Manmohan Singh

বর্তমান পাকিস্তানে জন্ম, দেশের প্রথম অহিন্দু প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মনমোহন

এ দেশে উদার আর্থিক নীতির জনক বলে তাঁর নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিল ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যে, যে পর্বে তিনি ছিলেন নরসিংহ রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী।

Advertisement
অনির্বাণ দাশ
শেষ আপডেট: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪ ২৩:৪৬
এ দেশে উদার আর্থিক নীতির জনক বলে তাঁর নাম খোদাই হয়ে গিয়েছে।

এ দেশে উদার আর্থিক নীতির জনক বলে তাঁর নাম খোদাই হয়ে গিয়েছে। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

প্রধানমন্ত্রী না-হলেও মনমোহন সিংহের নাম স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে অনেকটা জায়গা জুড়ে থেকে যেত। ভারতীয় অর্থনীতির এক বহু আলোচিত, বহু বিতর্কিত মহাসন্ধিক্ষণের জন্ম হয়েছিল তাঁরই হাত ধরে। এ দেশে উদার আর্থিক নীতির জনক বলে তাঁর নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিল ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সালের মধ্যেই, যে পর্বে তিনি ছিলেন নরসিংহ রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী।

Advertisement

আরও একটি কারণে তাঁর নাম আলাদা হয়ে থাকবে। তিনিই এ দেশের প্রথম অহিন্দু প্রধানমন্ত্রী এবং এ পর্যন্ত একমাত্র। মনমোহনের জন্মস্থান বর্তমান পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশে চকওয়াল জেলার গ্রাম গাহ‌। জন্মদিন ১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর। দেশভাগের সময় কিশোর মনমোহন বাবা গুরমুখ সিংহ এবং মা অমৃত কৌরের হাত ধরে চলে আসেন অমৃতসরে।

চণ্ডীগড়ের পঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫২ সালে প্রথমে স্নাতক এবং ১৯৫৪ সালে স্নাতকোত্তর শেষ করেন মনমোহন। শোনা যায়, ক্লাসে কখনও দ্বিতীয় হননি তিনি। তার পর পাড়ি জমান বিলেতে। ইংল্যান্ডের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৭ সালে অর্থনীতিতে স্নাতক, তার পর ১৯৬২ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নাফিল্ড কলেজ থেকে ডি’ফিল করেন তিনি।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।

অক্সফোর্ডের পাঠ শেষে ভারতে ফিরে আসেন মনমোহন। যোগ দেন রাষ্ট্রপুঞ্জের চাকরিতে। ১৯৬৬ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত একটানা রাষ্ট্রপুঞ্জের বাণিজ্য ও উন্নয়ন শাখায় কাজ করেন।

১৯৬৯ সালে মনমোহন শুরু করেন শিক্ষকতা। দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্সে যোগ দেন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের অধ্যাপক হিসেবে। কয়েক বছরের মধ্যেই অবশ্য সরকারি দায়িত্বের ক্ষেত্রে প্রবেশ তাঁর। ১৯৭২ সালে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হন। ১৯৭৬ সালে হন কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থসচিব। ১৯৮০ সাল থেকে টানা দু’বছর মনমোহন ছিলেন যোজনা কমিশনে। প্রণব মুখোপাধ্যায় তখন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। ১৯৮২ সালে মনমোহনকে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার গভর্নর করা হয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত সেই পদে ছিলেন। এর পর দু’বছর (১৯৮৫-৮৭) তিনি যোজনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারপার্সন।

১৯৮৭ সালে অর্থনীতি বিষয়ক স্বাধীন সংস্থা সাউথ কমিশনের মহাসচিব পদে বসেন মনমোহন, যার সদর দফতর সুইৎজারল্যান্ডের রাজধানী জেনিভায়। সেখানেই ১৯৯০ পর্যন্ত ছিলেন মনমোহন। ১৯৯০ সালে দেশে ফিরে আসেন। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহের অর্থনীতি বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব নেন। ১৯৯১ সালের মার্চে তিনি ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট কমিশন (ইউজিসি)-র চেয়ারম্যান পদে বসেন।

