Brain Function at Midnight

মধ্যরাতের পর উঁকি দেয় খারাপ সব চিন্তা, অন্ধকারে কেন বদলে যায় মন?

চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, এমনকি প্রতারণামূলক নানা ঘটনার সময়ও সেই মধ্যরাত। ‘রিসার্চগেট’-এ এ নিয়ে একটি গবেষণাপত্রও ছাপা হয়েছিল। সেখানে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছিলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ড বা মাদকের নেশায় আত্মহত্যার মতো ঘটনার বেশিটাই ঘটে রাতে।

Advertisement
আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০২৪ ১২:১৪
Study says Human mind functions differently if awake at Midnight

অন্ধকারের সঙ্গে মনের কী যোগসূত্র? প্রতীকী ছবি।

আঁধার নামলেই বদলে যায় মন? অন্ধকারেই ঘিরে ধরে নেতিবাচক সব চিন্তাভাবনা? নিকষ কালো অন্ধকারের দিকে চাইলেই তিক্ততায় ভরে ওঠে মন, নিজেকে শেষ করে দিতেও ইচ্ছে করে?

Advertisement

অন্ধকারের সঙ্গে মনের কী যোগসূত্র, তা নিয়ে গবেষণা দীর্ঘ সময়ের। বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন, অপরাধমূলক ঘটনার বেশির ভাগটাই নাকি ঘটে রাতে। ২০২২ সালে আমেরিকায় এই নিয়ে একটি সমীক্ষা হয়। মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই তাদের রিপোর্টে জানিয়েছিল, প্রায় ৪৫ শতাংশ অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে রাতেই। চুরি-ডাকাতি, ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, এমনকি প্রতারণামূলক নানা ঘটনার সময়ও সেই মধ্যরাত।

‘রিসার্চগেট’-এ এই নিয়ে একটি গবেষণাপত্রও ছাপা হয়েছিল। সেখানে বিজ্ঞানীরা দাবি করেছিলেন, নৃশংস হত্যাকাণ্ড বা মাদকের নেশায় আত্মহত্যার মতো ঘটনার বেশিটাই ঘটে রাতে। কারণ, আঁধার নামলেই নাকি মানুষের মনে অদ্ভুত এক পরিবর্তন হয়। এর সঙ্গে বিবর্তনেরও নাকি যোগসূত্র আছে। সেটির ব্যাখ্যা দিয়েছেন নিউরোলজিস্ট এলিজ়াবেথ ক্লারম্যান। ২০২২ সালে তাঁর লেখা ‘মাইন্ড আফটার মিডনাইট’ নামে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। দীর্ঘ বছরের গবেষণায় স্নায়ু চিকিৎসক দেখিয়েছেন, রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কী ভাবে মানুষের মনের গোপন প্রতিহিংসাগুলি জাগ্রত হয়ে ওঠে। সেই আদিম জিঘাংসা যা কালের প্রবাহেও লুপ্ত হয়নি, তার জন্ম হয় সে রাতেই।

