‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’ কী, কোন কাজে লাগে, কেন লোকমুখে এর নাম এত ছড়াচ্ছে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
কোনও ওয়েবসাইটে যদি নতুন লগইন করেন, তা হলে দেখবেন স্ক্রিনের উপরে একটি ‘পপআপ’ ভেসে উঠেছে। সেখানে আপনাকে পাসওয়ার্ড ‘সেভ’ করে রাখার অপশন দেবে। আপনি চাইলে তাতে সম্মতি দিতে পারেন, আবার না-ও দিতে পারেন। এখন মনে হতেই পারে সেটি কী? যত বারই কোনও নতুন সাইটে গিয়ে নিজের অ্যাকাউন্ট খুলছেন, তত বারই সেই চিরকুট ভেসে উঠছে স্ক্রিনে। আরও একটি ব্যাপার খেয়াল করেছেন? গুগ্ল ক্রোমে গিয়ে ডান দিকের উপরে ন’টি ডটে ক্লিক করুন। এ বার স্ক্রল করে নীচে নামার সময়ে দেখবেন একটি নীল-লাল-হলদ-সবুজ রঙের চাবির ছবি রয়েছে। এই চাবিই হল সেই মোক্ষম অস্ত্র, যা অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করছে। এরই নাম হল ‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’, যা নিয়ে এখন বিশ্বজুড়ে হইচই চলছে।
‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’ কী, কোন কাজে লাগে, কেন লোকমুখে এর নাম এত ছড়াচ্ছে— তা জানতে হলে কয়েকটি ব্যাপার জেনে নেওয়া জরুরি। খেয়াল করে দেখুন তো, ডিজিটাল প্রযুক্তি যত এগোচ্ছে, তত খাটাখাটনির বহর কমে যাচ্ছে। আগে ফোন নম্বর মনে রাখতে তা ডায়েরির পাতায় লিখে রাখতে হত। প্রায় সব বাড়িতেই ছিল সেই সরু-লম্বাটে ফোন নম্বর লেখার ডায়রি। তাতেই শয়ে শয়ে নম্বর লেখা থাকত। ঘেঁষাঘেঁষি, গাদাগাদি করে লিখে রাখা নম্বর অনেক সময়ে খুঁজেও পাওয়া যেত না। স্মার্টফোন আসার পর সেই পরিশ্রমে ইতি পড়ে। কারণ, ফোন তার স্মৃতিতেই ধরে রাখে সব কিছু। মানুষের স্মৃতি আর কাজে লাগানোর দরকার পড়ে না। ঠিক তেমনই, ইন্টারনেট প্রযুক্তিতেও। এখন হাজারটা অনলাইন সাইট, বিভিন্ন রকম অ্যাপ, ই-কমার্স সাইট। এত দিন কেবল গুগ্লের পাতাতেই আনাগোনা ছিল যাঁদের, তাঁরা এখন অনলাইনে কেনাকাটা, খাবার অর্ডার, ব্যাঙ্কিং, এমনকি, বাড়ির টিভি-বিদ্যুতের বিল জমা দেওয়া থেকে শুরু করে টাকাপয়সার লেদনেন-ব্যবসা— কী না করছেন! আর যতই নিত্য নতুন অ্যাকাউন্ট খুলছেন, ততই পাসওয়ার্ডের সংখ্যা বাড়ছে। এখন কোন সাইটে লগইনের জন্য কী পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন, তা মনে রাখা খুবই ঝক্কির কাজ। সেই কাজটিই সহজে করে দিচ্ছে ‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’। এর কাজ হল মনে রাখা। আপনি যা পারছেন না, আপনার হয়ে সে তা করে দিচ্ছে। আপনাকে শুধু পাসওয়ার্ড মনে রাখার সম্মতিটুকু দিতে হবে।
ঠিক যেন চাবির গোছা
‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’ হল এক ধরনের সফট্ওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন, যার কাজ অনেক। আসল কাজ হল মনে রাখা। অনলাইনের কোন অ্যাকাউন্টে আপনি কী পাসওয়ার্ড দিয়েছিলেন, তা আপনি ভুলে গেলেও এই সফট্ওয়্যার ভুলবে না। ফের যখন সেই সাইটে লগইন করবেন, তখন আর আপনাকে পাসওয়ার্ড মনে করে টাইপ করতে হবে না। এই সফট্ওয়্যারই সেই কাজ করে দেবে। ভেবে দেখুন, অনেকটা চাবির গোছার মতো। সেই মা-ঠাকুরমাদের আঁচলে একসঙ্গেই বাঁধা থাকত ডজন খানেক চাবি। এমনই শক্ত বাঁধন যাতে একটি চাবিও না হারিয়ে যায়। ‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’ হল সেই চাবির গোছাখানি। আপনার যদি অনলাইনে একাধিক অ্যাকাউন্ট থাকে, তা হলে সব ক’টির পাসওয়ার্ড শক্ত করে বেঁধে রাখবে ‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’। সেখান থেকে হারিয়ে যাওয়ার রাস্তা নেই। আপনাকে কষ্ট করে মনে রাখতে হবে না।
পাসওয়ার্ডের জটিল গ্যাঁড়াকল বুঝি না বাপু!
