কতটা ভাল লাইপোসাকশন, ঝুঁকিই বা কতটা? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কলেজপড়ুয়া তরুণী রূপকথার মনে হয়েছিল পুজোর আগে কোমরের রেখাটা আরও একটু সরু হলে ভাল হয়। ৮-৯ ঘণ্টা অফিসের চেয়ারে ঠায় বসে কাজ করা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী চল্লিশ ছুঁইছুঁই মিতালি ঠিকই করে ফেলেছিলেন, জিমে গিয়ে পরিশ্রম না করেই অস্ত্রোপচারে মেদ কমিয়ে ফেলবেন ঝটপট। বাড়ন্ত মধ্যপ্রদেশ বড়ই যন্ত্রণার। চওড়া কোমর-নিতম্বে সদ্য কেনা গাউনটা ঠিক ফিট করে না তাঁর। মেদ একবার জমাট বাঁধলে তাকে গলায় কার সাধ্য। নাছোড় ভুঁড়ি নিয়ে হুড়োহুড়ি করে সাতসকালে ঘাম ঝরানোর ইচ্ছা বা প্রচেষ্টা অনেকেরই নেই। একঘেয়েমি ডায়েট কিছু দিন পরেই বিরিয়ানি-তন্দুরিতে গিয়ে সমাপ্ত হয়ে যায়। এর বাইরে ‘শর্ট কাট’ পদ্ধতি বলতে যা মাথায় আসে, তা হল লাইপোসাকশন। রুপোলি পর্দার তারকাদের সুবাদে লাইপোসাকশন কথাটির সঙ্গে কমবেশি সকলেই পরিচিত। শারীরচর্চা, ডায়েট করেও যখন ঊরু, নিতম্ব, ঘাড় ইত্যাদি বিশেষ বিশেষ জায়গার ফ্যাট কমানো যায় না, তখন অন্তিম পথ লাইপোসাকশন।
পুজোর আগে লাইপোসাকশন করে মেদ কমানোর ভাবনা যদি মাথায় আসে, তা হলে এই পদ্ধতিটি আসলে কী, কতটাই বা তার উপকারিতা, কী ভাবে কাজ করে, কারা করতে পারেন— এই প্রশ্নগুলির উত্তর জেনে নেওয়া ভাল। সেই সঙ্গেই জানতে হবে, এই পদ্ধতি কতটা নিরাপদ ও সুরক্ষিত। শহরের বিশিষ্ট কয়েক জন প্লাস্টিক অ্যান্ড কসমেটিক সার্জেন এবং চিকিৎসক লাইপোসাকশনের বিষয়টি সহজ করে বুঝিয়ে দিলেন।
চর্বি ছাঁটলে তা আর ফিরে আসে না
লাইপোসাকশন এক রকম অস্ত্রোপচার, যেখানে পেট, কোমর, ঊরুর জায়গাগুলি থেকে চর্বি ছেঁটে ফেলা হয়। যন্ত্রের সাহায্যে মেদ গলিয়ে তাকে শরীরের বাইরে বার করে দেওয়ার নামই হল লাইপোসাকশন। ‘ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ এস্থেটিক প্লাস্টিক সার্জনস’-এর সভাপতি তথা শহরের অন্যতম বিশিষ্ট প্লাস্টিক সার্জন মনোজ খন্না আনন্দবাজার অনলাইনকে বুঝিয়ে বললেন, কী ভাবে কাজ করে লাইপোসাকশন। চিকিৎসকের কথায়, “পেট থেকে মেদ বার করতে হলে কয়েকটি জায়গায় ল্যাপেরোস্কোপির সাহায্যে ছোট ছোট ছিদ্র করা হয়। সেখান থেকে চর্বি গলিয়ে বার করে একটি গামলায় জমা করা হয়। চর্বি ছাঁটার পর তা আর ফিরে আসে না। তাই লাইপোসাকশন সম্পূর্ণ নিরাপদ ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন পদ্ধতি।”
