শরীরে কী প্রভাব ফেলতে পারে ‘ককটেল’ ওষুধ? ছবি: ফ্রিপিক।
প্যারাসিটামলের বিক্রি কি বন্ধ হয়ে গেল? তা কিন্তু হয়নি। যে ওষুধটি নিষিদ্ধ হয়েছে, তা হল প্যারাসিটামলের সঙ্গে অন্য ওষুধের ‘কম্বিনেশন’ বা ‘মিশ্রণ’। কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলের বিজ্ঞপ্তি দেখে অনেকেরই চোখ কপালে উঠেছে। ১৫৬টি ‘কম্বিনেশন’ ওষুধ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। জ্বর, সর্দিকাশি, অ্যালার্জি, ত্বকের সংক্রমণ, পেট ব্যথা-সহ একাধিক পরিচিত ওষুধের নাম রয়েছে সেই তালিকায়। এখন কথা হল, প্যারাসিটামল, সেট্রিজ়িন বা কিছু ভিটামিনের মতো নাম দেখে ঘাবড়ে যাবেন না। কারণ মূল ওষুধগুলি নিষিদ্ধ হয়নি, হয়েছে তাদের মিশ্রণ বা ককটেল ওষুধ। এই জাতীয় ওষুধের প্রভাব মানুষের শরীরে কেমন, তা নিয়ে তর্কবিতর্ক বহু দিনের। এর আগেও এমন বহু মিশ্র ওষুধ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। এখন বেছে বেছে ১৫৬টির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। কেন এমন ওষুধের বিক্রি বন্ধ হল, তার ব্যাখ্যা আনন্দবাজার অনলাইনকে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা।
চিকিৎসার ভাষায় এই ‘কম্বিনেশন’ ওষুধগুলিকে বলা হয় ‘এফডিসি’ অর্থাৎ, ‘ফিক্সড ডোজ় কম্বিনেশন’। একাধিক ওষুধ বিভিন্ন মাত্রায় যোগ করে একটি ওষুধ তৈরি হয়। সহজ করে বললে, একাধিক রাসায়নিক গঠনযুক্ত ওষুধ। এ সব ওষুধের নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন আগেও উঠেছিল। এই বিষয়ে মধ্য কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের নিউক্লিয়ার মেডিসিনের চিকিৎসক সোনালি ঘোষ বললেন, “প্যারাসিটামলের সঙ্গে অ্যাসিক্লোফেন্যাক মিশিয়ে কম্বিনেশন করা হয়েছিল। এই ওষুধ দীর্ঘ দিন ধরে খেতে থাকলে লিভার ও কিডনির জটিল রোগ হওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। এমন আরও অনেক অ্যান্টিবায়োটিক ও ব্যথানাশক ওষুধ আছে, যাদের মিশ্রণ বাজারে চালু ছিল। ধরুন, যার জ্বর ও গায়ে ব্যথা রয়েছে, তাঁকে দুটি আলাদা ওষুধ না দিয়ে একটি কম্বিনেশন দেওয়া হল। কিন্তু দুটি ওষুধ যে মাত্রায় মেশানো হয়েছে, তা সেই রোগীর শরীরের জন্য কার্যকরী না-ও হতে পারে। ওষুধটি খেতে শুরু করলে তার বিভিন্ন রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে।” সোনালি বলছেন, ‘‘সেট্রিজ়িন খেলে খুব ঘুম পায়। যথেষ্টই কড়া ওষুধ। এর সঙ্গে যদি অন্য অ্যান্টিবায়োটিকের মিশ্রণ করা হয়, তা হলে দুটি মিলে শরীরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতেই পারে। এখন রোগী যদি চিকিৎসকের পরামর্শ না নিয়েই তেমন ওষুধ কিনে খান, তা হলে অন্য জটিল রোগের আশঙ্কা বাড়বেই। তাই এমন ধরনের ওষুধ না খাওয়াই ভাল।’’
বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালের স্নায়ুরোগ চিকিৎসক অনিমেষ করের বক্তব্যও অনেকটাই এক। তাঁর মতে, “সুগার বা প্রেশারের ওষুধের মিশ্রণ তা-ও মানা যায়। কারণ, দীর্ঘ সময় খেতে হয় এমন ওষুধ। যিনি চার থেকে পাঁচটি ওষুধ খান, তাঁকে একটি দিলে সুবিধাই হবে। কিন্তু কম সময়ে খাওয়ার অ্যান্টিবায়োটিক বা ব্যথানাশক ওষুধের যদি মিশ্রণ বানিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে সেগুলির অনুপাত একটু এ দিক-ও দিক হলেই শরীরে খারাপ প্রভাব পড়বে।” বছর কয়েক আগে এমন ওষুধ সম্পর্কে প্রশ্ন তোলে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যুগ্ম সংসদীয় কমিটি। ড্রাগ কন্ট্রোল কী ভাবে সেগুলিকে অনুমোদন দিল, কমিটি তার রিপোর্টও তলব করে। অনিমেষ বলছেন, এই ‘কম্বিনেশন’ ওষুধগুলি নিয়ে তেমন গবেষণা হয় না। একটি বা দুটি গবেষণাপত্রের উপর ভিত্তি করে এমন ওষুধকে অনুমোদন দেওয়া ঠিক নয়। একটি ওষুধ হলে তার উপাদান, ট্রায়ালের ফল ও কার্যকারিতার বিস্তারিত রিপোর্ট থাকে। কিন্তু একাধিক ওষুধ মিলিয়ে যেটি তৈরি হচ্ছে, সেটির ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব কতটা, সে নিয়ে কোনও নির্ভরযোগ্য তথ্য থাকে না। এমন অনেক মিশ্র ওষুধ আছে যেটি অনুমোদন পাওয়ার ৬ মাসের মধ্যে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। কাজেই ভবিষ্যতে ‘কম্বিনেশন ড্রাগ’ বাজারে চালু করার আগে ভাবনাচিন্তা করে দেখা উচিত।