সে বোঝার দরকার নেই। ‘পাসওয়ার্ড ম্যানেজার’ কী করতে আছে! এটি হল তার দ্বিতীয় কাজ। এই বিষয়ে সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ রাজর্ষি রায়চৌধুরী বললেন, “এখন সব সাইটেই ‘স্ট্রং পাসওয়ার্ড’ চায়। মানে ধরুন, কারও নাম বা একই রকম সংখ্যা এমন নয়। পাসওয়ার্ডে থাকতে হবে অক্ষর, যতিচিহ্ন, সংখ্যা সবই। অক্ষর বড় হাতের (ক্যাপিটাল) ও ছোট হাতের (স্মল) মিলিয়ে করতে হবে। পাসওয়ার্ড এমন হতে হবে, যা চট করে হ্যাকারদের কবলে যেতে পারবে না। তেমন পাসওয়ার্ড অনেকেই তৈরি করতে পারেন না। কিন্তু পাসওয়ার্ড ম্যানেজার তা করে দেবে আপনার হয়ে।” সহজ উদাহরণ দিয়ে বোঝালেন রাজর্ষি। ধরা যাক, কোনও অনলাইন ই-কমার্স সাইটে আপনি অ্যাকাউন্ট খুলেছেন। সেখানে কেনাকাটি করবেন, তার মানে অনলাইনে টাকাপয়সার লেনদেনও হবে। কাজেই আপনার অ্যাকাউন্টটি সুরক্ষিত রাখা জরুরি। সে জন্য অ্যাকাউন্টে লগইন করা সময়ে সেই অনলাইন সাইট বা অ্যাপের তরফ থেকেই আপনার কাছে ‘স্ট্রং পাসওয়ার্ড’ চাওয়া হবে। আপনি না পারলে সেটি আপনার হয়ে করে দেবে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার। যত অ্যাকাউন্টই থাকুক না কেন আপনার, প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা ‘স্ট্রং পাসওয়ার্ড’ বেছে নেবে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার। আপনাকে আর সেগুলি মনে রাখতে হবে না। এখানেই এই সফট্ওয়্যারের সুবিধা।
কী ভাবে কাজ করবে?
আপনার কাজ হল পাসওয়ার্ড ম্যানেজারকে সুরক্ষিত রাখা। পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে ঢোকার জন্য একটি শক্তিশালী পাসওয়ার্ড (মাস্টার পাসওয়ার্ড) বেছে নিতে হবে এবং কেবল সেটিই মনে রাখতে হবে। বেঙ্গালুরুর একটি তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার সফট্ওয়্যার ডেভেলপার শুভজিৎ দাস এই বিষয়ে বললেন, “সহজে মনে রাখার জন্য অনেকে তাদের একাধিক অ্যাকাউন্টে একই পাসওয়ার্ড দিয়ে দেন। এটি নিরাপদ নয়। কারণ একটি পাসওয়ার্ড চুরি গেলে সব অ্যাকাউন্টের ব্যক্তিগত ও গোপন তথ্য হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই প্রতিটি অ্যাকাউন্টের জন্যই আলাদা আলাদা পাসওয়ার্ড দেওয়া জরুরি। আর সেগুলি মনে রাখার জন্যই পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের ব্যবহার করা যেতে পারে। ওয়েব সার্ভার থেকে পাসওয়ার্ড ম্যানেজারকে কাজে লাগানো যাবে, আবার গুগল প্লে স্টোরেও অনেক অ্যাপ চলে এসেছে। কতগুলির আবার লাইসেন্স আছে যা আপনাকে টাকা দিয়ে সাবস্ক্রাইব করতে হবে।”
নিরাপদ তো?
