মামলা ছেড়ে আইনজীবীর বিবৃতি সন্দেহ বাড়াচ্ছে
RG Kar Medical College And Hospital Incident

‘চাপ’-এর উৎস কোথায়

পাশাপাশি মামলা থেকে মূল অভিযোগকারীর আইনজীবীর অব্যাহতি নেওয়ার ঘটনাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এক সময় তো আদালতে ওই তরফের কোনও আইনজীবীই ছিলেন না।

Advertisement
দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৪:১৫

আর জি কর মামলার গতি কোন দিকে? সংশয়, সন্দেহ, ক্ষোভ আবার দানা বেঁধে উঠছে এই নিয়ে। প্রধান নিশানায় এ বার সিবিআইয়ের ভূমিকা, যার দরুন আদালতে জামিন হয়েছে অন্যতম দুই অভিযুক্তের। সিবিআইয়ের আইনজীবী জামিনের নির্দেশ বিনা বিরোধিতায় মেনে নিয়ে তাতে গুরুতর একটি মাত্রাও যোগ করেছেন।

Advertisement

পাশাপাশি মামলা থেকে মূল অভিযোগকারীর আইনজীবীর অব্যাহতি নেওয়ার ঘটনাও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এক সময় তো আদালতে ওই তরফের কোনও আইনজীবীই ছিলেন না। সমগ্র বিষয়টি কেমন যেন রহস্যময়। সেটিং-ফিটিং’এর চর্বিতচর্বণ করে কিছু চমক দিলেই হয়তো সকল রহস্যের সমাধান হয়ে যাবে না। কারণ এই সবের পিছনে ভয়, চাপ ইত্যাদিও এখন উড়িয়ে দেওয়ার নয়। সেখানেই সন্দেহ বাড়ে। যদি তেমন হয়ে থাকে, তা হলে কে কাকে কী ভয় দেখাচ্ছে, অথবা কোন উৎস থেকে কার উপর চাপ আসছে, গভীর অন্ধকারে ঢাকা সেই সব দিক নিয়ে সন্ধান জরুরি।

প্রসঙ্গত, একটি কথা ভুললে চলবে না, এ দেশে অতীতের একাধিক উদাহরণ রয়েছে যেখানে ঘটনাচক্রে প্রভাবশালী, উচ্চক্ষমতাধর কারও বিপক্ষে মামলা লড়ার অথবা রায় দেওয়ার ‘খেসারত’ সংশ্লিষ্ট আইনজীবী বা বিচারদাতাদের নানা ভাবে দিতে হয়েছে। এই মামলায় দেখা গেল, সিবিআই তিন মাসেও অভিযুক্তের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিতে পারল না। সিবিআইয়ের কৌঁসুলি বললেন, ‘অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আমাদের কোনও আবেদন নেই।’ এটা কোনও ‘স্ট্যান্ড-আপ কমেডি’, না অপদার্থতা, না কি পরিকল্পনামাফিক হাত তুলে দেওয়া, ঠিক বলতে পারব না। তবে মানতেই হবে, সাধারণের দৃষ্টিতে, মানে গলির মোড়ের গুলতানি বা চায়ের দোকানের আড্ডাতেও, সিবিআই নামক কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাটি রসিকতার খোরাক হয়ে পড়ল। আস্থাহীনতার তো বটেই।

এর ঠিক আগেই দেখা গিয়েছে, মৃতা তরুণীর মা-বাবার পক্ষে সুপ্রিম কোর্ট থেকে শিয়ালদহ কোর্ট পর্যন্ত মামলা লড়ে আসা আইনজীবী বৃন্দা গ্রোভার ও তাঁর সঙ্গী-সহকর্মীরা হঠাৎ সরে দাঁড়ালেন। এটাই বা কেন? বৃন্দার তরফে জানানো হল, এই সিদ্ধান্তের পিছনে আছে “পরিস্থিতি এবং হস্তক্ষেপজনিত কিছু বিষয় (ইন্টারভিনিং ফ্যাক্টর্স)।” খুবই অর্থপূর্ণ এই বক্তব্য। বিশেষত, পরিস্থিতির ব্যাখ্যা তাঁরা দেননি। হস্তক্ষেপের হেঁয়ালিও ভেদ করতে চাননি। পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, বিবৃতির বাইরে তাঁদের কিছুই বলার নেই।

