বিআরআই আসলে কী? নিজেকে মাপবেন কী ভাবে? প্রতীকী ছবি।
বিএমআর এবং বিএমআই— শব্দ দু’টিই আমাদের কাছে বেশি পরিচিত। বিএমআই, অর্থাৎ, বডি মাস ইনডেক্স। মানে হল, ওজন ও উচ্চতার অনুপাত। বিএমআই যত বেশি হবে, ততই নাকি খারাপ। অন্য দিকে, বিএমআর-এর পুরো কথাটি হল, বেসাল মেটাবলিক রেট। এর সঙ্গেও রয়েছে সেই ওজন আর বিপাকহারের সম্পর্ক। এই দুইয়ের পরিমাপ বুঝলেই বোঝা যাবে স্বাভাবিকের থেকে ওজন কতটা বেশি বা কম। এত দিন এই ‘বিএমআই’ আর ‘বিএমআর’ মেপেই স্থূলত্ব মাপা হত। আর তার থেকে বোঝা যেত স্থূলত্ব বাড়ার কারণে ডায়াবিটিস, হাইপারটেনশন, হার্টের রোগের ঝুঁকি আছে কি না। কিন্তু এখন আরও এক গাণিতিক ফর্মুলা এসে গিয়েছে বিশ্বের অনেক দেশে, যার নাম বিআরআই অর্থাৎ, বডি রাউন্ডনেস ইনডেক্স।
বিআরআই আবার কী?
বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই যেমন উচ্চতার সঙ্গে ওজনের পরিমাপ, বিআরআই হল উচ্চতার সঙ্গে কোমর-নিতম্বের মাপজোক। বোঝা গেল না তো? গবেষক-চিকিৎসকেরা বলছেন, ওজন বেশি মানেই এক জনকে মোটা বলা ঠিক নয়। ধরুন, যাঁর উচ্চতা ৬ ফুট, তাঁর ওজন যা হবে, যাঁর উচ্চতা ৫ ফুট তাঁর ওজন আলাদা হবেই। এ বার ৫ ফুটের ব্যক্তি যদি আড়ে-বহড়ে বেজায় স্থূল হন, কোমরে স্তরে স্তরে চর্বি থাকে, তা হলে তো তার ওজন বেশি হবেই। তখন হয়তো দেখা যাবে, দু’জনেরই বিএমআই এক। তফাত শুধু, এক জনের উচ্চতা বেশি, আর এক জনের কোমরের বেড়। কাজেই হিসাবনিকাশ গোলমাল হয়ে যাবে। ঠিক এই জায়গাতেই কাজ করবে বিআরআই স্কেল। কারণ, সেখানে উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে পেশি আর মেদের আয়তনও মাপা হবে। বিশ্লেষণটা হবে চুলচেরা।
হঠাৎ এই বিআরআই স্কেল নিয়ে আসার দরকার পড়ল কেন, তার পিছনেও নানা গল্প আছে। ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসক ওয়াজ়াহাত মেহাল একটি বিজ্ঞান পত্রিকায় সেই ঘটনার কথা লিখেছেন। তিনি বলছেন, হলিউড সুপারহিরো ‘বডি বিল্ডার’ আর্নল্ড শোয়ার্ৎজেনেগারের বিএমআই স্কেল মেপে তাঁকে বেমালুম মোটা বলে দেওয়া হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ওজন কমানোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। অত্যন্ত পেশিবহুল সুঠাম চেহারার নায়কের তো তাতে চোখ কপালে ওঠার দশা। শেষে কি না ‘টার্মিনেটর’কে মোটা বলা? এ দিকে তাঁর কোমরের মাপ মাত্র ৩২ ইঞ্চি। মেদের বালাই নেই। পরে বিষয়টা বোঝা যায়। বিএমআই-এর কোনও দোষ ছিল না। উচ্চতা ও ওজন মেপে যে গাণিতিক অঙ্ক বেরিয়েছিল, তা ৩০ ছাপিয়ে গিয়েছিল। আর বিএমআই স্কেলে ওজন ও উচ্চতার অনুপাত যদি ২৫ থেকে ২৯.৯ কেজি প্রতি মিটার স্কোয়্যারের মধ্যে হয়, তা হলে ওজন অনুযায়ী ওভারওয়েট বা অতিরিক্ত ওজন বলা যায়। ৩০ পেরিয়ে গেলেই বলতে হবে, ওবেসিটি বা স্থূলত্ব রয়েছে।