চর্বি কেন ফেরে না, তারও কারণ আছে। মনোজবাবুর ব্যাখ্যা, অনেকেরই ভুল ধারণা আছে। আসলে লাইপোসাকশন করে যা বার করা হয় তা হল ‘ফ্যাট সেল’ অর্থাৎ, মেদ কোষ। ১৮ বছরের পর থেকে শরীরে মেদ কোষের পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়ে যায়। ধরা থাক, কারও উচ্চতা ৫ ফুট ৪ ইঞ্চি। তার শরীরে ৫ লক্ষের মতো মেদ কোষ আছে। পেটে আছে ১ লক্ষ। লাইপোসাকশন করে যদি পেট থেকে ৭০ হাজারের মতো কোষ ছেঁটে ফেলা হয়, তা হলে কিন্তু আজীবন শরীরে ওই ৪ লক্ষ ৩০ হাজার মেদ কোষই থাকবে। আর একটিও বাড়বে না। পরিবর্তন যা হবে, তা হল কোষগুলি প্রস্থে বা চওড়ায় বাড়তে পারে, সংখ্যায় নয়। ফলে ওজন কমবে, সেই জায়গার মাপও কম হবে। এর পরে গায়ে চর্বি লাগলে, তা সমানুপাতিক ভাবে শরীরের বিভিন্ন অংশে ভাগ হয়ে যাবে। কেবল একটি জায়গায় জমা হবে না। অর্থাৎ, পেট বেরিয়ে আসা, ঊরু স্থূল হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যা হবে না। তাই দেখতে খুব বেশি মোটা লাগবে না।
চামড়া আর পেশির ভিতর নল ঢুকলে বিপদ নেই
শরীরের যে অংশে লাইপোসাকশন হবে সেখানে ছিদ্র করে সেই পথে ক্যানুলা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। নলের মাধ্যমে সেই ক্যানুলা সাকশন অ্যাপারেটাসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এই ক্যানুলার সাহায্যেই মেদ কোষ বার করে আনা হয়। একে বলা হয় ‘সাকশন অ্যাসিস্টেট লাইপোসাকশন (এসএএল)’। মনোজবাবুর কথায়, ‘‘চামড়া আর পেশির মাঝামাঝি ঢোকে সেই নল। এতে ত্বকের নীচের শিরা, উপশিরা এবং স্নায়ুর কোনও ক্ষতি হয় না। সন্তানধারণে সমস্যা হয় না, যৌন জীবনেও কোনও জটিলতা আসে না।’’
লাইপোসাকশনের অনেকগুলি পদ্ধতি আছে। শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জন জয়ন্তকুমার সাহা বললেন, “বিএমআই, অর্থাৎ ওজন ও উচ্চতার অনুপাত মেপে লাইপোসাকশন করা হয়। ওজন কত, কতটা মেদ জমেছে, সব কিছু উপর নির্ভর করেই লাইপোপ্লাস্টি অথবা লাইপেকটমি সার্জারি করা হয়। এ সবই কসমেটিক সার্জারি যা বেঢপ চেহারাকে নির্দিষ্ট মাপে আনতে পারে।” শরীরের নির্দিষ্ট অংশ অসাড় করে, অর্থাৎ লোকাল অ্যানাস্থেশিয়া দিয়ে অস্ত্রোপচার করা হয়। বেশি জায়গার মেদ বার করতে হলে তখন পুরোপুরি অজ্ঞান করা হয়।