এই নিয়ে দ্বিতীয় বার ওই পক্ষের আইনজীবী বদল হল। সবাই জানেন, মৃতা তরুণীর মা-বাবার তরফে প্রথম আইনজীবী ছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য। তিনি সুপ্রিম কোর্টের সওয়ালেও ছিলেন। হঠাৎ তাঁকে মক্কেলপক্ষ মামলা ছেড়ে দিতে বলে। তার কারণও প্রকাশ্যে এসেছে বলে জানা নেই। এর পরেই এগিয়ে আসেন বৃন্দা গ্রোভার। বিকাশবাবুর মতোই বৃন্দা এবং তাঁর আইন-সংস্থা মামলাটি লড়ছিলেন বিনা পারিশ্রমিকে। এ বার তাঁরাও সরে দাঁড়ালেন।

মামলা ছেড়ে দিয়ে সংস্থাটি এ কথাও বলেছে যে, তারা আদালতে লড়াই করে আইনের বলে, প্রমাণের উপর নির্ভর করে এবং পেশাগত নীতি মেনে। তাঁদের দু’টি বক্তব্যকে পাশাপাশি রেখে তা হলে ধরে নেওয়া যায়, যাঁরা আইন ও প্রমাণের পথে সব নীতি-পদ্ধতি মেনে মামলা লড়তে এসেছিলেন, তাঁদের কাজে এমন ‘হস্তক্ষেপ’ হয়েছে যে সেই পরিস্থিতিই তাঁদের বাধ্য করেছে আর জি কর-মামলা থেকে সরে আসতে।

অবশ্যই সরাসরি সব কিছু প্রমাণ করার সুযোগ কম। এও ঠিক যে, ‘প্রমাণ’ না পেলে জামিনও মিলে যাওয়ার কথা, সেটাই দস্তুর। প্রশ্নটা হল, এত কিছু যখন সাদা চোখেই পরিষ্কার, এবং তদন্তও যখন এগোচ্ছে, তা হলে প্রমাণ মিলছে না কেন? অনেক কিছুই তো চোখের সামনেই আছে। তবে কি ‘হস্তক্ষেপ’ সেখানেই? বৃন্দা গ্রোভার যে পথে মামলা লড়ছিলেন, তাতে আদালতে জামিনের বিরোধিতা তিনি করতেনই। তাতে মামলা অন্য ভাবে এগোনোর সম্ভাবনা থাকত। সেই জন্যই কি গ্রোভারদের কাজে এমন কোনও ‘হস্তক্ষেপ’ করা হল যাতে তিনি সরলেন, অভিযুক্তদের জামিনও হয়ে গেল? জানা নেই। তবে যদি তেমন কিছু ঘটে থাকে, তা হলে সেই ‘হস্তক্ষেপ’ খুব সহজ ব্যাপার নয়। কোনও বড় জায়গা থেকে বড় প্রভাব অথবা চাপ সৃষ্টির বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সেই ‘চাপ’ প্রকারান্তরে হুমকি হলেও বিস্ময়ের কিছু নেই।

শিয়ালদহ কোর্টে যাঁদের জামিন মিলেছে তাঁরা প্রভাবশালী নন, সে কথা বলা যাবে না। ধর্ষণ-খুনের সময় আর জি কর-এর অধ্যক্ষ ছিলেন সন্দীপ ঘোষ। উপরমহলে তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি ছিল রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রশাসনে আলোচনার বস্তু। স্থানীয় টালা থানার ওসি ছিলেন অভিজিৎ মণ্ডল। নিজ এলাকায় ওসি-র ক্ষমতা কম নয়। তাঁরা দু’জনেই মূল ঘটনার প্রমাণ লোপাটে অভিযুক্ত।

