ক্রমশই প্রাণঘাতী হয়ে উঠছে দিল্লির দূষণ পরিস্থিতি। ছবি: এএফপি।
মুখে সুপুরি রাখলে স্বর বদলে যায়। ছোটবেলায় শিখিয়েছিলেন ব্লাইন্ড অপেরার শুভাশিসদা (গঙ্গোপাধ্যায়)। বড়বেলায় দিল্লি শেখাচ্ছে গলায় সুপুরি নিয়ে বেঁচে থাকতে। এ বাঁচা যে খুব সহজ নয়, হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি প্রতি দিন। ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গেলেই গলা ধরে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে, তালু আর গলার মাঝখানে দলা পাকিয়ে আছে কিছু। অষ্টপ্রহর সংকীর্তনের মতো চলছে কাশি। চলছে তো চলছেই। গুরুগ্রাম থেকে দিল্লি ঘুরে নয়ডা— এটাই এখন যমুনাপারের ‘ঘর ঘর কি কহানি’। এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) যে জীবনকে এতটা প্রভাবিত করতে পারে, জানা ছিল না। দিবারাত্র মনে হচ্ছে, মুখের উপর কাপড় চাপা দিয়ে রেখেছে কেউ। রাস্তায় বেরোলে শ্বাস নিতে কসরত করতে হচ্ছে। সময় সময় বমি পাচ্ছে, ঝিম ধরছে মাথায়। এটাই দিল্লি, ডিজিটাল ভারতের গর্বের রাজধানী।
রাতে এয়ার পিউরিফায়ার চালিয়ে ঘুমানোর সময় অ্যাপের নোটিফিকেশন দেখায়, বাতাসে দূষণের পরিমাণ ‘হ্যাজার্ডাস’। মানে ঘরের ভিতরেও একিউআই তিনশো পঞ্চাশের উপর। ৬-৭ ঘণ্টা চলার পর যদি তা ‘পুওরে’ নেমে আসে, বুঝতে হবে, কপাল ভাল। অন্তত ঘুমের সময় ফুসফুসে ঝুল খানিক কম জমেছে। চিকিৎসকেরা বলেন, একিউআই পঞ্চাশের মধ্যে থাকলে তা শ্বাস নেওয়ার জন্য উপযুক্ত। পঞ্চাশ থেকে একশো চলনসই। একশো থেকে দু’শো খারাপ। দু’শো থেকে তিনশো খুব খারাপ। তিনশো থেকে চারশো— সুস্থ মানুষও অসুস্থ হতে পারেন। চারশো পার করলে তা প্রাণঘাতী। সকাল ৭টায় যখন এ লেখা লিখছি, দক্ষিণ দিল্লির একিউআই তখন চারশোর উপরে। বস্তুত, গোটা দিল্লির গড় একিউআই চারশোর উপর। সকালে, দুপুরে, বিকেলে একই রকম সূর্য। কম ভোল্টেজে ফিলামেন্ট বার করা নিস্তেজ বাল্বের মতো। বয়লার মুরগির ডিমের ঘোলাটে কুসুমও বলা যায়।
ধোঁয়ার চাদর এমনই যে, সেন্ট্রাল ভিস্তার ইন্ডিয়া গেটও স্বচ্ছ নয়। ইন্ডিয়া গেট থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে তাকালে, কেবলই ধোঁয়া। সদ্য জার্মানি থেকে আসা এক বন্ধু মজার কথা বলেছে। দিল্লির হাওয়া রাজধানীর রাজনৈতিক বাতাসের চরিত্র পেয়েছে। কোনও কিছুই স্পষ্ট নয়। কোনও কিছুই স্বচ্ছ নয়। কোনও ঝাড়ু, কোনও স্বচ্ছ ভারতের গান্ধীই বাতাসের ধুলো ঝাড়তে পারছে না। অগত্যা ভিস্তি ডেকে ধুলো ধোয়ার ফরমান জারি করেছেন সরকারবাহাদুর। জলে ধুলো হচ্ছে কাদা। প্রতি দিন সকাল-বিকেল পুরসভার গাড়ি জল ছড়িয়ে যায় রাস্তায়। রাস্তার ধারের গাছে। অবস্থা নাকি এমনই, ধুলোর চাদরে ঢেকে থাকা গাছের পাতায় জল না দিলে তারাও কার্বন ডাই অক্সাইড টানতে পারছে না। সত্য-মিথ্যা জানা নেই, খোদ পুরসভার আধিকারিকের মুখে শোনা কথা। এ ছাড়াও আছে এক আজব যন্ত্র। ভ্যানের পিছনে চিমনির পাইপের মতো এক বিরাট যন্তরমন্তর লাগানো। সকাল-সন্ধ্যা সেই গাড়ি ফগিং করছে মহল্লায় মহল্লায়। চলতা ফিরতা এয়ার পিউরিফায়ার। এতে নাকি দূষণের পরিমাণ কমে। কমে কি?
সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে পর পর তিনটি স্মাইলি ছাড়া আর কিছুই পাঠাতে পারেননি পরিবেশ বিজ্ঞানী দীপায়ন দে। দিল্লির আর এক পরিবেশবিদ যে হিসাব পাঠিয়েছেন, তাতে দেখা যাচ্ছে, দক্ষিণ দিল্লির লাজপত নগরে বিজেপি সাংসদ গৌতম গম্ভীর কয়েক কোটি টাকা খরচ করে বাজারের মাঝে যে বিশাল এয়ার পিউরিফায়ার লাগিয়েছেন, তার জেরে ১০০ মিটার ব্যাসার্ধে বাতাসের গুণমান ১৬ পয়েন্ট ভাল হয়। যার অর্থ, কয়েক কোটি টাকার একটি যন্ত্র, একটি মহল্লায় সাকুল্যে অর্ধেকখানা বাড়ির বাতাস ১৬ পয়েন্ট ভাল করতে পারে। হ্যাঁ, দূষণ নিয়ে রাজধানীর ঝাড়ু সরকার, কেন্দ্রের কমল সরকার, পুরসভার ঝগড়ুটে প্রশাসনের দৌড় ঠিক এতটুকুই।
দিল্লির মানুষও তেমন। আস্ত গ্যাস চেম্বারে বসে তাঁরা দিব্য ‘দিওয়ালি মানিয়েছেন’। দিল্লি সরকার বলেছিল, বাজি ফাটালে ছয় মাসের জেল। দিল্লিবাসী পরম বিনয়ে সেই নিষেধাজ্ঞাকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত বাজি ফাটিয়েছেন। লালকেল্লার জনপদে বাজি ফেটেছে দীপাবলির এক দিন আগেও। ভারত পাকিস্তানকে টি-টোয়েন্টিতে হারানোর পর। গো-বলয়ের মেধাবী মন নিশ্চয়ই ভেবেছিল তাদের তৈরি দূষণ হাওয়ায় হাওয়ায় দিল্লি গেট থেকে লাহোর গেটে পৌঁছে যাবে! নয়া সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের ইতিহাস রচিত হবে! বাস্তবে দেখা গেল, সে দিনের বাজি পোড়ানো প্রতিবেশী পর দিন বৃদ্ধ বাবার জন্য অক্সিজেন সিলিন্ডার খুঁজতে বেরিয়েছেন। কী আশ্চর্য সমাপতন, তাই না!
