে হঠাৎ ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁদের হাতে কিছু ছিল। হলুদ রঙের গ্যাস বেরোচ্ছিল তা থেকে। আমাদের সাংসদেরাই তাঁদের ধরে ফেলেন। পরে নিরাপত্তারক্ষীরা হানাদারদের ধরে বার করে আনেন।’’

ঘটনাচক্রে, বুধবারই ছিল সংসদে হামলার ২২ বছর পূর্তি। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় ১৩ ডিসেম্বর সংসদ ভবনে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় ন’জন নিহত হয়েছিলেন। বুধবার সকালে সে দিনের সন্ত্রাসে নিহত নিরাপত্তা কর্মীদের স্মরণ করেই শুরু হয়েছিল সংসদের দু’কক্ষের শীতকালীন অধিবেশন। তার কিছুক্ষণ পরেই সেই তারিখ মিলিয়ে হানাদারি। এর ফলে দুইয়ের মধ্যে কোনও যোগ আছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদিও বুধবার ওই অনুপ্রবেশকারীরা হিংসার আশ্রয় নেননি। তাঁদের গ্রেফতারির পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ যে তথ্য পেয়েছে, সেখান থেকে এটা স্পষ্ট যে চার জনই পরস্পরের পূর্বপরিচিত। তবে তাঁদের পরিচয় হয়েছিল সমাজমাধ্যমে।

ঘটনার জেরে সংসদের নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহকে নিশানা করেছে বিরোধীরা। তৃণমূলের এক্স হ্যান্ডলে লেখা হয়েছে, ‘‘নতুন ভারত। নতুন সংসদ। নতুন আইন। সেই পুরনো নিরাপত্তার গাফিলতি। পুরনো সংসদ ভবনে সন্ত্রাসবাদী হামলার ঘটনার ২২তম বার্ষিকীতে আজ দু’জন ক্যান নিয়ে ঢুকে পড়ে যা থেকে হলুদ গ্যাসের নির্গত হচ্ছিল। দর্শক গ্যালারি থেকে লাফ দিয়ে তারা লোকসভার অধিবেশন কক্ষেও প্রবেশ করে।’’ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বিরুদ্ধে গাফিলতির অভিযোগ করে আরও লেখা হয়েছে, ‘‘কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের নেতৃত্বাধীন দিল্লি পুলিশের নজরদারিতেই এমন ঘটনা ঘটে গেল। কী ভাবে গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় নিরাপত্তার এমন গাফিলতির ঘটনা ঘটল? কাদের নামের পাস ওদের দেওয়া হয়েছিল?’’

বিজেপি সাংসদের অনুপতিপত্র নিয়েই হানাদারি!

সংসদের নিয়ম অনুযায়ী প্রবেশপত্র বা অনুমতিপত্র থাকলে কেউ প্রবেশ করতে পারেন সংসদ ভবনে। উঁচু দর্শক গ্যালারিতে বসে দেখতে পারেন লোকসভা, রাজ্যসভার অধিবেশন। আবার এই প্রবেশাধিকার পাওয়া যায় সাংসদের আনুকূল্যে। সাংসদদের অতিথি হলেও সংসদের গ্যালারিতে গিয়ে বসা যায়। দিল্লি পুলিশ জানিয়েছে, বুধবার লোকসভার অধিবেশন কক্ষে রং বোমা ছুড়ে ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’ স্লোগান তোলা দুই যুবক, সাগর শর্মা এবং মনোরঞ্জন ডি কর্নাটকের মাইসুরুর বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিংহের দেওয়া সুপারিশপত্রের জেরেই সংসদ ভবনে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন। বসতে পেরেছিলেন লোকসভার দর্শক আসনে।

সাংবাদিক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করে ২০১৪ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন প্রতাপ। নরেন্দ্র মোদীকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখে আগেই বিজেপি নেতৃত্বের চোখে পড়েছিলেন। পরে ২০১৪ সালে যখন মোদীকে ‘প্রধানমন্ত্রীর মুখ’ বানিয়ে লোকসভা ভোটে লড়াইয়ে নামে বিজেপি, টিকিট জোটে প্রতাপের বরাতে। জিতেও যান তিনি। তার পর ২০১৯ সালেও মাইসুরুর লোকসভা কেন্দ্র থেকে ভোটে দাঁড়িয়েছেন এবং জিতেছেন প্রতাপ।

কর্নাটকের রাজনীতিতে শুরু থেকেই বিতর্কিত প্রতাপ। তাঁর তীব্র হিন্দুত্ববাদ এবং ইসলাম বিরোধিতার জন্য বিভিন্ন মহলে সমালোচিতও। টিপু সুলতানের জন্মদিন পালনে কর্নাটক সরকারের তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন প্রতাপ। সে সময় মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়ার সরকারের সমালোচনা করে বলেছিলেন, ‘‘এই সরকার জিহাদিদের উৎসাহিত করছে।’’

কী সাফাই সেই বিজেপি সাংসদের?