‘ওয়ান পাসওয়ার্ড’, ‘লাস্টপাস’, ‘কিপাস’, ‘এনপাস’, ‘বিটওয়ার্ডেন’, ‘ড্যাশলেন’, ‘পাসওয়ার্ড বস’ এমন অনেক পাসওয়ার্ড ম্যানেজার রয়েছে, যা গ্রাহকদের পাসওয়ার্ড সুরক্ষিত রাখে। শুভজিৎ বোঝালেন, অনলাইনে কিছু সেভ করে রাখা মানেই সেখানে ঝুঁকি থেকে যায়। কিন্তু ভাল পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের তিন স্তরীয় সুরক্ষা থাকে। যে সংস্থা সেই সফট্ওয়্যার তৈরি করেছে, তারা গ্রাহকদের ব্যক্তিগত তথ্য সংরক্ষণ করে রাখলেও তা তৃতীয় ব্যক্তির হাতে যেতে দেয় না। কারণ, এর সঙ্গে ‘টু-ফ্যাক্টর-অথেনটিকেশন’ জুড়ে রয়েছে। তা ছাড়া, পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের জন্যও আপনি আবার ‘মাস্টার পাসওয়ার্ড’ দিয়ে রাখছেন, যা কেবল আপনিই খুলতে পারবেন। কেবল আপনার আর সফট্ওয়্যারের মধ্যেই সেই গোপনীয়তাটুকু বজায় থাকবে। আর যেহেতু ‘ডেটা এনক্রিপ্ট’ করা থাকবে, তাই হাতছাড়া হওয়ার ভয় কম। আপনার ব্যক্তিগত তথ্যে নজর দিতে হলে হ্যাকারদের সেই তিন স্তরের নিরাপত্তা ভাঙতে হবে যা সহজসাধ্য নয়।
সব ধরনের ব্রাউজ়ার ও অপারেটিং সিস্টেমে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ব্যবহার করতে পারেন। কেউ আপনার অ্যাকাউন্টে ঢোকার চেষ্টা করলে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার সতর্ক করবে। তখন সেই অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডটি বদলে ফেলতে পারবেন। শুভজিৎ আরও বললেন, আপনার তথ্য আরও বেশি সুরক্ষিত রাখতে সময়ান্তরে সব অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডই বদলে নেবেন। এমনকি, সফট্ওয়্যারের মাস্টার পাসওয়ার্ডটিও বদলে ফেলবেন। কারণ, সেগুলি মনে রাখার ঝক্কি আপনাকে নিতে হবে না।
বিপদ বলেকয়ে আসে না
পাসওয়ার্ড ম্যানেজারও যে সব সময়েই সুরক্ষিত থাকবে, সে কথা মানতে চান না সাইবার আইন বিশেষজ্ঞ রাজর্ষি। তাঁর মতে, অনলাইনে নিজের ব্যক্তিগত তথ্য জমা করে রাখা মানেই বিপদ ডেকে আনা। আপনি যে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ইনস্টল করলেন, তা কতটা বিশ্বাসযোগ্য, তা জানার উপায় সব সময়ে থাকে না। আবার ধরুন, যদি কখনও বড়সড় সাইবার অপরাধের ঘটনা ঘটে যায়, তা হলে কী হবে? হ্যাকাররা তো সরকারি ওয়েবসাইটের গোপন তথ্যও হ্যাক করে ফেলছে। মেঘের আড়াল থেকে বাণ হেনেই মেঘনাদ হয়ে উঠেছিল রাবণ-পুত্র ইন্দ্রজিৎ। আধুনিক প্রযুক্তি-বিশ্বে সেই ভূমিকা নিয়েছে হ্যাকারেরা। কখন, কী ভাবে হ্যাকার-হানা হবে, বিজ্ঞানী ও ইঞ্জিনিয়ারেরা এখনও তা বুঝে উঠতে পারছেন না। সুরক্ষা-জাল ছিঁড়তে হ্যাকাররা বিভিন্ন রকম ‘ম্যালওয়ার’ ব্যবহার করছে। হ্যাকার-দাপটে ইন্টারনেট এবং ক্লাউ়ড ব্যবহারকারী বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির ঝুঁকি বেড়েছে। হয়তো আপনিই কোনও অজানা লিঙ্কে ক্লিক করে ফেললেন অথবা এমন সফট্ওয়্যার ডাউনলোড করে ফেললেন যা আসলে ‘ম্যালওয়ার’। তখন আপনার ডিভাইসের সমস্ত তথ্যই হ্যাকারদের হাত ঘুরে চলে যাবে ডার্ক ওয়েবে। তাই রাজর্ষির মত, “নিজের ব্যক্তিগত তথ্য নিজের কাছেই রাখুন। আবার এক বার ডায়রি-পেন নিয়ে বসুন না। কিছু সময় যাবে এই যা! বড়সড় ক্ষতির হাত থেকে তো বাঁচবেন!”