এর পরেই বিএমআই স্কেলকে বাতিল করে বিআরআই নিয়ে আসার ভাবনা শুরু হয়ে যায়। ২০১৩ সালে বিএমআই ইনডেক্সের গাণিতিক ফর্মুলা আবিষ্কার করেন আমেরিকার ওয়েস্ট পয়েন্টের এক জন গণিতজ্ঞ ডায়ানা এম থমাস। এই অঙ্ক খুবই জটিল। যদিও অনলাইনে এখন বিআরআই ক্যালকুলেটর পাওয়া যায়। সেখানে ফর্মুলায় নিজের উচ্চতা, কোমরের মাপ ও আনুষঙ্গিক কিছু বিষয় লিখলেই, বিআরআই স্কেল কত, তা বেরিয়ে যাবে।
বিএরআই বিষয়টি ঠিক কী, তা আনন্দবাজার অনলাইনকে বুঝিয়ে বলেছেন পুষ্টিবিদ শম্পা চক্রবর্তী। তাঁর কথায়, “বিআরআই স্কেলে মধ্যপ্রদেশের চর্বির মাপটাই নেওয়া হয়। মানে কোমর, নিতম্ব আর ঠিক ভুঁড়ির কাছাকাছি মেদ কতটা, সেটাই মাপা হয়। কারণ চর্বি পেটের কাছেই বেশি জমা হয়। অর্থাৎ, এক জনের কোমরের মাপ কত, কী মাপের জিন্স পরেন, তা মাপলেও কোমরের পরিধি বেরিয়ে যাবে। বিআরআই স্কেলে সেটিই দরকার পড়বে।” বিআরআই কিন্তু এখানেই শেষ নয়। শম্পার কথায়, ‘‘বিএমআই যা ভুল করেছিল, তা-ই শোধরানোর চেষ্টা হয়েছে বিআরআই-তে। যেমন, বিএমআই ইনডেক্সে কখনওই দেখা হয় না এক জনের লিঙ্গ কী, মহিলা না পুরুষ, তিনি কোথায় বাস করেন, তাঁর খাদ্যাভ্যাস কেমন, জাতীয়তা কী ইত্যাদি। কারণ এই সব কিছুর উপরেও কিন্তু শারীরিক গঠন, ওজন নির্ভর করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে যাঁরা বাস করেন, তাঁদের শরীরের গঠন-উচ্চতা আমেরিকা বা ব্রিটেনের বাসিন্দাদের সঙ্গে মিলবে না। কাজেই প্রত্যেকের বিআরআই আলাদা হবে। এই পরিমাপকে একটি নির্দিষ্ট মাপকাঠি ধরে চললে চলবে না।
কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালের স্ত্রীরোগ চিকিৎসক ও রিজেনারেটিভ মেডিসিনের গবেষক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়ও একই কথা বললেন। তিনি বলেন, “উচ্চতা ও কোমরের মাপ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত। ফ্যাট দু’রকমের হয়— পেশির এবং মেদের। যিনি পেশিবহুল, তাঁর ওজন বেশি হলেও কিন্তু তিনি মোটা নন। আবার যাঁর পেটে থলথলে চর্বি রয়েছে, তাঁর ওজন কিন্তু শুধু মেদের জন্য। কাজেই দু’জনের স্কেলিং সম্পূর্ণ আলাদা হবে। ইংল্যান্ডে বিআরআই চার্ট মানা হয় বেশির ভাগ জায়গাতেই। এ দেশে এখনও এই স্কেলিং টুলের প্রচলন হয়নি।” মল্লিনাথ বুঝিয়ে বললেন, পুরুষ ও মহিলাদের শারীরিক গঠন ও ওজন যেমন আলাদা হয়, তেমনই অঞ্চল ও আবহাওয়া ভেদেও তা আলাদা হয়। যেমন পঞ্জাবিদের শরীরের গঠন বাঙালিদের সঙ্গে মিলবে না। পঞ্জাবিরা জন্মগত ভাবেই লম্বা-চওড়া, পেশিবহুল। বাঙালিরা তেমন নয়। আবার দক্ষিণ ভারতীয়দের সঙ্গে উত্তর ভারতীয়দের চেহারার প্রকৃতির মিল নেই। কাজেই অঞ্চল ভেদেও কিন্তু বিআরআই স্কেল ভিন্ন ভিন্নই হবে। বিএমআই-এর মতো গড়পড়তা হিসেবে নয়।
চিকিৎসক আরও বলছেন, “পেশাগত ভাবেও অনেকের ওজন কম রাখতে হয়, যেমন তারকাদের, খেলোয়াড়দের। তাঁদের বিএমআই স্কেলকে আর পাঁচ জনের সঙ্গে গুলিয়ে ফেললে চলবে না। কিন্তু তা মানা হয় না বেশির ভাগ জায়গাতেই। এখানেই বিএমআই-এর ত্রুটি আর বিআরআই-এর সার্থকতা।” আবার কেবল পেশি নয়, হাড়ের ঘনত্বও কিন্তু বড় ব্যাপার। যাঁর হাড়ের গঠন মজবুত, ঘনত্ব বেশি তাঁর ওজনও বেশি হবে। যেমন, আফ্রিকার বাসিন্দারা আবহাওয়াগত কারণেই বেশি রোদ পান, তাঁদের হাড়ের গঠন যেমন মজবুত, তেমনই পেশির শক্তিও বেশি। তাঁদের বিআরআই স্কেল আমেরিকান বা ইউরোপীয়দের থেকে আলাদা হবেই।