শরীরের বিশেষ অংশের মেদ কমাতেও লাইপোসাকশনের সাহায্য নেওয়া হয়। যেমন, অনেক সময়ে কমবয়সি পুরুষদের স্তনের আয়তন বেড়ে যায়। এই ধরনের সমস্যা সমাধানে আগে স্তন কেটে বাদ দিয়ে দেওয়া হত। এখন স্তনের ভিতরের মেদ লাইপোসাকশন করে বার করে দেওয়া হয়।
‘সাকশন অ্যাসিস্টেট লাইপোসাকশন (এসএএল)’ বেশি করান লোকজন। জয়ন্তবাবু বলছেন, ‘স্কাল্পটিং ক্রায়ো লাইপোসাকশন’ বলে আরও একটি পদ্ধতি রয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় শরীরের ভিতরেই মেদ বিশেষ পদ্ধতিতে জমিয়ে ফেলা হয়। পরে তিন থেকে চার সপ্তাহের মধ্যে শারীরবৃত্তীয় বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সেই মেদ বার করে দেওয়া হয় শরীর থেকে। আধুনিক পদ্ধতির মধ্যে আরও একটি হল ‘রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাসিস্টেড লাইপোসাকশন’। আল্ট্রাসাউন্ড-অ্যাসিস্টেড ও লেজ়ার অ্যাসিস্টেড লাইপোসাকশনও আছে। সব ক’টিই খুব কার্যকরী পদ্ধতি বলেই মত প্লাস্টিক সার্জনের।
সহজ পথের পদে পদে বাধা
লাইপোসাকশন কি যে কেউ করাতে পারেন? চিকিৎসকদের মত ভিন্ন। মনোজবাবুর ব্যাখ্যা, বয়স কম থাকলে এই প্রক্রিয়া ভাল হয়। কারণ, ত্বকের স্থিতিস্থাপকতা অটুট থাকে। চামড়া বেশি ঝুলে যাওয়ার সমস্যা থাকে না। যদি কেউ থাইরয়েড, রক্ত পাতলা হওয়ার ওষুধ খান, তা হলে সে ক্ষেত্রে লাইপোসাকশন সম্ভব না-ও হতে পারে। যিনি করাবেন তাঁর অনেকগুলি টেস্ট আগে করিয়ে নেওয়া হয়।
ওজন যদি ৮৫ থেকে ১০০ কেজি বা তার বেশি হয়ে যায়, তখন লাইপোসাকশন কার্যকরী হয় না বলেই মত প্লাস্টিক সার্জেন জয়ন্তবাবুর। তিনি জানালেন, বিএমআই ২০ থেকে ৩০-এর মধ্যে থাকলে তবেই লাইপোসাকশন করা যায়। কিন্তু তা যদি ৩০-এর বেশি হয়ে যায়, তখন লাইপোসাকশন নয়, বেরিয়াট্রিক সার্জারি করানোর দরকার পড়ে। দুই চিকিৎসকেরই মত, এক এক বারে বেশি মেদ বার করা হয় না। প্রতি সিটিংয়ে ওজনের ১০ শতাংশ বার করা হয়। সাধারণত ৫০০ মিলিলিটার থেকে ১ লিটার অবধি চর্বি বার করা হয়। বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে এর বেশি ৫-৭ লিটার অবধিও চর্বি ছাঁটা হয়, তখন পুরোপুরি অজ্ঞান করে অস্ত্রোপচার করতে হয়। হাসপাতালে ভর্তিও থাকতে হয়। দুই চিকিৎসকেরই মতে, অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রে সতর্কতা নেওয়া প্রয়োজন। এমন অনেক সময়েই হয়েছে, চর্বি গলাতে গিয়ে তা উল্টো পথে হার্ট বা ফুসফুসে চলে গিয়েছে। তবে দক্ষ হাত হলে এই আশঙ্কা কম।
লাইপোসাকশন ভাল না খারাপ?