কলকাতার পাভলভ হাসপাতালের মনোরোগ চিকিৎসক জয়িতা সাহার অভিজ্ঞতাও চমকে দেওয়ার মতো। জয়িতা বলছেন, “একটি কমবয়সি মেয়ে বলেছিল, রাত হলেই গলায় দড়ি দেওয়ার ইচ্ছেটা প্রবল হয় তার। দিনের বেলা যত বারই মায়ের শাড়িটা ফাঁস দিয়ে সিলিং ফ্যানে ঝোলাতে গিয়েছে, তত বারই কেউ না কেউ এসে প্রচেষ্টাটাই ব্যর্থ করেছে। তাই রাতে যখন সকলে ঘুমোয়, সে মায়ের শাড়ি বা ওড়নাটা নিয়ে গলায় প্যাঁচ দেওয়ার চেষ্টা করে। রাতের নিস্তব্ধতাই তাকে সাহস জোগায়।” দিনের শব্দ বা কোলাহলে নিজেকে শেষ করে দিতে গিয়েও পারেননি, এমন অনেক রোগীই নাকি সাহায্য চাইতে আসেন। তাঁরা বলেন, রাত হলেই একাকিত্বের অনুভূতি গ্রাস করে। চারপাশটা এত চুপচাপ থাকে, যে মনে হয় তখনই কিছু করে ফেলা ভাল। সে অন্যের ক্ষতি হোক বা নিজের। এই ইচ্ছা যে সকলের হয়, তা নয়। প্রচণ্ড দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, অপ্রাপ্তি ও বিভিন্ন সময়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন যাঁরা, তাঁদের এই সমস্যা বেশি। চাপা রাগ থেকে কাছের মানুষের ক্ষতি করে ফেলেছেন, এমন ঘটনাও কম নয়। সেখানেও রাত বাড়লে উৎকণ্ঠা কাজ করেছে সে সব মানুষের মনে। অনিদ্রার সমস্যা বা ইনসমনিয়া আছে যাঁদের, তাঁরা সারা রাত জেগে থাকার যন্ত্রণাটা বিলক্ষণ টের পান।

মধ্যরাতে গ্রাস করে অজানা ভয়, ঘিরে ধরে নেতিবাচক সব চিন্তাভাবনা।

মধ্যরাতে গ্রাস করে অজানা ভয়, ঘিরে ধরে নেতিবাচক সব চিন্তাভাবনা। ছবি: ফ্রিপিক।

আদিম মানুষ যবে থেকে সভ্য হয়েছে, সেই তবে থেকেই দিনের বেলা কাজ আর রাতে ঘুম— জীবনচক্রে এই সময়টাই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছে অলিখিত ভাবে। সে ভাবেই মানুষের শারীরবৃত্তীয় কাজকর্ম চলে এক নির্দিষ্ট ছন্দে, যার নাম ‘বায়োলজিক্যাল ক্লক’। অর্থাৎ, ‘জীবন ঘড়ি’, বিজ্ঞানীরা বলেন ‘সার্কাডিয়ান রিদ্‌ম’। এটি আদতে একটি শরীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া, যা প্রতি ২৪ ঘণ্টায় সম্পূর্ণ হয়। অনেকটা পৃথিবী যেমন নিজের কক্ষে ঘোরে, সে রকমই প্রাণীদের অস্তিত্বকে এক অদৃশ্য ছন্দে বেঁধে দেয় এই প্রক্রিয়া।

মনোবিদ অনিন্দিতা মুখোপাধ্যায়ের মত, এই ‘সার্কাডিয়ান রিদ্‌ম’ বদলে গেলেই সব কিছু ওলটপালট হয়ে যায়। সারা দিনের কাজকর্ম এবং সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগনি রশ্মির প্রভাবে দিনের বেলায় যে কোষগুলি ক্লান্ত হয়ে পড়ে, রাতে ঘুমের সময়ে সেগুলি মেরামত হয়ে আবার আগের অবস্থায় ফিরে আসে। মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস অংশ এই বায়োলজিক্যাল ক্লককে নিয়ন্ত্রণ করে। শরীরের প্রতিটি কোষ, স্নায়ুতন্ত্রও এই নিয়ম মেনেই চলে। কোনও কারণে জীবন ঘড়ির কাঁটা জোর করে উল্টো দিকে ঘোরানোর চেষ্টা হয়, তখনই মানসিক স্থিতি টলে যায়। দীর্ঘ দিন ধরে রাত জাগার অভ্যাস, অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা এবং সে সঙ্গে খাদ্যাভ্যাস— এই ঘড়ির কাঁটাকে বিপরীতে যেতে বাধ্য করে। তখন মনে আর ইতিবাচক নয়, নেতিবাচক চিন্তার জন্ম হয়।

