অযোধ্যার একমাত্র বাঙালি মিষ্টির দোকান ‘শ্রী বাঙালি সুইট সেন্টার’। —নিজস্ব চিত্র।
ঠিকানা বদলালেও স্বাদ বদলায়নি। অযোধ্যার একমাত্র বাঙালি মিষ্টির দোকান যে পরিবারের, তাদের আদি নিবাস পুরুলিয়া জেলায়। বলরামপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অখ্যাত গ্রাম কুকুরগড়িয়া। এখনও সেই গ্রামের একটা পরিচয়— ‘অভাব’।
সেই অভাবের তাড়নাতেই বছর চল্লিশ আগে ভাগ্যের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন সুফলচন্দ্র মৌর্য। তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর অযোধ্যা গিয়ে। বাঙালি জেনে যত্ন করে রসগোল্লা খাইয়েছিলেন। দাম দিতে হয়েছিল জোর করে। সুফলচন্দ্র প্রয়াত। তবে তাঁর দোকানের অভিজ্ঞতা একই। রসগোল্লা খাওয়ালেন পুত্র আনন্দমোহন। তিনিই এখন অযোধ্যার ‘শ্রী বাঙালি সুইট সেন্টার’-এর মালিক।
মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ গোটা অযোধ্যাকেই যেন ‘ইউনিফর্ম’ পরিয়ে দিয়েছেন। দোকান খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। হনুমানগড়ির কাছেই ছিল দোকানটা। কিন্তু সেই রাস্তার দু’পারে সব দোকান একই রকম দেখতে। রং এক। সাইনবোর্ডের রং থেকে হরফ— কোনও ফারাক নেই। রামমন্দির হবে বলে শহরের এই রাস্তা গত দু’বছরে প্রায় দ্বিগুণ চওড়া হয়েছে। ভাঙা পড়েছে সব দোকান, অফিস। পরে সরকারি উদ্যোগে তৈরি হয়েছে হালকা গেরুয়া রঙের দেওয়ালে মেরুন-সাদা রঙে লেখা নাম। স্টেট ব্যাঙ্ক আর শ্রীরাম শু সেন্টারে কোনও ফারাক নেই।
চোখ আটকাল রসগোল্লার গামলায়। এই তো সেই দোকান! চেহারায় অনেক ছোট। দেওয়ালে সুফলচন্দ্রের ছবিতে মালা। বর্তমান মালিক আনন্দমোহন জানালেন গত বছরেই বাবা প্রয়াত হয়েছেন। পুত্র বললেন, ‘‘বাবা ভাগ্যের সন্ধানে অযোধ্যায় চলে আসেন। পুরনো রামমন্দিরের পাশেই একটা চায়ের দোকান দিয়েছিলেন। সেটা ১৯৮৪-’৮৫ সাল নাগাদ। ভক্তদের চা খাইয়ে পুঁজিও জমেছিল। দেশ (কুকুরবেড়িয়া) থেকে মিষ্টি তৈরির কারিগর এনে পরে পরে মিষ্টির দোকান করেন।’’
সুফলচন্দ্রের চায়ের দোকানেই চলত মিষ্টি বিক্রি। প্রধান আকর্ষণ ছিল বাংলার স্বাদের রসগোল্লা। কিন্তু ১৯৯২ সালে ভাগ্য বদলে গেল। বিতর্কিত সৌধ ভাঙা পড়তে ওই দোকানের জমিও অধিগ্রহণ হয়ে গিয়েছিল। খুঁজতে খুঁজতে সুফলচন্দ্র চলে আসেন দণ্ডধান কুণ্ড এলাকায় জৈন মন্দিরের পাশে। সেখানেও দোকান জমে যায়। পরে অযোধ্যা শহরের সব চেয়ে জমজমাট এলাকা হনুমানগড়ি চৌমাথায় দোকান হয়। সেই দোকানই রয়েছে। পাশের গলির নাম ‘শহিদ সরণি’। এই রাস্তাতেই ১৯৯০ সালে গুলি লেগেছিল করসেবকদের। মৃত্যু হয়েছিল কলকাতার দুই ভাই রাম এবং শরদ কোঠারির।
বহু দিন নিজের গ্রামে যাননি আনন্দমোহন। বললেন, ‘‘কুকুরগড়িয়ায় কাকা-জ্যাঠারা থাকলেও আমরা এখন অযোধ্যার বাসিন্দা হয়ে গিয়েছি। বাংলাটাও ভাল বলতে পারি না। মাঝেমধ্যে ফোনে কথা ছাড়া গ্রাম বা আত্মীয়দের সঙ্গে যোগাযোগ নেই।’’ বাংলার সঙ্গে যোগাযোগ কমে গেলেও বাংলার মিষ্টির সঙ্গে যোগ একটুও কমেনি। বাবা যেমন করে চালাতেন, তেমন করেই নিখুঁতি, অমৃত্তি, দানাদার, গজা, বোঁদের লাড্ডু, রাবড়ি, রসমালাই, বালুশাই তৈরি হয়। রসগোল্লা, পান্তুয়া তো আছেই। তবে এখন আর বাঙালি কারিগর পাওয়া যায় না। স্থানীয়দেরই শিখিয়ে নিতে হয়েছে। স্থানীয় মিষ্টিও বানাতেই হয়। শুধু বাঙালিয়ানায় পেট ভরে না অযোধ্যায়।
এই পেট না ভরার কারণ অবশ্য একেবারেই ‘ধর্মীয়’। রসগোল্লার সঙ্গে বড় সাইজের রাজভোগও বানায় এই দোকান। তবে কোনওটিই পুজোর নৈবেদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয় না উত্তর ভারতে। ছানাকে ছিন্ন করার পরে রসে ফোটানো হয় বলে এই মিষ্টি দেবতাকে নিবেদন করা যায় না। তাই ভগবান রামের প্রসাদ হিসাবে বানাতে হয় প্যাঁড়া। তার বিক্রিও ভাল। তবে হনুমানগড়ি মন্দিরের কাছে দোকান হওয়ায় সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় বেসনের লাড্ডু আর অমৃত্তি। হনুমানজি এগুলোই পছন্দ করেন। তবে আক্ষেপ নেই আনন্দমোহনের। বললেন, ‘‘যেখানে যেটা সেখানে সেটা তো মানিয়ে নিতেই হবে। তবে বাঙালিরা এখানে এলে খোঁজ পেলেই রসগোল্লা খান। আর বাঙালি মিষ্টি হিসাবে স্থানীয় বাসিন্দারাও আমাদের দোকানের রসগোল্লা পছন্দ করেন। রোজেরটা রোজ শেষ হয়ে যায়।’’
এই দোকানে এসে সকলে ‘কলকাত্তার রসগোল্লা’ চান। এই নামেই বাঙালি রসগোল্লার পরিচয় রামভূমে।