কর্নাটকের মাইসুরুর বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিংহের দেওয়া অনুমতিপত্রের সৌজন্যেই লোকসভার অন্দরে ঢুকতে পেরেছিলেন ‘প্রতিবাদী’ দুই যুবক সাগর শর্মা এবং মনোরঞ্জন ডি। যা নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা। উঠেছে বরখাস্তের দাবিও। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করেননি প্রতাপ। ইন্ডিয়া টুডে জানিয়েছে, বুধবার লোকসভায় যা ঘটেছে, তার পর স্পিকার ওম বিড়লার কাছে গিয়েছিলেন প্রতাপ। সেখানেই তিনি ‘কৈফিয়ৎ’ দিয়ে এসেছেন।

সূত্রের খবর, প্রতাপ স্পিকারের কাছে জানিয়েছেন, কেন তিনি দু’জনকে সংসদের অনুমতিপত্র দিয়েছিলেন। প্রতাপের অতিথি হয়েই লোকসভার গ্যালারিতে স্থান পেয়েছিলেন সাগর শর্মা এবং মনোরঞ্জন ডি। সেখান থেকে হঠাৎ তাঁরা ফ্লোরে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং হলুদ রং বোমা ছুড়ে স্লোগান দেন। প্রতাপের বক্তব্য, সাগর নামের ওই যুবকের বাবা শঙ্করলাল শর্মা তাঁর পরিচিত। প্রতাপের কেন্দ্র মাইসুরুতেই তিনি থাকেন। শঙ্করই বার বার অনুরোধ করেছিলেন, তাঁর পুত্র সাগরকে নতুন সংসদ ভবনটি দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। দীর্ঘ দিন ধরে সেই ‘পাস’ জোগাড় করার জন্য প্রতাপের দফতরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছিলেন শঙ্কর। স্পিকারের কাছে বিজেপি সাংসদ জানিয়েছেন, অনুপ্রবেশকারী সাগরের বিষয়ে এর চেয়ে বেশি কিছু তথ্য তাঁর কাছে নেই।

জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলল তৃণমূল

লোকসভায় হানাদারির ঘটনা নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন তুলল তৃণমূল। বুধবার দুপুরে লোকসভার গ্যালারি থেকে ফ্লোরে ঝাঁপ মেরে রং বোমা ছোড়ার ঘটনায় ধৃত দুই যুবক যে বিজেপি সাংসদের দেওয়া প্রবেশপত্র নিয়ে সংসদ ভবনের ভিতরে ঢুকেছিল, সেই প্রতাপ সিংহের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ারও দাবি তুলেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল।

তৃণমূল সাংসদ দোলা সেন বুধবার সংসদ ভবন চত্বরে বলেন, ‘‘যদি আমাদের মাননীয়া সাংসদ মহুয়া মৈত্র যদি জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে বহিষ্কৃত হতে পারেন, তা হলে বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিমহা কেন ছাড় পাবেন?’’ জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ভূমিকাকে ধিক্কারও জানান তিনি। দোলা বলেন, ‘‘লোকসভায় ঢুকে ধোঁয়া বোমা ছোড়া হল। আরও বড় কিছু ঘটতে পারত। এটা কি জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে আশঙ্কা নয়? এথিক্স কমিটি কোথায় গেল?’’

কারা চালাল হানাদারি?

দিল্লি পুলিশের তরফে জানানো হয়েছে, বুধবার দুপুরে যে দুই যুবক লোকসভার দর্শক আসন থেকে ফ্লোরে ঝাঁপ মেরেছিলেন, তাঁদের নাম সাগর শর্মা এবং মনোরঞ্জন ডি। একই সময় সংসদ ভবনের বাইরের নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে ঢুকে ‘তানাশাহি নেহি চলেগা’ স্লোগান তোলা দু’জনের নাম আনমোল শিন্ডে এবং নীলম সিংহ।

বুধবার রাত পর্যন্ত দিল্লি পুলিশের তদন্তে যে তথ্য মিলছে, সেখান থেকে জানা যাচ্ছে, বুধবারের ঘটনার পিছনে আরও দু’জন রয়েছেন। বস্তুত, তাঁদের পুরো পরিকল্পনাই হয়েছিল সমাজমাধ্যমে যোগাযোগের মাধ্যমে। পুলিশের দাবি, ছ’জন আলোচনা করে ঠিক করেন যে, সংসদের ভিতরে ঢুকে দু’জন ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি করবেন। দু’জন থাকবেন সংসদের বাইরে। তবে আরও দু’জনের গতিবিধি জানার চেষ্টা করছে পুলিশ।

