গর্ভধারণের আগে রক্তের কোন পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দিলেন চিকিৎসক। ছবি: সংগৃহীত।
বছরের পর বছর চেষ্টা করেও গর্ভধারণ করতে পারেন না অনেকেই। সাধারণ জৈবিক প্রক্রিয়ায় মা হতে না পারলে, ‘ইন-ভিট্রো ফার্টিলাইজ়েশন’ বা আইভিএফ পদ্ধতিতে সন্তান ধারণের চেষ্টাও করেন। কিন্তু তাতেও হয়তো সাফল্য আসে না। এ দিকে বছরের পর বছর চেষ্টা করতে করতে হতাশাও এসে যায়, আবার টাকাপয়সাও খরচ হয় জলের মতোই। অথচ রক্তের এমন একটি পরীক্ষা আছে, যা সহজেই বলে দিতে পারে জরায়ুর অবস্থা কেমন, কী পরিমাণ ডিম্বাণু তৈরি হতে পারে। অর্থাৎ জরায়ু উর্বর কি না এবং সেই মহিলা সন্তানধারণ করতে পারবেন কি না, তা আগে থেকেই বলে দেওয়া সম্ভব। পরীক্ষাটির নাম ‘অ্যান্টি-মুলেরিয়ান টেস্ট’ বা ‘এএমএইচ টেস্ট’।
এই বিষয়ে স্ত্রীরোগ চিকিৎসক মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায় বললেন, “মা হওয়ার আগে যে পরীক্ষা গুলি করে নিতে হয়, তার মধ্যেই একটি এই ‘এএমএইচ টেস্ট’। এখন বেশি বয়সে সন্তান চাইছেন অনেকেই। তাই জরায়ু সন্তানধারণের জন্য কতটা প্রস্তুত, কী পরিমাণ ডিম্বাণু তৈরি হচ্ছে, গর্ভে সন্তান এলে তা ধারণ করার মতো শক্তি জরায়ুর আছে কি না, সে সবই জানা যাবে রক্তের এই পরীক্ষায়। খুবই কার্যকরী ব্লাড টেস্ট। অজ্ঞানতা বা সচেতনতার অভাবে মহিলারা এই পরীক্ষা না করিয়েই আইভিএফ বা এই রকম খরচসাপেক্ষ চিকিৎসা পদ্ধতির দিকে ঝোঁকেন।”
জরায়ু যদি গর্ভধারণের উপযুক্তই না হয়, তা হলে আইভিএফ করিয়েও লাভ হবে না, এমনটাই মত চিকিৎসক মল্লিনাথের। তিনি জানাচ্ছেন, জৈবিক পদ্ধতিতে মা হতে না পারলেই এখন মহিলারা আইভিএফের দিকে ছুটছেন। বছরের পর বছর চেষ্টাও করছেন। তার পর সাফল্য না এলে ভয়ানক মানসিক যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। তাই আগে থেকেই যদি জেনে নেওয়া যায়, জরায়ুর অবস্থা কেমন, কোনও অসুখ বা সমস্যা হচ্ছে কি না, তা হলে তার সমাধানের উপায় বার করে, তবে চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যাওয়া উচিত।
‘এএমএইচ টেস্ট’ করে কী কী আগাম বলে দেওয়া সম্ভব?