আশ্চর্য লাগে ভাবতে, দিল্লির যে পুলিশ মাঝরাতে জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হস্টেলে ঢুকে রীতিমতো ‘অপারেশন’ চালাতে পারে, যে দিল্লি পুলিশ এক এফআইআরে সংবাদমাধ্যমের অফিস, সাংবাদিকের বাড়িতে ঢুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তল্লাশি চালানোর দক্ষতা দেখাতে পারে, সেই পুলিশ বাজির শব্দ শুনতে পায় না। দেখতে পায় না আকাশ জোড়া রং-বেরঙের আলো। গান্ধীর তিন বাঁদরের প্রশিক্ষণ চলছিল নিশ্চয়ই তখন তাদের। দিল্লিবাসীকেও তাই ছয় মাসের জেল বিশেষ উপভোগ করতে হয়নি। এক পুলিশ অফিসারের কাছে এ সংক্রান্ত তথ্য চেয়েছিল ছিদ্রান্বেষী সাংবাদিক। এযাবৎ উত্তর মেলেনি।
সম্প্রতি পৃথিবীর দ্বিতীয় দূষিততম শহরে সরকারবাহাদুর কিছু নিয়ম চালু করেছেন অবশ্য। শহরের ভিতর আপাতত বাড়ি তৈরি এবং ভাঙার কাজ বন্ধ। শহর সংলগ্ন কারখানায় কাজ বন্ধ। গ্যাসে চলে, কেবলমাত্র এমন কারখানার চুল্লিই চালানো যাবে। শহরে ঢুকতে পারবে না ডিজেল গাড়ি। রাজধানীতে ট্রাক, লরির প্রবেশ নিষেধ। সরকারি-বেসরকারি অফিসবাবুরা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ করলে ভাল। বন্ধ ছোটদের স্কুল। এ সব ‘চোর পালানো বুদ্ধি’র সঙ্গে অবশ্য রাজধানীবাসী পরিচিত। দীপাবলি পরবর্তী এই নিয়মাবলি প্রতি বছরই এক বার করে ঝালিয়ে নেওয়া হয়। ‘অড-ইভেন’ নম্বরের গাড়ির নিয়ম এখনও চালু হয়নি। হতে পারে, এমন আভাস আছে। সরকারবাহাদুর জানেন, মাসখানেক এ সব নিয়ে সামান্য হট্টগোল হবে, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে প্রতি দিন এক বার করে মুখ পুড়বে, তার পর যে কে সেই! মনুষ্য স্মৃতি সততই স্বল্পমেয়াদি, তামাদিও বটে। ফলে ভোটে এ সব কিছুর প্রভাব পড়ে না। আর কে না জানে, যা নাই ভোটে, তা নাই ভূভারতে। ফলে বছরের পর বছর দূষণ বাড়বে। কোনও দীর্ঘস্থায়ী ব্যবস্থা, পরিকল্পনা নেওয়া হবে না। কোটি কোটি টাকা খরচে কিছু অপ্রয়োজনীয় যন্ত্র কেনা ছাড়া। দুষ্টুলোকেরা তো এর মধ্যেও দুর্নীতির ভূত দেখতে পান মাঝে মাঝে।
ডয়েচল্যান্ডে হিটলারের গ্যাসচেম্বারে ট্যুর নিয়েছে জার্মানি-ফেরত বন্ধু। ধোঁয়া ধোঁয়া দিল্লি বিমানবন্দরে নেমেই সে নাকি রাজধানীর বাতাসে টকটক গন্ধ পেয়েছে। প্রতি প্রশ্বাসে অ্যাসিড-টক প্রাণবায়ু ফুসফুস ঘুরে নিশ্বাসে বিলীন হচ্ছে। ‘সভ্য হাওয়া’ থেকে আচমকা দিল্লিতে নেমে পড়লে, বাতাসে গন্ধ পাওয়া খুব আশ্চর্য না।
যত দিন যাচ্ছে, রাজধানীর বাতাস আক্ষরিক অর্থেই বড্ড টক লাগছে। সর্ব অর্থেই।
শুধুই কি দিল্লি? যে দেশের রাজধানীর নাম ‘গ্যাসচেম্বার’, সে দেশের শিরা-ধমনীতে আদি গঙ্গার অ্যাসিড-জল বইবে, সেই তো স্বাভাবিক! জি হুজুর, সর্ব অর্থেই।
দিনভর ইনহেলার নিয়েও গলার কাছের সুপুরিটা বোধহয় এ যাত্রায় আর নামানো যাবে না!