সিপিএম প্রার্থী অমরা রাম। —নিজস্ব চিত্র।
মন্দিরের গায়ে কালো রঙে সাপের ছবি আঁকা। রাজস্থানের লোকদেবতা কেসরিয়া কঁওয়রের থান। গাঁয়ের লোকের অন্ধ বিশ্বাস, ‘দেবতার আশীর্বাদে’ সাপের ছোবল খাওয়া রোগী ‘সেরে ওঠে’। ছোট্ট মন্দিরের পাশে বড় মাপের বালাজির মন্দির। মন্দিরের চূড়ায় ঝান্ডা ওড়ে। তাতে লাল রঙে লেখা—‘জয় শ্রী রাম’।
মন্দিরের উঠোনে এসে দাঁড়ান ‘কমরেড’ অমরা রাম। তাঁর গাড়ির সামনে লাল ঝান্ডা। ঝান্ডায় কাস্তে-হাতুড়ি-তারা। তাঁর মাথায় লাল, সবুজ, হলুদ রঙবেরঙের মস্ত পাগড়ি। অমরা রাম হাত জোড় করে শেখাওয়াতি লবজে বলেন, “মন্দিরের সামনে আপনাদের ভোট চাইছি। আপনাদের বলতে এসেছি, কৃষকদের ঋণ মকুব, বিজলি বিল অর্ধেক করা বা সারের দাম কমানোর দাবি, সব লড়াই শুধু লাল ঝান্ডাই লড়েছে।”
গ্রামের নাম নৌসল। জেলার নাম সীকর। বিধানসভা কেন্দ্রের নাম দাঁতারামগঢ়। প্রার্থী রাজস্থানে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক অমরা রাম। সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটিরও সদস্য। কিসান সভার সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি। গ্রামের পর গ্রামে ঘুরে ঘুরে প্রচার চালাচ্ছেন অমরা। সঙ্গে এসএফআই, ডিওয়াইআই-এর এক দঙ্গল নেতা। লড়াইটা শুধু অমরা রামের আসন জেতার নয়। রাজস্থানের বিধানসভায় সিপিএমের উপস্থিতি ধরে রাখারও।
পশ্চিমবঙ্গে তিন দশক ক্ষমতায় থেকেও সিপিএমের বিধায়ক সংখ্যা শূন্য। মরু-রাজ্যে সিপিএমের এখনও দু’জন বিধায়ক রয়েছেন। সীকরে সিপিএমের জেলা সদর দফতরে লেনিন, স্ট্যালিনের সঙ্গেই জ্যোতি বসুর ছবি। অমরা রাম বলেন, “অতীতে রাজস্থানের বিধানসভায় আমাদের তিন জন বিধায়কও ছিল। এখনও পর্যন্ত আমরা রাজস্থানে সর্বাধিক তিনটে আসনই জিতেছি। এ বার আমরা সেই রেকর্ড ভেঙে আরও বেশি বিধায়ক জিতিয়ে আনব।”
বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’য় কংগ্রেসের সঙ্গে সিপিএম রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস, সিপিএমের বোঝাপড়া রয়েছে। কিন্তু রাজস্থানে কংগ্রেস সিপিএম-কে কোনও আসন ছাড়েনি। সিপিএম নিজেই ১৭টি আসনে লড়ছে। ডুঙ্গারগঢ় থেকে গিরধারী মাহিয়া ও ভদরা থেকে বলবান পুনিয়া—দুই সিপিএম বিধায়কও নিজের আসন ধরে রাখতে মরিয়া। অমরা রামের নালিশ, “বিজেপির বিপরীতে বড় দল হিসেবে কংগ্রেসেরই তো আসন সমঝোতা নিয়ে উদ্যোগী হওয়া উচিত ছিল। মুম্বইয়ে ইন্ডিয়া-র বৈঠকে তেমনই কথা হয়েছিল। লোকসভা নির্বাচনে আমরা জোট বেঁধে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়ব ঠিকই। কিন্তু রাজস্থানে কংগ্রেস আসন সমঝোতার জন্য উদ্যোগী হয়নি।’’
সাত বার লোকসভা নির্বাচন ও সাত বার বিধানসভা নির্বাচনের যুদ্ধের সৈনিক অমরা রাম লড়াইতে নেমে রাজ্যে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসকেই নিশানা করছেন। তাঁর অভিযোগ, “কংগ্রেস কথা রাখেনি। ক্ষমতায় এলে দশ দিনের মধ্যে চাষিদের সব ঋণ মকুব করে দেবে বলেছিল। পাঁচ বছরে পুরো ঋণ মকুব হয়নি।”
অমরা রামের উল্টো দিকে দাঁতা রামগঢ়ের বর্তমান কংগ্রেস বিধায়ক বীরেন্দ্র সিংহ। অতীতে চার বার বিধানসভা ভোটে জেতা আত্মবিশ্বাসী অমরা বলছেন, “আমি তো বীরেন্দ্র সিংহের বাবা নারায়ণ সিংহকে হারিয়েছি। উনি সে সময় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন। এ তো তাঁর ছেলে!”
দাঁতারামগঢ়ের মানুষ বলেন, বিপদে-আপদে ডাকলে অমরা রামকে পাওয়া যায়। নৌসল গাঁয়ের সরপঞ্চ নিজের হাতে পাথরে শুকনো আদা, লবঙ্গ গুঁড়ো করে ফুটন্ত চায়ে মিশিয়ে দেন। তারপর গল্প শোনান, “সে বার সরকারি জমিতে গরিবরা বাড়ি করেছিল বলে তা ভাঙতে বুলডোজার এসেছিল। অমরা রাম এসে বুলডোজারের উপরে উঠে পড়েছিলেন। গ্রামে পানীয় জলের সমস্যা। সেচের জল মেলে না। এ সব কথা সিপিএমই বলে।”
পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, ত্রিপুরা থেকে অনেক দূরে রাজস্থানের রুক্ষ জমিতে সিপিএম অনেক আন্দোলন করেছে। কখনও সেচের জলের জন্য। কখনও চাষি, মজদুরদের দাবিতে। কখনও চুরু, কখনও সীকর, কখনও ঝুনঝুনুতে। তারই সুবাদে রাজস্থানে বার বার কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা বিধায়ক হিসেবে জিতে এসেছেন। কিন্তু ওই পর্যন্তই। দু’তিনজন বিধায়কের পরে আর সংখ্যা বাড়েনি।
কোথায় আটকে গেলেন? “অর্থবল, জাতপাত ও ধর্মের রাজনীতির সামনে”, স্বীকার করে নেন অমরা রাম। তবে মাথার মস্ত পাগড়ি সামলে গাড়িতে ওঠার আগে বলে যান, “আমরা চাষির ঋণ মকুব করিয়েছি। বিজলি বিল অর্ধেক করিয়েছি। তার সুবিধা সব জাতের মানুষ পেয়েছে। কিসান, মজদুর, যুবকরা আমাদের পাশে। আমি মানুষের চাঁদায় ভোটে লড়ি। মানুষের ভোটে জিতে আসি। এ বারও তাই হবে।”
অমরা রামের গাড়ি প্রচারে ছোটে। গাড়ির সামনে লাগানো লাল ঝান্ডা উড়তে থাকে।