১) জরায়ুতে কী পরিমাণ ডিম্বাণু তৈরি হতে পারে, তা জেনে নেওয়া দরকার। এই টেস্ট করলেই বোঝা যাবে, জরায়ু উর্বর কি না।
২) জরায়ুর ‘কোয়ালিটি’ ও ‘কোয়ান্টিটি’ যাচাই করা সম্ভব। সেটি কী? মল্লিনাথের কথায়, ‘কোয়ান্টিটি’ মানে হল জরায়ু কত সংখ্যক ডিম্বাণু উৎপাদন করছে যার উপর নির্ভর করবে বেশি বয়সেও মা হওয়া সম্ভব কি না। আবার ডিম্বাণুর গুণগত মানও যাচাই করবে। আর ‘কোয়ালিটি’ মানে হল, সন্তান এনে জরায়ু তা ধারণ করতে পারবে না। অর্থাৎ জরায়ুর গুণগত মান কেমন। এর থেকেই বোঝা যাবে গর্ভপাতের ঝুঁকি আছে কি না। আইভিএফ পদ্ধতিতে গর্ভে ভ্রূণ প্রতিস্থাপনের পরেও গর্ভপাত হয় অনেকেরই। তাই রক্তের এই পরীক্ষা করিয়ে রাখলে আগে থেকেই সাবধান হওয়া যাবে।
৩) জরায়ুতে সিস্ট হচ্ছে কি না তা-ও ধরা যাবে এই পরীক্ষায়। এখন অনেক মহিলাই ‘ফাইব্রয়েড’, ‘এন্ডোমেট্রিয়োসিস’ বা ‘পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোম’ (পিসিওএস)-এ ভুগছেন। কোন রোগ বাসা বেঁধে আছে তা আগে থেকে ধরা না পড়ায়, চিকিৎসাও শুরু হচ্ছে দেরিতে। ফলে বন্ধ্যাত্বের শিকার হচ্ছেন অনেকেই। কিন্তু ‘এএমএইচ টেস্ট’ করালে সহজেই ধরা যাবে জরায়ুতে কোনও সমস্যা হচ্ছে কি না। অসুখ আগে থেকে ধরা পড়লে, তা চিকিৎসায় সারানোর সুযোগ আছে।
৪) ঋতুবন্ধের সময় এগিয়ে এসেছে কি না, তা-ও ধরা পড়বে এই পরীক্ষায়। মল্লিনাথ বলছেন, “এখন সময়ের আগেই ঋতুবন্ধ হচ্ছে অনেকের। ৩৫ বছরেও ঋতুবন্ধ হচ্ছে, এমনও দেখা গিয়েছে। যদি কম বয়সে ঋতুবন্ধের সময় এগিয়ে আসে, তা হলে শত চেষ্টা করলেও মা হওয়া সম্ভব নয়। তাই আগে থেকে পরীক্ষা করিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিলে, পরে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় না।”
‘এএমএইচ টেস্ট’ এর রেজাল্ট দেখে বোঝা যাবে কী করে?
জরায়ু থেকে ‘এএমএইচ’ বা ‘অ্যান্টি-মুলেরিয়ান হরমোন’ নিঃসরণ হয়। এই হরমোনের ক্ষরণ কতটা কম বা বেশি হচ্ছে, তা পরীক্ষা করেই জরায়ুর উর্বরতা যাচাই করা সম্ভব। কী ভাবে?
চিকিৎসক জানাচ্ছেন, ‘অপটিম্যাল ফার্টিলিটি’ ৪ থেকে ৬.৮ এনজি /এমএল। অর্থাৎ এই মান এলে বুঝতে হবে জরায়ু উর্বর। গর্ভধারণে কোনও সমস্যা হবে না।
এর নীচে ২.২ থেকে ৪ এনজি /এমএল অবধি মানও সন্তানধারণের জন্য উপযুক্ত।
যদি ‘এএমএইচ’-এর মান খুব কম বা খুব বেশি হয়, তা হলে বুঝতে হবে জটিলতা তৈরি হয়েছে।
‘এএমএইচ’-এর মান যদি ১-এর কম হয়, তা হলে বোঝা যাবে ঋতুবন্ধের সময় এগিয়ে এসেছে। গর্ভধারণ করলে জটিলতা তৈরি হতে পারে।
‘এএমএইচ’-এর মান শূন্যে নেমে এলে বুঝতে হবে কোনওভাবেই গর্ভধারণ করা সম্ভব নয়।
আবার মান যদি ৮ বা তার বেশি হয়ে যায়, তা হলে তা পিসিএওসের লক্ষণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা করে অসুখ সারিয়ে তার পর সন্তানধারণের পরামর্শ দেবেন চিকিৎসকেরা।
এই পরীক্ষার খরচও বেশি নয় বলেই জানালেন চিকিৎসক। কলকাতার বিভিন্ন জায়গাতে হয়। খরচ হাজারের মধ্যেই। বেসরকারি হাসপাতালে করাতে গেলে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকা খরচ পড়বে।