Early periods Causes

ঋতুস্রাব শুরুর গড় বয়স এগিয়ে আসছে! এখন কেন এত তাড়াতাড়ি ঋতুমতী হচ্ছে শিশুকন্যারা?

এই প্রজন্মের শিশুকন্যাদের ঋতুস্রাবের সূচনা পর্ব এগিয়ে আসছে। শারীরিক সমস্যা, না কি মানসিক চাপ— ‘আর্লি পিউবার্টি’-র নেপথ্যে রয়েছে কে? কী বলছেন চিকিৎসকেরা?

Advertisement
অঙ্কিতা দাশ
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৪ ১০:২২

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সপ্তাহখানেক আগেই ছয় পূর্ণ করে সবেমাত্র সাত বছরে পা দিয়েছে রোহিনী। স্কুলের তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ে সে। স্কুল থেকে ফিরে হঠাৎ এক দিন পোশাকে রক্তের দাগ দেখে রীতিমতো আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। মা-বাবার ভয়ে সে কথা প্রথমটায় কাউকে বলতেও পারেনি শিশুটি। বাড়িতে রোহিনীকে যিনি দেখাশোনা করেন, তাঁর কাছে বলতেও কুণ্ঠাবোধ করছিল। অবশেষে তাঁর হস্তক্ষেপেই বিষয়টি সকলের সামনে আসে।

Advertisement

নির্দিষ্ট একটি বয়সের আগে মেয়েকে স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ার পাঠ দিতে হবে, সে কথা জানতেন রোহিনীর মা-বাবা। কিন্তু এমন অতর্কিতে (বলা ভাল অসময়ে) ঋতুচক্র হানা দেবে, সে কথা কেউই আঁচ করতে পারেননি। তাই মানসিক ভাবে মেয়েকে প্রস্তুত করারও সুযোগ পাননি। মেয়ের শরীরে হঠাৎ এমন পরিবর্তনে রোহিনীর মা-বাবা দু’জনেই স্তম্ভিত। কিন্তু পুতুল খেলার বয়সে স্যানিটারি প্যাডের সঙ্গে বন্ধুত্ব কি নিতান্তই একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা? না কি এই প্রজন্মের মেয়েদের বয়ঃসন্ধি এগিয়ে আসছে? কী বলছেন চিকিৎসকেরা?

শিশুকন্যা আর শিশু নেই। তার প্রথম লক্ষণ হল ঋতুস্রাব শুরু হওয়া। মেয়েদের সাধারণত ১৪ থেকে ১৫ বছর বয়সে প্রথম ঋতুচক্র শুরু হয়। তবে ইদানীং এই ছন্দে একটু অদলবদল ঘটছে। রোহিনীর বয়সি অনেকেই প্রথম ঋতুচক্রের সম্মুখীন হচ্ছে ৬ কিংবা ৭ বছর বয়সে। তা নিয়ে অভিভাবকদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়ছে। আগেও যে এমনটা হত না, তা নয়। তবে সেই সংখ্যাটা হাতেগোনা। ঠাকুরমা-দিদিমাদের প্রচলিত ধারণা ছিল, অল্প বয়সে পেকে যাওয়ার অন্যতম লক্ষণ হল তাড়াতাড়ি মানে, সঠিক বয়সের অনেকটা আগে ঋতুস্রাব শুরু হওয়া। আবার, অনেকেই মনে করেন, ঋতুস্রাবের এগিয়ে আসার পিছনে যে ইতিহাস রয়েছে, তা জিনগত। অর্থাৎ, শিশুটির বংশের কোনও মহিলা যেমন মা-মাসি-পিসিদের খুব ছোট বয়সে ঋতুচক্র শুরু হলে তার মধ্যেও সেই সম্ভাবনা প্রকট হয়ে ওঠে। স্ত্রীরোগ চিকিৎসক সঞ্জীব দত্তের মতে, এ কথা খানিকটা ঠিক। তবে সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সঞ্জীববাবু বলেন, “ঋতুস্রাবের সূচনা তাড়াতাড়ি হওয়ার নেপথ্যে অনেকগুলি কারণ থাকে। তার মধ্যে জিনগত কারণও একটি। অনেক ক্ষেত্রেই জেনেটিক প্রি-ডিসপোজিশন থাকে। তবে নির্ধারিত বয়সের অনেকটা আগে ঋতুচক্র শুরু হয়ে যাওয়া মানেই কিন্তু তা জিনগত নয়।”

