কনজাঙ্কটিভাইটিস থেকে বাঁচতে কী কী করণীয়? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
লাল চোখ দেখলেই বুক দুরুদুরু করে। এই বুঝি তাকালেই হয়ে যায়! বর্ষাকালে রাস্তাঘাটে, বাসে-ট্রামে রাঙা চোখ সমেত লোকজনকে দেখলে গা বাঁচিয়ে পালাতেই মন চায়। স্কুলে-কলেজে তো লাল চোখের ভয় বেশিই ছিল। এক সময়ে অনেকেরই ধারণা ছিল, চোখ লাল হয়ে ফুলে ওঠা, থুড়ি ‘জয়বাংলা’ বুঝি দৃষ্টিনিক্ষেপের মাধ্যমেই ছড়ায়। আদতে তা নয়। তবে এই রোগ ছোঁয়াচে। ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ক্ষতিকর ছত্রাকদের চোখরাঙানিতেই চোখের মণির চারপাশে লাল রং ধরে। সেই সঙ্গে অনবরত জল পড়া, জ্বালা-যন্ত্রণা, পিচুটি, চুলকানি— সব মিলিয়ে বড় কষ্টকর ব্যাপার! চিকিৎসাবিজ্ঞানে এই রোগেরই নাম কনজাঙ্কটিভাইটিস, যা প্রতি বর্ষার মরসুমে দাপট দেখাতে শুরু করে। এ বারেও তার ব্যতিক্রম নেই।
যত বেশি ভিড়, গা ঘেঁষাঘেঁষি, ততই কনজাঙ্কটিভাইটিসের জীবাণুদের বাড়বাড়ন্ত। আর পুজোর সময় তো ভিড় হবেই। শিশু, বয়স্কদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোবেন অনেকেই। সেই সময়ে যদি কনজাঙ্কটিভাইটিস ছড়াতে শুরু করে, তা হলে কী হবে? চিন্তা থেকেই যায়। লাল চোখ থেকে বাঁচতে তাই কী করণীয়, তার পরামর্শ দিয়েছেন শহরের কয়েক জন বিশিষ্ট চক্ষু চিকিৎসক।
চাহনিতে জীবাণু ছড়ায় না
গ্লকোমা কনসালট্যান্ট নিলয়কুমার মজুমদার আনন্দবাজার অনলাইনকে বললেন, “কনজাঙ্কটিভাইটিসের মূল কারণ হল ভাইরাস। ব্যাক্টেরিয়া ঘটিত সংক্রমণও হয়, তবে সংখ্যায় কম। চোখের কনজাঙ্কটিভা আক্রান্ত হলেই এই অসুখ হয়। বর্ষার সময়ে বাতাসের জলীয় কণাকে ভর করে ভেসে বেড়ায় অনেক ভাইরাস, যার মধ্যে শক্তিশালী অ্যাডিনো ভাইরাস চোখে সংক্রমণ ঘটায়। কর্নিয়ায় ছোট ছোট দানা তৈরি হয়। যার ফলে দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যায়, চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়তে থাকে, আঠালো তরল বার হয়, পিচুটি জমে যায় চোখে।” কনজাঙ্কটিভাইটিস কিন্তু ছোঁয়াচে অসুখ, সতর্ক করলেন চিকিৎসক। সেই সঙ্গে এ-ও জানালেন, আক্রান্তের চোখের দিকে চাইলে মোটেও রোগ ছড়ায় না। তবে আক্রান্তের ব্যবহার করা জিনিসপত্র ছুঁলে বা ব্যবহার করলে, তার থেকে জীবাণু সুস্থ মানুষের শরীরে ঢুকতে পারে। ধরুন, বাড়িতে কারও কনজাঙ্কটিভাইটিস হল। তাঁর মুখ মোছার রুমাল বা তোয়ালে, অথবা প্রসাধনীর জিনিস ব্যবহার করলেন, তা হলে আপনার চোখেও সংক্রমণ হবে।
কেন নাম ‘জয়বাংলা’?