১৯৯১ সালের জুন মাসে নতুন প্রধানমন্ত্রী পিভি নরসিংহ রাও তাঁর সরকারে মনমোহনকে অর্থমন্ত্রী করেন। স্বাধীন ভারতের অর্থনীতির ইতিহাসে সেটি সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলির একটি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে। এর পর থেকেই দিক পরিবর্তন করতে থাকে ভারতের আর্থিক নীতি বা বাজারনীতি।

১৯৯২ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের দিন বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ।

১৯৯২ সালের কেন্দ্রীয় বাজেট পেশের দিন বিতর্কের কেন্দ্রে থাকা অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ।

১৯৯১ সালে কেন্দ্রে মন্ত্রী হওয়ার পর কংগ্রেসের হয়ে প্রথম বার রাজ্যসভায় সদস্য নির্বাচিত হন মনমোহন। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত দেশের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলান তিনি। ১৯৯৯ সালে এক বার লোকসভায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জিততে পারেননি।

২০০৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর কংগ্রেস সরকার তৈরি করার মতো জায়গায় পৌঁছোয়। কিন্তু ‘বিদেশিনি’ বিতর্কের আবহে প্রধানমন্ত্রী হতে চাননি তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সনিয়া গাঁধী। বিকল্প হিসেবে সামনে আসে মনমোহন এবং প্রণবের নাম। কংগ্রেস সভানেত্রীর সমর্থন ছিল মনমোহনের দিকে। শেষ পর্যন্ত সিলমোহর পড়ে মনমোহনের নামে।

নিজের প্রধানমন্ত্রিত্বের প্রায় পুরো সময় ধরেই ভারতীয় অর্থনীতির খোলনলচে পাল্টানোর কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে অর্থনীতিবিদ মনমোহনকে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলেন, তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ২০০৮ সালে বামেদের বাধা উপেক্ষা করে ভারত-আমেরিকা পরমাণু চুক্তিতে স্বাক্ষর করা। সিপিএম-সহ বাম দলগুলির বিরোধিতা এমন পর্যায়ে পৌঁছয় যে, ক্ষমতাসীন ইউপিএ সরকারের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় তারা। আস্থাভোটে কোনও রকমে রক্ষা পায় মনমোহনের সরকার।

২০০৯ সাল। দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মনমোহনকে অভিনন্দন সনিয়া, প্রণবের।

২০০৯ সাল। দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মনমোহনকে অভিনন্দন সনিয়া, প্রণবের। ছবি: রয়টার্স।

২০০৯ সালের মে মাসে সাধারণ নির্বাচনে আসনসংখ্যা আরও বাড়িয়ে ক্ষমতায় ফেরে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ। দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসেন মনমোহন। সেই সরকারে রেলমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১১ সালে বাংলা জয়ের পর মুখ্যমন্ত্রীর পদে বসতে মমতা কেন্দ্রীয় মন্ত্রিত্ব ছাড়েন। তৃণমূলের অন্যরা অবশ্য মন্ত্রিসভায় থাকেন। কিন্তু খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগে সায় দেওয়ায় ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে মনমোহনের সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসে তৃণমূল। মনমোহন অবশ্য নিজের সিদ্ধান্ত থেকে নড়েননি।

২০১৪ সালের গোড়ায় মনমোহন ঘোষণা করেন, তিনি তৃতীয় বারের জন্য প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে নেই। ২৬ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ছেড়ে শেষ বারের মতো বেরিয়ে যান মনমোহন। সেই দিনই প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী পদে শপথ নেন নরেন্দ্র মোদী।

মিতভাষী মনমোহন কিন্তু বেশ কয়েক বার সরব হয়েছেন মোদী সরকারের আর্থিক নীতি নিয়ে। শুধু সমালোচনাই নয়, পরামর্শও দিয়েছেন প্রবীণ অর্থনীতিবিদ। বিমুদ্রাকরণের পর তিনি জোরের সঙ্গেই ঘোষণা করেন, এর ফলে দেশের অর্থনীতি এক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়তে চলেছে। কারণ যা-ই হোক না কেন, কোভিড-পর্বের অনেক আগে থেকেই লাগাতার মন্দগতি চলতে থাকে ভারতীয় অর্থনীতিতে। অথচ ২০০৮ সালে বিশ্ব জুড়ে আর্থিক মন্দার সময়ও ভারতের গায়ে কিন্তু বড় আঁচ লাগেনি।

সে সময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ‘সিংহ’ মনমোহন।

Advertisement
আরও পড়ুন