কোনও দেশের জলবায়ু পরিবর্তনের মতো মেয়েদের শারীরিক গঠন এবং শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন কার্যকলাপে যে অদল-বদল ঘটছে, তার উল্লেখ রয়েছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গবেষণাপত্রে। ১৮৪০ সালে উন্নত দেশগুলিতে মেয়েদের ঋতুচক্র শুরু হওয়ার বয়স ছিল গড়ে ১৭ বছর। প্রায় ১৬০ বছর পর অর্থাৎ, ২০০০ সালে সেই রেখাচিত্রটাই বদলে গেল। অন্তত পক্ষে পাঁচ বছর এগিয়ে এল ঋতুস্রাব শুরুর বয়স। তার জন্য অবশ্যই জিন এবং পরিবেশের ভূমিকা রয়েছে। খাদ্যাভাসের পরিবর্তনও এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রক্রিয়াজাত খাবারের প্রতি নির্ভরশীলতা স্থূলত্বের সমস্যা ডেকে আনছে। অতিরিক্ত ফ্যাটজাত খাবার মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের ক্ষরণ বাড়িয়ে তুলছে।

নির্দিষ্ট বয়সের আগে ঋতুচক্র শুরু হওয়ার সঙ্গে কিন্তু শারীরিক এবং মানসিক নানা রকম সমস্যার যোগ রয়েছে। মস্তিষ্কের কোথাও টিউমার হলেও হরমোনের মাত্রায় পরিবর্তন আসতে পারে। আবার, এমন অনেক ওষুধ রয়েছে, যা প্রয়োগ করলেও হরমোনের হেরফের ঘটে। ফলে মেয়েদের শারীরিক বাড়বৃদ্ধি হয় দ্রুত গতিতে। সেই কারণেও কিন্তু মেনার্কি বা প্রথম ঋতুস্রাব শুরুর দিন এগিয়ে আসতে পারে। প্রচণ্ড উদ্বেগ, মানসিক চাপেও হঠাৎ শারীরিক পরিবর্তন আসতে পারে। বছর তিন আগে মানুষের জীবনে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছিল কোভিড। হঠাৎ, আবির্ভূত হওয়া এই ভাইরাসটির সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে অনেক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এই যুদ্ধে টিকে গিয়েছেন, তাঁদের শারীরিক ছন্দে বিপুল পরিবর্তন এসেছে। তার মধ্যে কম বয়সে ঋতুচক্রের সূচনা অন্যতম।

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অতিমারি এবং তার পরবর্তী সময়ে সকলেরই মানসিক চাপ বেড়েছে। অনলাইন স্কুল, চার দেওয়ালের মধ্যে আবদ্ধ জীবন, কর্মহীনতার উদ্বেগ, প্রিয়জন হারানোর উৎকণ্ঠা— সবই রয়েছে। এই সবের প্রভাবে শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলেই কোনও না কোনও পরিবর্তনের সম্মুখীন হচ্ছেন। তৎক্ষণাৎ না হলেও এক এক জনের শরীরে এক এক রকম উপসর্গ প্রকট হচ্ছে। কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমোতেন যে মানুষ, হয়তো তিনি এখন অনিদ্রাজনিত সমস্যায় ভুগছেন। অল্পবয়সিদের মধ্যে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবিটিসের মতো সমস্যা বেড়েছে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, হরমোনের মাত্রায় ব্যাপক হেরফের হয়েছে করোনাজয়ীদের মধ্যে। এ বিষয়ে স্ত্রীরোগ চিকিৎসক অভিনিবেশ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “পুরো বিষয়টিই কিন্তু ঘটছে হরমোনের কারসাজিতে। তা শুধু কোভিড কেন, আমরা যে প্লাস্টিকের বোতলে জল খাই, সেখান থেকে এক ধরনের রাসায়নিক বেরোয়। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, ওই রাসায়নিকটি মেয়েদের শরীরে ইস্ট্রোজেনের মতো কাজ করে। যে কোনও কারণে মেয়েদের শরীরে স্বাভাবিকের চেয়ে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা বেড়ে গেলেই পিউবার্টি বা বয়ঃসন্ধি এগিয়ে আসতে পারে। তাই কোভিড পরবর্তী সময়ে মেনার্কি এগিয়ে আসার ঘটনা এখন খুবই স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে।”

বয়ঃসন্ধি এগিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে কৈশোর এবং পরবর্তী কালে নানা শারীরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিকিৎসকেরা বলছেন, যাঁদের সময়ের আগে ঋতুচক্র শুরু হয়, তাঁদের মধ্যে স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ২৩ শতাংশ বেশি। এ ছাড়া, হার্টের শিরা-ধমনী সংক্রান্ত রোগ, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবিটিসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পায়। মেনস্ট্রুয়াল সাইকল শুরু হলে অনেক শিশুই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে। অনেকের মধ্যে আত্মহননের প্রবণতাও বেড়ে যায়। তাই যে সময়েই বয়ঃসন্ধি আসুক না কেন, দেখে নেওয়া জরুরি, তার সঙ্গে শারীরিক কোনও জটিলতা রয়েছে কি না। পাশাপাশি, মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখাও জরুরি।

আরও পড়ুন
Advertisement