(বাঁ দিক থেকে) ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সোরেন, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। ছবি: পিটিআই।
একটা সময়ে তাঁরা দু’জনেই বিজেপির সহযোগী ছিলেন। মিল বলতে এটুকুই। শিবসেনা (বালাসাহেব) সভাপতি উদ্ধব ঠাকরের সঙ্গে পিডিপি নেত্রী মেহবুবা মুফতির রাজনীতির মধ্যে বাকিটা শুধুই অমিল। ‘অখণ্ড হিন্দু ভারতের’ প্রবক্তা প্রয়াত বালাসাহেব ঠাকরের পুত্র এবং জীবনভর কাশ্মীরবাসীর আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিতে সরব প্রয়াত মুফতি মহম্মদ সঈদের কন্যাকে শুক্রবার বিকেলে হাসিমুখে পাশাপাশি বসে থাকতে দেখা গেল পটনায়! বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের ডাকা বিজেপি বিরোধী নেতাদের বৈঠকের পরে যৌথ সাংবাদিক সম্মেলনে।
বিরোধী জোটের বৈঠক ঘিরে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই এমন নানা অভাবনীয় সমীকরণের খণ্ডচিত্র দেখছিল পটনা। শুক্রবারের সন্ধ্যা সত্য প্রমাণ করল সেই পুরনো আপ্তবাক্য— ‘পলিটিক্স মেক্স স্ট্রেঞ্জ বেডফেলোজ’ (যার অর্থ, রাজনীতি বিচিত্র সঙ্গী তৈরি করে)!
শুধু মেহবুবা নন, উদ্ধবকে শুক্রবার একান্তে কথা বলতে দেখা গিয়েছে মরাঠা ভোটব্যাঙ্ক দখলের লড়াইয়ে তাঁর অন্যতম প্রতিপক্ষ শরদ পওয়ারের সঙ্গে। এক বছর আগে একনাথ শিন্ডের বিদ্রোহের জেরে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রিত্ব এবং শিবসেনার নির্বাচনী প্রতীক হারানোর পরে ঠারেঠোরে শরদের ‘বিজেপি-সখ্য’ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন উদ্ধব অনুগামীরা। শরদের সঙ্গে নিভৃতে কথা বলতে দেখা গিয়েছে তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও। অথচ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়ার জন্য মমতার দেওয়া প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর থেকেই শরদ তৃণমূলের নিশানায়। এমনকি, বিরোধী জোটের সমন্বয়ের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টিও নাকি মমতারই মস্তিষ্কপ্রসূত।
বৃহস্পতিবার বিকেলে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় এবং রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে সঙ্গে নিয়ে পটনায় পৌঁছনোর পরে সার্কিট হাউসে গিয়ে মমতার সঙ্গে দেখা করেছিলেন নীতীশ। অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায় রেল মন্ত্রকের ‘দখল’ নেওয়ার জন্য যাঁদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল সর্বজনবিদিত। বৃহস্পতিবার রাতে মমতার সঙ্গে সিপিআইয়ের সাধারণ সম্পাদক ডি রাজার কথা হয় বলেও সূত্রের খবর।
শুক্রবার যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে বিরোধী দলগুলির শীর্ষ নেতা-নেত্রীদের সম্বোধন করতে গিয়ে রাজার পাশাপাশি সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিরও নাম করেছেন মমতা! ঘটনাচক্রে, এই ইয়েচুরির দলের বিরুদ্ধে আপোসহীন লড়াই থেকেই তাঁর রাজনৈতিক উত্থান। এই ইয়েচুরির দলের ৩৪ বছরের শাসনের অবসান ঘটিয়ে তাঁর বাংলার ক্ষমতা দখল। এই ইয়েচুরির দলের বাংলার কমরেড মহম্মদ সেলিম শুক্রবারও পঞ্চায়েত ভোটে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলেছেন তৃণমূলের বিরুদ্ধে।
অন্য দিকে, সিপিএমের বিরুদ্ধে ২০১১ সালের সফল লড়াইয়ে মমতার সঙ্গী কংগ্রেস এখন ইয়েচুরি-সেলিমদের সহযোগী। সেই দলের প্রাক্তন এবং বর্তমান সর্বভারতীয় সভাপতি রাহুল গান্ধী ও মল্লিকার্জুন খড়্গেও ছিলেন শুক্রবারের বৈঠকে। তবে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে পরস্পরের থেকে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে বসেছিলেন তাঁরা। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকের সঞ্চালক নীতীশ কুমার কংগ্রেসের দুই শীর্ষনেতার পরেই বলার সুযোগ দেন মমতাকে। কার্যত রাহুলের সুরেই বিজেপির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের বার্তা দেন মমতা। যদিও সেই সময়েই রাহুলের দলের প্রদেশ সভাপতি তথা লোকসভায় কংগ্রেসের নেতা অধীর চৌধুরী বাংলায় কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন মমতাকে। পাল্টা জবাব এসেছে তৃণমূলের মুখপাত্র কুণাল ঘোষের তরফেও।
যদিও রাজনৈতিক অবস্থান এবং মতাদর্শের দিক থেকে ভিন্ন অবস্থানে থাকা বিভিন্ন দলগুলি শুধুমাত্র বিজেপি বিরোধিতাকে পুঁজি করে কত দিন একসঙ্গে থাকবে, তা বলায় সময় এখনও আসেনি বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ। তাঁদের মতে, শুক্রবার পটনার বৈঠকে ১৫টি দলের যে ৩২ জন নেতা-নেত্রীকে এক সঙ্গে দেখা গিয়েছে, তাঁরা লোকসভা ভোট পর্যন্ত একসঙ্গে থাকবেন কি না, তা অনিশ্চিত। এমনকি, শিমলায় পরবর্তী বৈঠকের আগেই মতবিরোধ প্রকাশ্যে আসতে পারে।
তাঁদের মতে, সাধারণ ভাবে এমন ‘রামধনু’ সমীকরণের শুরুতে ঐক্যের সুর চড়া থাকলেও আসন ভিত্তিক আলোচনা শুরুর পরেই ধীরে ‘তাল কাটতে’ শুরু করে। সম্ভবত এমন সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখেই রাহুল শুক্রবার বিরোধীদের ঐক্যকে গভীরে নিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। তবে বিরোধী ঐক্যের তাল কেটেছে পটনায় বৈঠক শেষ হওয়ার পরেই। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দল আম আদমি পার্টি (আপ) বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, কংগ্রেস যদি দিল্লির আমলাতন্ত্র দখলের জন্য মোদী সরকারের জারি করা বিতর্কিত অর্ডিন্যান্স (অধ্যাদেশ)-এর বিরোধিতা না-করে, তবে শিমলার বৈঠকে তারা যোগ দেবে না।