প্রাথমিক তদন্তে উঠে এসেছে, ছ’জনের কেউই দিল্লি শহরের বাসিন্দা নন। কেউ কর্নাটকের বাসিন্দা তো কেউ মহারাষ্ট্রের। তাঁরা সবাই দেখা করেন গুরুগ্রামে। সেখানে ললিত ঝা নামে এক জনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সাগর নামে যে যুবক মাইসুরুর বিজেপি সাংসদের অতিথি হিসাবে সংসদে ঢুকেছিলেন তাঁর বাবার নাম শঙ্করলাল শর্মা। আবার সাগর লখনউয়ে ই-রিকশা চালান বলে খবর। ছেলের কাণ্ড শুনে সাগরের মা বলেন, ‘‘আমার কোনও ধারণাই নেই। আমি এ সব দেখে অবাক হয়ে গিয়েছি। ও বন্ধুদের সঙ্গে কোথায় একটা যাচ্ছে বলে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। বলেছিল, দু’দিনের মধ্যে ফিরবে।’’

মনোরঞ্জনের বাড়ি কর্নাটকের মাইসুরুতে। ৩৫ বছরের ওই যুবক কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে বিটেক করেছেন বেঙ্গালুরুর বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। মনোরঞ্জনের বাবা দেবরাজ গৌড়া একটি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, তাঁর ছেলে সৎ এবং সমাজসেবামূলক কাজে জড়িত। চ্যালেঞ্জের সুরে তিনি বলেন, ‘‘যদি সত্যিও ও কোনও ভুল করে থাকে, তা হলে শাস্তি হোক। সংসদ আমাদের সবার। মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল নেহরুর মতো মহান মানুষদের পরিশ্রম রয়েছে। আমার ছেলে কোনও ভুল করে থাকলে ওকে ফাঁসি দেওয়া হোক।’’

সংসদ ভবনের বাইরে ধৃত নীলম নামের তরুণী হরিয়ানার হিসরে একটি হস্টেলে থাকেন। হরিয়ানার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। নীলমের সঙ্গী আনমোল নামে ২৫ বছরের যুবকের বাড়ি মহারাষ্ট্রের লাতুর জেলায় বলে প্রাথমিক তদন্তে জেনেছে পুলিশ।

হানাদারির অস্ত্র এ বার রং বোমা

জুতোর মধ্যে লুকিয়ে রাখা ইঞ্চি পাঁচেক লম্বা হলুদ রঙের প্লাস্টিকের পাইপের আকৃতির দু’মুখ বন্ধ খোল (ইংরেজিতে যার নাম ক্যানিস্টার)। ভিতরে ভরা রঙের গুঁড়ো। ছিপি খুলে ছুড়ে মারলেই যার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসে সবজেটে হলুদ ধোঁয়া। বুধবার দুপুরে দুই হানাদারের এই অস্ত্রই লোকসভায় ফিরিয়ে আনল ২২ বছর আগেকার, ২০০১ সালের ১৩ ডিসেম্বরের জঙ্গিহানার স্মৃতি। পুলিশ সূত্রের খবর, ‘স্মোক ক্যান’ বা ‘স্মোক ক্র্যাকার’ নামে পরিচিত এই রং বোমা দেশে খোলাবাজারেই কেনা যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে সঙ্কেত পাঠানো থেকে খেলার ময়দানে জয় উদ্‌যাপন পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে এটি ব্যবহার করা হয়। ইউরোপের বিভিন্ন ফুটবল ক্লাবের সমর্থকদের মধ্যে প্রিয় দলের রঙের ‘স্মোক ক্র্যাকার’ ব্যবহারের রেওয়াজ রয়েছে। তবে সাধারণ ভাবে সেনাবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থান গোপন করতে যে ‘স্মোক বম্ব’ বা ‘স্মোক সেল’ ব্যবহার করে তার মতো ঘন ধোঁয়া হয় না বুধবার দুই হানাদারের ব্যবহৃত ‘অস্ত্রে’।

লোকসভার অন্দরে ‘অস্ত্রের ব্যবহার’ অবশ্য এই প্রথম বার নয়। ৯০-এর দশকে পিস্তল হাতে অধিবেশন কক্ষে ঢুকে পড়েছিলেন বিহারের সাংসদ আনন্দমোহন সিংহ। গুলি না-চালালেও পিস্তল উঁচিয়ে দেখিয়েছিলেন তিনি। যার জেরে কক্ষ থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল তাঁকে। প্রাক্তন সাংসদ লাভলি সিংহের স্বামী আনন্দমোহনের বিরুদ্ধে অবশ্য একাধিক অপরাধের অভিযোগ ছিল। বিহারের গোপালগঞ্জের জেলাশাসককে খুনের মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে প্রায় আড়াই দশক জেল খাটার পরে চলতি বছরেই মুক্তি পেয়েছেন তিনি।