লাইপোসাকশন বড় মাপের অস্ত্রোপচার নয়। তবে এরও ভাল আর খারাপ দিক দুই-ই আছে। প্লাস্টিক সার্জেনরা অবশ্য বলছেন, লাইপোসাকশনে কেবল মেদ কমে তা নয়, ডায়াবিটিসের মতো অসুখও নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারে। মেদকোষ প্রচুর পরিমাণে ইনসুলিন খেয়ে ফেলে, তাই মেদকোষ ছেঁটে দিলে রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হতে পারে। অস্ত্রোপচারের পরে ব্যথাবেদনাও খুব বেশি হয় না। ৩-৪ দিন পরেই স্বাভাবিক কাজকর্মে ফেরা যায়। খাওয়াদাওয়া, চলাফেরা বা অন্য কাজে কোনও সমস্যা থাকে না।
সুরক্ষার প্রশ্নে অবশ্য দ্বিমত আছে। এই বিষয়ে স্ত্রীরোগ চিকিৎসক ও রিজেনারেটিভ মেডিসিন নিয়ে কর্মরত মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়ের মত, “লাইপোসাকশনের সঙ্গে অ্যাবডমিনোপ্লাস্টিও করতে হয়। অস্ত্রোপচার সফল না হলে হার্টের ক্ষতি হতে পারে। ধমনীর মধ্যে চর্বি ঢুকে গিয়ে বিপদ হয়েছে, এমন উদাহরণও আছে। চামড়া টান টান না হলে দেখতেও খারাপ লাগবে। আর যদি অস্ত্রোপচারের পরে খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ এবং শরীরচর্চা না করা হয়, তা হলে আবার চেহারায় মেদ জমতে থাকবে।” একই মত রোবোটিক সার্জেন চিকিৎসক কুমার গৌরবেরও। তিনি বলছেন, “অ্যানাস্থেশিয়ার পদ্ধতি ঠিক না হলে সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যাবে। তখন শরীরের অন্যান্য অঙ্গের ক্ষতি হবে। যদি একবারে শরীরের অনেকগুলি অংশ থেকে মেদ বার করে ফেলা হয়, তা হলে বিপদের আশঙ্কা থাকবে। এই পদ্ধতি খরচসাপেক্ষও বটে। শারীরিক অসুস্থতা থাকলে বা বিশেষ কোনও ওষুধ খেলে লাইপোসাকশন করানোর আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।”
লাইপোসাকশন আর বেরিয়াট্রিক এক নয় কিন্তু!
লাইপোসাকশন করলে যে বিশাল মেদ কমে যাবে, তা একেবারেই নয়। চিকিৎসক মল্লিনাথের মতে, শরীরচর্চা ও ডায়েট নিয়মিত করলে তবে লাইপোসাকশনের উপকার পাওয়া যাবে। কিন্তু সেই পথে যাঁরা হাঁটেন না, তাঁরা ততটা সুফল পাবেন না। মনে রাখতে হবে, লাইপোসাকশন আর বেরিয়াট্রিক এক নয়। আদনান স্বামী যে পক্রিয়ায় প্রায় ২৩০ কেজি থেকে ১৩০ কেজি ওজন কমিয়েছিলেন, তা কিন্তু লাইপোসাকশন নয়, বেরিয়াট্রিক। তখন অস্ত্রোপচার করে পাকস্থলী বেঁধে দেওয়া হয়। অনেকটা ক্লিপ দিয়ে আটকানোর মতো। স্টমাক স্টেপলিং, স্টমাক বাইপাসের মতো অনেক পদ্ধতি আছে। ক্ষুদ্রান্তের শেষ অংশ আটকে দিয়ে বা বাইপাস করিয়ে পাকস্থলীর আকার ২০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা হয়। সহজ করে বললে, শরীরে অপুষ্টি ঘটিয়ে ওজন কমানো হয়। আমাদের পাকস্থলীতে খাবার জমা হয় ও পাচন শুরু হয়। অর্ধেকটা পাচিত খাবার ক্ষুদ্রান্তে গিয়ে পৌঁছয়। সেখানে খাবারের পরিপাক ও শোষণ দুই-ই হয়। বেরিয়াট্রিক সার্জারির কাজ হল এই গোটা প্রক্রিয়াকে কমিয়ে দেওয়া। মানে হল খাবার বিপাক হবে ঠিকই, কিন্তু ওই প্রোটিন, ভিটামিন, ফ্যাটের উপাদানগুলির শোষণ কম হবে। এই ভাবে পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হবে শরীরে, ওজন কমবে ধীরে ধীরে। এই পদ্ধতিতে কিন্তু খাওয়াদাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, অপুষ্টিজনিত অসুখেরও আশঙ্কা থাকে। তাই যে কোনও মেদ কমানোর অস্ত্রোপচারেই ঝুঁকি থাকে। সঠিক ভাবে নিয়ম না মানলে বিপদ বাড়বে বই কমবে না।