চক্ষুরোগ চিকিৎসক সৌমেন মণ্ডল বলেন, “এই ‘জয়বাংলা’ কথাটা এসেছে বাংলাদেশ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশে কনজাঙ্কটিভাইটিসের সংক্রমণ ঘটেছিল। সেখান থেকে শরণার্থীদের মারফত রোগের জীবাণু ঢুকে পড়ে পশ্চিমবঙ্গেও। ১৯৭১ সালে বাংলায় মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছিল এই রোগ। সেই থেকে এমন নামকরণ।” সে সময়ে বাংলার লোকজন বলতেন ‘চোখ ওঠা’। এই রোগ নিয়ে যথেষ্ট ভয় ছিল। এখন অনেক রকম ওষুধ বেরিয়ে গিয়েছে বলে কনজাঙ্কটিভাইটিস নিয়ে আতঙ্ক ততটা নেই। তবে একেবারে নিশ্চিন্ত থাকলেও চলবে না। রোগটি যে হেতু জীবাণুঘটিত, আর করোনা পরবর্তী সময়ে যে হেতু অনেক সাধারণ রোগের জীবাণুই যে ভাবে চরিত্র বদলে জাঁদরেল হয়ে উঠেছে, তাতে চিন্তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এখন চোখ লাল হলেও কনজাঙ্কটিভাইটিস ভেবে অনেকেই আই ড্রপ কিনে চোখে দিয়ে দেন। যার ফল হতে পারে মারাত্মক। এমন অনেক ভাইরাস ঘটিত অসুখ আছে, যার প্রাথমিক উপসর্গ হতে পারে কনজাঙ্কটিভাইটিস। কাজেই কী থেকে রোগ হয়েছে এবং তা কতটা গভীরে ছড়িয়েছে, জেনে নেওয়া জরুরি। তাই অন্তত চিকিৎসককে দেখিয়ে নেওয়ার পরামর্শই দিচ্ছেন সৌমেন।
আন্দাজে ‘আই ড্রপ’ দিলেই ক্ষতি
কনজাঙ্কটিভাইটিস হওয়ার কারণ অনেক। অ্যাডিনো ভাইরাস, হারপিস সিমপ্লেক্স ভাইরাস (এইচএসভি) কিংবা ভেরিসেলা-জোস্টার ভাইরাস (ভিজেডভি)-এর সংক্রমণে কনজাঙ্কটিভাইটিস হতে পারে। আবার হেমোফিলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা, স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনিয়া বা স্ট্যাফিলোকক্কাস অরিয়াসের মতো জীবাণু সংক্রমণেও কনজাঙ্কটিভাইটিস হতে পারে। আবার এই অসুখের পিছনে অ্যালার্জি জনিত কারণও আছে। তাই চোখে আদৌ কী ধরনের কনজাঙ্কটিভাইটিস হয়েছে, ব্যাক্টেরিয়াঘটিত না কি ভাইরাসঘটিত, সে সব না বুঝে আন্দাজে ড্রপ দিলে তা সরাসরি কর্নিয়ার ক্ষতি করতে পারে। ঝাপসা হয়ে যেতে পারে দৃষ্টি। কেরাটো কনজাঙ্কটিভাইটিসের ঝুঁকিও বাড়ে, যা কর্নিয়ার মারাত্মক ক্ষতি করে দেয়। তখন অস্ত্রোপচার ছাড়া গতি থাকবে না।
লাল চোখ থেকে বাঁচতে
কনজাঙ্কটিভাইটিসের ভয়ে বাড়িতে বসে থাকা যায় না, কাজের প্রয়োজনে বাইরে বেরোতেই হবে। ভিড় যানবাহনেও উঠতে হবে। আর পুজোর সময় বাইরে যেতেও হবে। তবে আক্রান্ত ও সুস্থ মানুষের ক্ষেত্রে সতর্কতা ভিন্ন রকম হবে।
রোগ হলে সতর্কতা
এই বিষয়ে চক্ষু চিকিৎসক সাগরিকা চৌধুরী বললেন, “যদি মনে হয় চোখ কড়কড় করছে, বালি পড়েছে বা চোখ থেকে আঠালো তরল বার হচ্ছে, তা হলে দেরি না করে চক্ষু চিকিৎসককে দেখাতে হবে। কনজাঙ্কটিভাইটিস সারতে এক সপ্তাহের মতো সময় লাগে। এক বার সংক্রমণ ঘটলে বাড়িতে থাকাই জরুরি। বাইরে বেরোতে হলে রোদচশমা পরতে হবে। ধুলোবালি বাঁচিয়ে চলতে হবে। চোখে বার বার হাত দিলেই সংক্রমণ বেড়ে যাবে।”
রোগ যাঁদের হয়নি
১) সাগরিকা জানাচ্ছেন, ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ ঠেকাতে আক্রান্তের ব্যবহার করা জিনিস, যেমন রুমাল, তোয়ালে ইত্যাদি ব্যবহার করবেন না।
২) বার বার সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। বাইরে বেরোলে স্যানিটাইজ়ার সঙ্গে রাখতে হবে।
৩) বাড়িতে কারও কনজাঙ্কটিভাইটিস হলে কিংবা পথেঘাটে কোনও রোগীর মুখোমুখি হলে চেষ্টা করুন নিরাপদ দূরত্বে থাকার।
৪) নিজের তোয়ালে, বালিশ বা প্রসাধনী অন্য কারও সঙ্গে ভাগ করবেন না। বিশেষ করে অন্যের ব্যবহার করা কাজল, মাস্কারা, আইলাইনার ইত্যাদি প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করবেন না।
৫) বাইরে বেরোলেই চোখে চশমা পড়ুন। পাওয়ার না থাকলেও এই সময়ে চোখের সুরক্ষার জন্য একটি পাওয়ার ছাড়া চশমা কিনে ফেলতে পারেন। পুজোর সময়ে সাজেও বদল আসবে, চোখও বেঁচে যাবে।
৬) সংক্রমিত হলে টিভি, মোবাইল, ল্যাপটপ দেখা কমাতে হবে। সৌমেন পরামর্শ দিচ্ছেন, বাড়িতে শিশু বা বয়স্কের হলে তার কাছে যেতেই হবে। সে ক্ষেত্রে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় হাত ধুতে হবে বা স্যানিটাইজ়ার লাগাতে হবে। হাত না ধুয়ে নিজের চোখে বা মুখে হাত দেবেন না অথবা খাবার খাবেন না। রোগীকে ওষুধ দেওয়ার পরেও হাত ধুতে হবে।
বাতাসে আর্দ্রতা বাড়লে কনজাঙ্কটিভাইটিসের জীবাণু তাড়াতাড়ি ছড়াতে পারে। পুজোর সময়ে বৃষ্টি হতে পারে বলেই অনুমান আবহবিদদের। তাই নিয়ম মেনে চলতেই হবে।