২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের সরকার লোকসভায় অবিভক্ত অন্ধ্রপ্রদেশ ভেঙে পৃথক তেলঙ্গানা রাজ্য গঠনের বিল পেশের সময় প্রবল অশান্তি হয়েছিল লোকসভায়। সে সময় তেলঙ্গানা বিলের বিরোধী কংগ্রেস সাংসদ লাকড়াপতি রাজাগোপাল পেপার-স্প্রে প্রয়োগ করেছিলেন। লোকসভার ইতিহাসে ‘মরিচ কাণ্ড’ বলে পরিচিতি পেয়েছিল সেই ঘটনা। চোখে প্রবল জ্বলুনির কারণে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয়েছিল তিন সাংসদকে। বিজয়ওয়াড়ার সাংসদ রাজাগোপাল অবশ্য তাঁকে বহিষ্কারের সুযোগ না দিয়েই ইস্তফা দিয়েছিলেন লোকসভা থেকে।

হানার জেরে বদল নিরাপত্তাবিধি

কী ভাবে, মার্শালদের নজরদারি এড়িয়ে দুই ব্যক্তি বিনা বাধায় দর্শক আসন থেকে সাংসদ গ্যালারিতে ঝাঁপ দিলেন, কী ভাবে গ্যাস ভরা রং-বোমা জুতোয় লুকিয়ে ত্রিস্তরীয় নিরাপত্তা বলয় টপকে অধিবেশন কক্ষে ঢুকতে পারলেন, সে প্রশ্নও উঠে ইতিমধ্যেই। ঘটনার পরেই বুধবার বিকেল ৪টেয় সংসদের নিরাপত্তা নিয়ে সর্বদল বৈঠক ডাকা হয়। পাশাপাশি, সাময়িক ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় সংসদ ভবনে দর্শকদের প্রবেশ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।

এরপর সংসদ সচিবালয়ের তরফে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে চিঠি পাঠিয়ে সংসদ ভবনের নিরাপত্তা আঁটসাঁট করার জন্য একগুচ্ছ প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রবেশকারীদের খানাতল্লাশির জন্য বডি স্ক্যানার বসানো থেকে সাংসদ, সংসদের কর্মী, সাংবাদিক এবং দর্শকদের জন্য আলাদা প্রবেশপথ নির্দিষ্ট করার মতো পদক্ষেপ রয়েছে সেই তালিকায়। তা ছাড়া দর্শক আসন থেকে যাতে কেউ লোকসভা বা রাজ্যসভার ফ্লোরে ঝাঁপ না মারতে পারেন, সে জন্য হচ্ছে অভিনব ব্যবস্থা। মূল অধিবেশন কক্ষ ও দর্শক আসনের মধ্যে বসবে কাচের দেওয়াল। দর্শকদের বেপরোয়া আচরণ ঠেকাতে অধিবেশন চলাকালীন নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যাও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে লোকসভা সচিবালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে। নতুন নিরাপত্তা ব্যবস্থা চালু না হওয়া পর্যন্ত দর্শকদের জন্য বন্ধ থাকবে সংসদ ভবন।

আগেও এমন ঝাঁপ দেখেছে লোকসভা!

আট বছর আগেও লোকসভার দর্শক আসন থেকে ঝাঁপ দিয়ে ভবনে পড়েছিলেন এক যুবক। ঘটনাচক্রে, এ বারের মতোই বিজেপি সাংসদের দেওয়া অনুমতিপত্র নিয়েই। ২০১৬ সালের ২৫ নভেম্বরে ওই ‘অতিথি’ তখন চিৎকার করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নোটবন্দির সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করছেন। এমন হুড়োহুড়ি শুরু হয় যে দুপুর পর্যন্ত অধিবেশন মুলতুবি করে দেন লোকসভার তৎকালীন স্পিকার সুমিত্রা মহাজন।

ঝাঁপ দিয়ে পড়া ওই ব্যক্তিকে নিরাপত্তারক্ষীরা সরিয়ে নিয়ে যান। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, তাঁর নাম রাকেশ সিংহ বঘেল। তিনি বুলন্দশহরের বিজেপি সাংসদ ভোলা সিংহের অতিথি হয়ে সংসদে ঢুকে পড়েন। পরে সংবাদ সংস্থা এএনআইকে বলেন, ‘‘৫০০ এবং ১০০০ টাকা নোট বন্ধের প্রতিবাদ করতে এসেছিলাম।’’ ওই ঘটনায় সংসদে বেশ হুলস্থুল পড়ে যায়। পরে ওই ব্যক্তি সম্পর্কে তথ্য জানার পর স্পিকার সুমিত্রা সংসদে জানান, বঘেল মধ্যপ্রদেশের শিবপুরী জেলার বাসিন্দা।

Advertisement
আরও পড়ুন