প্যারাসিটামল নিরাপদ ওষুধ। কিন্তু এর সঙ্গে যখন আইবুপ্রোফেন মিশছে, তখন সেটির প্রভাব কার শরীরে কেমন হবে, তা বলা সম্ভবই নয়। এমনটাই জানাচ্ছেন বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য, “ইংল্যান্ড, আমেরিকায় ককটেল বা মিশ্র ওষুধের চল নেই। সেখানে প্যারাসিটামল বলতে প্যারাসিটামলকেই বোঝায়। তার সঙ্গে আরও চারটি অ্যান্টিবায়োটিক জুড়ে দিয়ে ওষুধ তৈরি হয় না। আমাদের দেশে বিভিন্ন সংস্থা তাদের মতো অনুপাতে একাধিক রাসায়নিক গঠনের ওষুধ মেশাচ্ছে। তাই সেগুলি কতটা নিরাপদ, তা যাচাই করা সম্ভবই নয়। রোগী তো আরও বুঝতে পারবেন না।”
মল্লিনাথের মত, কম্বিনেশন ওষুধ বিক্রির আরও কিছু অসুবিধা আছে। যেমন, এখন নিয়ম হয়েছে জেনেরিক নামেই ওষুধের নাম লিখতে হবে প্রেসক্রিপশনে। এ নিয়ে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন (এনএমসি)। জেনেরিক মানে হল ব্র্যান্ড নাম না লিখে নির্দিষ্ট ওষুধ কী কী নামে ও উপাদানে বিক্রি হচ্ছে, তা বিস্তারিত লিখতেই হবে। কম্বিনেশন ওষুধের ক্ষেত্রে সমস্যা হল, কী কী ওষুধ মেশানো হচ্ছে ও কী কী মাত্রায় তার কোনও নির্দিষ্ট মাপকাঠি নেই। তাই রোগীর জন্য সেটা ভাল হবে না মন্দ, তা বোঝাও যায় না আগে থেকে।
মশা মারতে কামান দাগার কি কোনও দরকার আছে? কম্বিনেশন ওষুধকে গোলমেলে বলেই মনে করছেন অস্থিরোগ চিকিৎসক সুব্রত গড়াই। তাঁর মতে “আউটডোরে অনেক কম্বিনেশন ওষুধ থাকে যা রোগীদের দেওয়া হয়। কিন্তু সেই ওষুধগুলিই নিষিদ্ধ হচ্ছে যেগুলি হয় আইনসম্মত নয়, না হলে সেগুলির কার্যকারিতা নিয়ে সংশয় রয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা তাদের ওষুধ ভাল বলে বাজারে বিক্রির চেষ্টা করেছে। এমন অনেক ওষুধ এত দিন ধরে বিক্রি হচ্ছিল, যেগুলি চিকিৎসকরা প্রেসক্রাইবও করেন না। অ্যান্টিবায়োটিকের এমন অনেক ককটেল আছে, যেগুলি খেলে ‘অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স’ তৈরি হবে শরীরে। তাই না খাওয়াই ভাল।”
সব ককটেল ওষুধ মন্দ নয়, কিন্তু যেগুলির গবেষণাই হয়নি, সেগুলি পুরোপুরি বেআইনি, এমনটাই জানালেন বাইপাসের একটি বেসরকারি হাসপাতালের সিনিয়র কার্ডিয়োলজিস্ট দিলীপ কুমার। তাঁর মতে, “একে বলা হয় ফাইটোডায়ানামিক্স। ওষুধের রাসায়নিক গঠন, কোন উপাদানের কী কার্যকারিতা তা জানতে হয় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। হাইপারটেনশনের এমন অনেক ওষুধ আছে যেগুলির মিশ্রণ করলেই রোগীর সুবিধা হয়। খরচও কম হয়। অর্থাৎ, চারটে ওষুধ না কিনে একটি কিনতে হয়। কিন্তু সেই ওষুধ গবেষণা দ্বারা প্রামণিত এবং কেন্দ্রীয় ড্রাগ নিয়ামক সংস্থার অনুমোদন প্রাপ্ত।” দিলীপ কুমারের বক্তব্য, এমন অনেক ‘কম্বিনেশন’ ওষুধ আছে, যেগুলির উপাদান ও অনুপাত ওষুধ নির্মাতা সংস্থাগুলি নির্ধারণ করে। তাই তেমন ওষুধ খেলে রোগীর শরীরে মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে।
‘ককটেল’ বা মিশ্র ওষুধ নিজে থেকে চেনার উপায় নেই। কারণ ওষুধের পাতায় তা লেখা থাকে না। একমাত্র চিকিৎসকই তা প্রেসক্রাইব করতে পারেন। তবে বিভিন্ন ভুয়ো সংস্থা বা ওষুধের দোকান এই জাতীয় ওষুধ অনুমোদন ছাড়াই বিক্রি করছে কি না, তা-ও চিন্তার বিষয়। সে কারণেই কেন্দ্রীয় সরকার উদ্যোগী হয়ে তেমন কিছু ওষুধের উৎপাদন ও বিক্রি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। তাই মামুলি জ্বর, সর্দিকাশি হলেও নিজে থেকে কখনও ওষুধ কিনে খাওয়া উচিত নয়।