মহারাষ্ট্রে ‘জুটির’ জোর। (বাঁ দিক থেকে) বিজেপির দেবেন্দ্র ফডণবীস, শিবসেনার একনাথ শিন্ডে এবং এনসিপির অজিত পওয়ার। —ফাইল চিত্র।
মহারাষ্ট্রে ভোটপ্রচারে গিয়ে ‘এক হ্যায় তো সেফ হ্যায়’ (ঐক্যবদ্ধ থাকলে নিরাপদে থাকা যাবে) স্লোগান তুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। ভারতের ধনীতম রাজ্যের বিধানসভা ভোটের ফলাফল বলছে, ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জাদুমন্ত্রেই ছন্নছাড়া বিরোধী জোটকে পরাস্ত করল বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ। হালে পানিই পেল না কংগ্রেস, শিবসেনা (উদ্ধব) এনসিপি (শরদ)-র ‘মহাবিকাশ আঘাড়ী’ জোট।
শনিবার দুপুরের আগেই সরকার গড়ার ‘জাদুসংখ্যা’ ছুঁয়ে ফেলেছে বিজেপির নেতৃত্বাধীন জোট ‘মহাজুটি’। খুব বড় রদবদল না-হলে মুম্বইয়ের কুর্সিতে বসছেন বিজেপিরই কোনও বিধায়ক। অথচ পাঁচ মাস আগে গত লোকসভা নির্বাচনে মহারাষ্ট্রে ধাক্কাই খেতে হয়েছিল বিজেপিকে। ২০১৯ সালে ২৩টি আসনে জয়ী হলেও ২০২৪ সালে মহারাষ্ট্রের মাত্র ৯টি লোকসভা আসনে পদ্মফুল ফুটেছিল। অনেকেই মনে করেছিলেন, বছরশেষে মহারাষ্ট্রের বিধানসভা নির্বাচনেও হারতে হবে পদ্মশিবিরকে। ভোটপণ্ডিতদের একাংশের সেই পূর্বাভাসকে ভুল প্রমাণিত করে একাই ১৩৩টি আসন জয়ের পথে বিজেপি। ২০১৪ সালে প্রবল মোদীঝড়ে মহারাষ্ট্রে ১২২টি বিধানসভা আসনে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। এ বার সেই ‘ঝড়’ না-থাকলেও দশ বছর আগের সাফল্যকেও ছাপিয়ে গেলেন দেবেন্দ্র ফডণবীসেরা।
গত পাঁচ বছরে একাধিক নাটকীয় উত্থানপতন ঘটেছে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে। পুরনো দল ভেঙে তৈরি হয়েছে নতুন দু’টি দল। আর তার জেরেই এ বারের ভোটে চিরায়ত চতুর্মুখী লড়াইয়ের বদলে দেখা গিয়েছিল মোট ছ’টি দলের দ্বিমুখী লড়াই। ২০২২ এবং ২০২৩— পর পর দু’টি বর্ষায় দুই বিদ্রোহের সাক্ষী মহারাষ্ট্র। প্রথম বর্ষায় শিবসেনা ভেঙে বিজেপির হাত ধরেছিলেন পুরনো শিবসৈনিক একনাথ শিন্ডে। সেই বিদ্রোহেই ভেঙেছিল বাল ঠাকরের সাবেক শিবসেনা, ভেঙেছিল কংগ্রেস-শিবসেনা-এনসিপির জোট সরকারও। আর তার পরের বছরের বর্ষায় কাকা শরদ পওয়ারের এনসিপি ছেড়ে বিজেপির হাত ধরেন ভাইপো অজিত পওয়ার।
অচেনা দুই জোটসঙ্গীকে সঙ্গে নিয়েই নির্বাচনে লড়তে নেমেছিল শাসকজোটের ‘বড়দা’ বিজেপি। তবে এনডিএ-র মহারাষ্ট্র-জয়ে সহায় হয়েছেন শিন্ডে-অজিতেরাও। ৫৭টি আসনে এগিয়ে রয়েছেন শিন্ডেসেনার প্রার্থীরা। আর অজিতের এনসিপি এগিয়ে ৪১টি আসনে। ভোটের ফল বলছে, মরাঠাওয়াড়া-বিদর্ভের মতো মহারাষ্ট্রের কৃষিপ্রধান অঞ্চলেও একাধিপত্য দেখিয়েছে এনডিএ জোট। কৃষকদের ভোট পেতে কৃষক সম্মাননিধি যোজনায় ১২ হাজার টাকার পরিবর্তে ১৫ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বিজেপি। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য অন্তত ২০ শতাংশ বাড়ানোর কথা ঘোষণা করা হয়েছিল, যা মহারাষ্ট্রের মতো কৃষিপ্রধান রাজ্যে কৃষকদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল। মনে করা হচ্ছে ভোটের আগে করা বিজেপির সেই ‘সঙ্কল্পে’ আস্থা রেখেছেন কৃষকেরা।
