অমিত শাহ। —ফাইল চিত্র।
সংসদে অমিত শাহের করা বি আর অম্বেডকরকে নিয়ে মন্তব্যের জেরে বিতর্ক যে ভাবে গতি পাচ্ছে, তাতে প্রবল অস্বস্তিতে বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। গোড়ায় অমিত শাহকে বাঁচাতে মুখ খুলেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু তাতে মুখরক্ষা হয়নি। এই আবহে বিজেপি যে দলিত বিরোধী দল নয়, এই বার্তা দিতে পরবর্তী জাতীয় সভাপতি হিসাবে দলের কোনও দলিত নেতাকে বেছে নেওয়ার প্রশ্নে চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে বিজেপির অন্দরমহলে। তাৎপর্যপূর্ণ হল, বাজপেয়ী-আডবাণীর আমলে প্রথম ও শেষ বারের মতো দলিত মুখ বঙ্গারু লক্ষণকে (২০০০-’০১) দলের সভাপতি হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঘুষ-কেলেঙ্কারিতে তিনি পদ খোয়ানোর পর থেকে বিজেপির শীর্ষ পদে আর কোনও দলিত নেতাকে দেখা যায়নি।
বিজেপির সমস্যা হল, বর্তমানে দলে বড় মাপের দলিত নেতার অভাব রয়েছে। বিজেপি সভাপতি হিসাবে দক্ষ সংগঠক হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে বিজেপির যে দলিত নেতারা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের আস্থভাজন এবং পরিচিত মুখ, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার সদস্য অর্জুন রাম মেঘওয়াল। গত সরকারেই যাঁকে আইন মন্ত্রকের দায়িত্বভার তুলে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া দৌড়ে রয়েছেন দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দুষ্মন্ত গৌতম। যিনি সদ্য হয়ে যাওয়া হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে দলকে জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। তৃতীয় জন হলেন উত্তরপ্রদেশ সরকারের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রী বেবি রাণি মৌর্য্য। মূলত অমিত শাহের ঘনিষ্ঠ ওই নেত্রী উত্তরাখণ্ডের রাজ্যপালের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে লড়ে মন্ত্রী হন। এই তিন জনই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছের লোক বলে পরিচিত। এঁদের মধ্যে দৌড়ে এগিয়ে মেঘওয়াল।
রাজনীতিকদের মতে, এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই মোদী-অমিত শাহের বিশ্বাসভাজন কোনও ব্যক্তিই বিজেপি সভাপতি হবেন। যাতে সরকার ও দলের মধ্যে তালমিলের অভাব না হয়। এ ক্ষেত্রেও মোদী-শাহ জুটি নড্ডার মতো এমন কাউকেই বেছে নিতে চাইবেন, দলে যাঁর জনভিত্তি কম। যিনি মোদী-শাহের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার পথে হাঁটার সাহস দেখাবেন না। তবে একই সঙ্গে তাঁর সঙ্গে সঙ্ঘের যোগ থাকা আবশ্যিক। কারণ বিজেপি সভাপতি পদে কাউকে বসাতে গেলে সঙ্ঘের অনুমোদন আবশ্যিক।
রাজ্যে-রাজ্যে সাংগঠনিক নির্বাচন শেষ করে আগামী জানুয়ারির মধ্যে দলের জন্য নতুন জাতীয় সভাপতিকে বেছে নিতে চাইছেন বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। বর্তমানে জাতীয় সভাপতি জে পি নড্ডা। যিনি জাতে ব্রাহ্মণ। সংরক্ষণ প্রশ্নে দেশে গেরুয়া শিবিরের প্রতি ওবিসি সমাজের বাড়তে থাকা অসন্তোষকে মাথায় রেখে কোনও ওবিসি নেতাকেই দলের সভাপতি করার পরিকল্পনা নিয়ে গোড়ায় এগিয়েছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু মাঝে অমিত শাহের অম্বেডকর নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্যে সেই পরিকল্পনা যে বেশ ধাক্কা খেয়েছে, তা ঘরোয়া ভাবে মেনে নিচ্ছেন দলের নেতারা।
অমিত শাহের মন্তব্যের কারণে দলিত সমাজের বড় অংশ ক্ষুব্ধ। ধারাবাহিক ভাবে বিরোধীরা দেশ জুড়ে এ নিয়ে প্রচার চালানোয় বেশ ব্যাকফুটে বিজেপি। তা ছাড়া এ বারের লোকসভা ভোটেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল যে, গত দু’টি লোকসভা নির্বাচন যে দলিত সমাজ একজোট হয়ে বিজেপিকে সমর্থন করেছিল, তাদের অনেকাংশের মোহভঙ্গ হয়েছে। দলিতদের ভোটের বড় একটা অংশ বিরোধীদের ঘরে চলে যাওয়ার ফলে উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানার মতো রাজ্যে লোকসভা নির্বাচনে খারাপ ফল করেছে বিজেপি।
এই আবহে পাল্টা রণকৌশল হিসাবে দলিত কোনও চেহারাকে দলের শীর্ষ পদের বসানোর কথা ভাবছেন বিজেপি নেতৃত্বের একাংশ। দলের ওই অংশের মতে, এতে বিজেপি যে দলিত-বান্ধব, সেই বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে। তা ছাড়া কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খড়্গে দলিত সমাজের প্রতিনিধি। বিজেপি থেকে দলিত কোনও নেতাকে বেছে নিলে লড়াই তুল্যমূল্য হবে। পাশাপাশি দল যে দলিত সমাজের পাশে রয়েছে, সেই বার্তা দেওয়াও সম্ভব হবে। তবে সভাপতি কে হবেন, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত মোদীই নেবেন বলে মেনে নিচ্ছেন বিজেপি নেতারা। বিজেপির এক নেতার কথায়, ‘‘সভাপতি যে সমাজেরই হোক না কেন, শেষ পর্যন্ত কে হবেন, সে সিদ্ধান্ত নেবেন প্রধানমন্ত্রী। মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ় বা রাজস্থানে যেমন প্রায় অচেনা ব্যক্তি মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন, এ ক্ষেত্রেও চর্চিত সব নাম ছাপিয়ে কোনও স্বল্প পরিচিত নেতা যদি শেষ পর্যন্ত সভাপতি হন, তা হলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।’’