আরও সহজ উদাহরণ আছে। মল্লিনাথ জানাচ্ছেন, জিমে গেলে কিন্তু শুধু ওজন আর উচ্চতা দেখে ব্যায়াম দেওয়া হয় না। অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক শরীরের গঠন দেখেন, কোথায় মেদ জমে আছে তা দেখে ও পরিমাপ করে তবেই নির্দিষ্ট ব্যায়াম দেন। শরীরের কোন অঞ্চলের মেদ কমানোর প্রয়োজন আছে, তা দেখে তবেই ব্যায়াম ঠিক করা হয়। বিআরআই স্কেলও ঠিক তেমন। পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করা হয়। তবে এই অঙ্ক খুবই জটিল। যদিও এখন অনলাইনে বিআরআই ক্যালকুলেটর বেরিয়ে গিয়েছে। সেখানে সব মাপজোক দিয়ে হিসেব বার করা যায়।
হিসেবটা কেমন? শম্পা বুঝিয়ে বললেন, বিআরআই স্কেলে ১ থেকে ২০ অবধি পরিমাপ করা হয়। আদর্শ মাপ হল ২.৪ থেকে ২ .৬। তবে ১ থেকে ১৬-র মধ্যে মাপ এলে তা স্বাভাবিক বলেই ধরা হবে। যদি মাপ ২০ পেরিয়ে যায়, তখন বুঝতে হবে কোমর-নিতম্বের পরিধি অত্যন্ত বেশি। মানে মেদের প্রচণ্ড আধিক্য রয়েছে, যা বিপজ্জনক। বিআরআই স্কেল বিপাকীয় বিভিন্ন অসুখবিসুখ প্রতিরোধেরও ভাল উপায় হতে পারে বলেই মত শম্পার।
ফিটনেস প্রশিক্ষক অনুপ আচার্যের বক্তব্যও এক। তিনি জানালেন, বিএমআই হোক বা বিআরআই, এই স্কেলিং টুলের উদ্দেশ্যই হল এটা বোঝা যে, শরীর কতটা সুস্থ। ওজন বেশি মানেই রোগব্যাধি হবে। পেটের চর্বি বাড়লে হার্টের রোগ, ডায়াবিটিস, উচ্চ কোলেস্টেরল, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বাড়বে। কিছু ক্ষেত্রে কোলন ক্যানসার, পাকস্থলীর ক্যানসারের আশঙ্কাও বাড়বে। তাই কোমর ও নিতম্বের মাপ সঠিক রাখতেই হবে। যদি দেখা যায় বিআরআই স্কেলে মাপ বেশি, সঙ্গে সঙ্গেই সঠিক ডায়েট ও শরীরচর্চা শুরু করতে হবে। সুপ্ত কপোতাসন, উৎকটাসন, বীরভদ্রাসন, বদ্ধকোণাসন, মালাসন, অর্ধপদ্মাসন— এই জাতীয় যোগাসন পেট-কোমর, নিতম্বের চর্বি ঝরাতে পারবে। সেই সঙ্গেই সাইড বেন্ডিং, সাইড লাইং, জাম্প স্কোয়াট, স্টেপ ল্যান্ডিং এই ব্যায়ামগুলিও কার্যকরী হবে। শুধু শরীর ঠিক রাখলেই হবে না, মানসিক চাপ কমানোও জরুরি। অনেক সময়েই দেখা যায়, মেদ বাড়লে তার থেকে টাইপ-২ ডায়াবিটিসের ঝুঁকি বাড়ে। আর ডায়াবিটিস মানেই তার রেশ পড়বে মানসিক স্বাস্থ্যেও। সে ক্ষেত্রে ভ্রামরী প্রাণায়াম, কপালভাতি নিয়মিত করলে উপকার পাওয়া যাবে।
শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জন জয়ন্তকুমার সাহা ভিন্ন মত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “বিএমআই এখনও অবধি আমাদের দেশে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য স্কেলিং পদ্ধতি। বিআরআই কতটা উপযোগী, তা এখনও গবেষণাসাপেক্ষ। কয়েকটি বিজ্ঞান পত্রিকায় এ বিষয়ে লেখা হয়েছে মাত্র। তাই এখনই বলা যাবে না, বিআরআই কতটা সঠিক ও কার্যকরী হতে পারে।”