অন্য দিকে, বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘লক্ষ্মীর ভান্ডার’ প্রকল্পের পথে হেঁটেই রাখিপূর্ণিমার দিন মহিলাদের জন্য ‘মুখ্যমন্ত্রী লাডলি বহিন যোজনা’ চালু করেছিল মহারাষ্ট্রের এনডিএ সরকার। বর্তমানে ওই প্রকল্পে প্রতি মাসে ১৫০০ টাকা পান মহিলারা। বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, আবার ক্ষমতায় এলে সেই টাকার অঙ্ক ২১০০ করা হবে। অনেকেই মনে করছেন, এই প্রকল্প এবং অনুদানের অঙ্কবৃদ্ধির প্রতিশ্রুতিই সহায়ক হয়েছে এনডিএ জোটের। তাই শহুরে উচ্চবিত্ত এবং উচ্চ মধ্যবিত্ত ভোট ঝুলিতে ঢোকানোর পাশাপাশি বিরোধী জোটের গ্রামীণ ভোটেও ভাগ বসিয়েছে ‘মহাজুটি’।
ভোটের ফল এ-ও জানান দিচ্ছে যে, মহারাষ্ট্রে উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং ত্যাগ, দুই-ই জয়ী হল। ২০২২ সালে শিবসেনার বিধায়কদের ‘ভাঙিয়ে’ বিজেপির দুয়ারে গিয়েছিলেন শিন্ডে। বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বকে নিজের গুরুত্ব বুঝিয়ে হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীও। ২০১৪ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী থাকা বিজেপি নেতা ফডণবীস রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনেই শিন্ডের ‘ডেপুটি’ হতে রাজি হন। ফডণবীসের সেই ‘ত্যাগ’ এনডিএ জোটকে ভাঙতে দেয়নি। এমনকি, জোটে খানিক ‘অনাগত’ অজিতকেও জোট এবং সরকারে ঢুকিয়ে নিয়েছিলেন পদ্মনেতৃত্ব।
অন্য দিকে, শরদ-উদ্ধবেরা আশা করেছিলেন, ‘গদ্দারেরা’ দল ভাঙায় মানুষের সহানুভূতি তাঁদের দিকেই থাকবে। লোকসভা ভোটে মহারাষ্ট্রে বিরোধী জোটের সাফল্যও তাঁদের উজ্জীবিত করেছিল। কিন্তু ভোটের আগে থেকেই গোল বাধে জোটের অন্দরে। আসন বোঝাপড়া নিয়ে কংগ্রেস এবং উদ্ধবসেনার মধ্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দড়ি টানাটানি চলে। মনে করা হচ্ছে, সেই কারণেই ‘মহাবিকাশ আঘাড়ী’ জোট ৫০-এর ঘরেও পৌঁছতে পারল না।
২০১৯-এর বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির হাত ছেড়ে কংগ্রেস এবং এনসিপির হাত ধরেছিল এনডিএ-র প্রবীণতম জোটসঙ্গী উদ্ধবের শিবসেনা। মতাদর্শের দিক থেকে বিপরীত প্রান্তে থাকা দুই দলের সমর্থন নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীও হন বাল ঠাকরের পুত্র। আর একক বৃহত্তম দল হয়েও বিরোধী আসনে বিজেপি। পাঁচ বছর পরে যেন তারই ‘মধুর’ প্রতিশোধ নিলেন ফডণবীসেরা। উদ্ধবদের শুধু ক্ষমতা থেকে দূরেই রাখলেন না, সে রাজ্যের রাজনীতিতে ‘মাতোশ্রী’কেও (বর্তমানে উদ্ধব এবং অতীতে বালাসাহেবের বাসস্থান) কার্যত গুরুত্বহীন করে দিলেন।
পুনশ্চ: মুকেশ অম্বানীর পুত্রের বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গিয়ে উদ্ধবের সঙ্গে দেখা করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জানিয়েছিলেন, তিনি মহারাষ্ট্রে ভোটের প্রচারে যাবেন। কিন্তু শেষমেশ তিনি মরাঠাভূমে যাননি। তৃণমূল ‘সেনাপতি’ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ঘনিষ্ঠমহলে বলেছিলেন, ঝাড়খণ্ডে হেমন্ত সোরেন জিতবেন। কিন্তু মহারাষ্ট্রের লড়াই ‘কঠিন’!