অনিন্দিতার ব্যাখ্যা, গুহাবাসী মানুষ রাতে হিংস্র পশুর আক্রমণ থেকে বাঁচতে জেগে থাকত। রাতে শিকার ধরার প্রক্রিয়াও চলত। বিবর্তনের ধারায় এই নিয়মে বদল আসে। মানুষ তার নিশ্চিন্ত ও নিরাপদ আশ্রয় তৈরি করে যেখানে সে সুরক্ষিত থাকতে পারে। কিন্তু তার পরেও রাতের সেই ভয়টা তার মন থেকে দূর হয়নি। কালের প্রবাহে তা-ই থেকে গিয়েছে সুপ্ত ভাবে। তারই জাগরণ ঘটে কোনও কোনও সময়ে, কিছু মানুষের ক্ষেত্রে।

সূর্যাস্তের পর অন্ধকার নামার সঙ্গে সঙ্গে স্নায়ু বিশ্রাম চায়। সে সময়েও যদি তাকে ব্যতিব্যস্ত রাখা হয়, তা হলেই গোলমালটা বাঁধে। এমনটাই জানাচ্ছেন স্নায়ু চিকিৎসক অনিমেষ কর। তাঁর কথায়, “দিনভর কাজের চাপের পরে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসেন অনেকে। রাতে যে হেতু অন্য কাজ বিশেষ থাকে না, তাই নানা রকম চিন্তাভাবনা মাথায় গিজগিজ করতে থাকে। চরমতম হতাশা থেকে মাদকাসক্তও হয়ে পড়েন অনেকে। মন এতটাই তিতিবিরক্ত ও তিক্ত থাকে যে, খারাপ কাজ করার ভাবনাও আসে ঠিক ওই সময়টাতেই।”

“সবাই ঘুমোচ্ছে, পাশে কেউ নেই। কাকে মনের কথা বলব?”, রাত হলেই ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হত এক রোগীর। মনোরোগ চিকিৎসক শর্মিলা সরকার বলছেন, সেই রোগী প্রায়ই বলতেন, পাশে তাঁর আপনজনেরা ঘুমোচ্ছেন, কিন্তু তিনি পারছেন না। এই ভাবনা থেকেই নিজের ক্ষতি করার ইচ্ছাটা হত তাঁর। দীর্ঘ সময় লেগেছিল তাঁকে সুস্থ করতে। লড়াইটা যখন নিজের সঙ্গে নিজেরই, তখন যত ক্ষণ না জট পাকানো চিন্তার জাল খুলছে, তত ক্ষণ নিস্তার নেই।

শর্মিলার কথায়, এক জন শারীরিক ও মানসিক ভাবে সুস্থ-সবল মানুষ হঠাৎ গভীর রাতে খেপে উঠবেন, তা হতে পারে না। যদি না তিনি কোনও রকম মানসিক আঘাত পান বা নির্যাতনের শিকার হন। বিশেষ কিছু রোগে এমনটা হওয়ার আশঙ্কা থাকে, যেমন বাইপোলার ডিজ়অর্ডার, পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজ়অর্ডার, অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ়অর্ডার, প্যানিক ডিজ়অর্ডার, অ্যাংজ়াইটি ডিজ়অর্ডার ইত্যাদি। বাইপোলারে ভোগা রোগীরা রাতের দিকেই যত অস্বাভাবিক কাজকর্ম করার চেষ্টা করেন। খিটখিটে স্বভাব, বিষণ্ণতা, হঠাৎ ভীষণ রেগে যাওয়ার মতো অসুবিধের পাশাপাশি রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, হার্টের সমস্যার মতো গুরুতর শারীরিক সমস্যাও হয় তাঁদের। টানা চিকিৎসা ও কাউন্সেলিংয়ে থাকলে তবেই এর থেকে মুক্তি মেলে।

Advertisement
আরও পড়ুন