সকলের মনে আছে, ঘটনা জানার পরে অধ্যক্ষের নানা কার্যকলাপ প্রথম থেকেই প্রকাশ্যে চলে আসে। ১৪ ঘণ্টা পরে এফআইআর করা দিয়ে যার সূচনা। পরে আবার কাটাকুটি করে তার বয়ানও বদলানো হয়। নিয়ম ভেঙে সূর্যাস্তের পরে ময়নাতদন্ত, দেহ তড়িঘড়ি দাহ করা, এগুলিও প্রমাণিত। তাঁর সঙ্গে ওই দিন ওসি এবং অন্য কয়েকজন ‘প্রভাবশালী’র বিস্তর ফোনালাপও তদন্তকারীরা জানতে পারেন। সন্দীপের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত বিভিন্ন লোকজনের দ্রুত ঘটনাস্থলে চলে আসা, মৃতদেহের কাছে তাঁদের অযাচিত ভিড় অর্থাৎ একগাদা পায়ের ছাপ, হাতের ছাপ, সবই এই সব ক্ষেত্রে সুষ্ঠু তদন্ত প্রক্রিয়ার পরিপন্থী। তথ্য-প্রমাণ নষ্ট হওয়ার পক্ষেও প্রশস্ত। সেগুলিই হয়েছে। অধ্যক্ষের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অনুমোদন ছাড়া এমন যথেচ্ছাচার সম্ভব ছিল না। ঘটনার অব্যবহিত পরেই ঘটনাস্থল সেমিনার কক্ষের লাগোয়া বাথরুমের দেওয়াল, বেসিন ইত্যাদি ভেঙে সংস্কারেরই বা কী তাড়া পড়েছিল, সেই প্রশ্নটি এখনও সামনে রয়েছে।

একই ভাবে পুলিশের দায়িত্ব পালনে গাফিলতি বা ‘ইচ্ছাকৃত’ নিষ্ক্রিয়তাও এর থেকেই স্পষ্ট হয়। থানার ওসি সেই দায় এড়াতে পারেন না। মৃতদেহের সুরতহাল, আনুষঙ্গিক নমুনা সংগ্রহ এবং প্রয়োজনীয় প্রাথমিক তদন্ত না হওয়া পর্যন্ত ঘটনাস্থল ‘সুরক্ষিত’ রাখা, কাউকে ঢুকতে কিংবা কিছু স্পর্শ করতে না দেওয়া ইত্যাদি তো পুলিশি কর্তব্যের অ-আ-ক-খ। সেই কাজে ব্যর্থ হলে সেটা নিশ্চয় প্রমাণ লোপাটের উপযুক্ত অভিযোগ। বাকি তো পরের কথা।

ঘটনার ৩৫ দিন পরে ওসি-কে গ্রেফতার করে সিবিআই। একই দিনে একই অভিযোগে গ্রেফতার হন প্রাক্তন অধ্যক্ষও। তার আগেই অবশ্য দিনের পর দিন জেরা করে সন্দীপকে সিবিআই হেফাজতে নিয়েছিল আর্থিক দুর্নীতির মামলায়। পরে প্রমাণ লোপাটের অভিযোগ যুক্ত হয়। দুর্নীতির মামলায় তাঁর জামিন হয়নি। অর্থাৎ, ধর্ষণ-খুনের প্রমাণ লোপাটে অভিযুক্ত ওসি জামিনে বেরিয়ে এসেছেন এবং তাতে জামিন পেয়েও অপর মামলায় জেলেই থাকতে হচ্ছে সন্দীপকে।

এখন কথা হল, এই যদি ঘটনার প্রেক্ষাপট হয়, আদালতে তা হলে সিবিআই কী করে বলতে পারল যে, প্রমাণ লোপে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে তাদের কিছু বলার নেই! সিবিআই দাবি করছে, অভিযোগের পক্ষে তথ্যপ্রমাণ এবং কিছু ফরেন্সিক রিপোর্ট তাদের কাছে আছে। তা হলে তিন মাসেও চার্জশিট না দিয়ে, জামিনের পথ খুলে এখন ভবিষ্যতে অতিরিক্ত চার্জশিট দেওয়ার যুক্তি কত দূর বুদ্ধিগ্রাহ্য?

এর আগে সুপ্রিম কোর্টে সিবিআইয়ের জমা দেওয়া রিপোর্ট দেখে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি চন্দ্রচূড় বলেছিলেন, “অনেক কিছু মিলছে। তদন্ত ঠিক পথে এগোচ্ছে।” এই কি তার নমুনা? সন্দেহ হয়, এমন একটি ‘চিত্রনাট্য’ তৈরি হতে পারে বুঝেছিলেন বলেই কি ‘ইন্টারভিনিং ফ্যাক্টর্স’ আইনজীবী বৃন্দাকে সরে আসতে বাধ্য করল?

জামিন নিয়ে রাজনীতি চলছে, চলুক। কিন্তু ‘উই ওয়ান্ট জাস্টিস’, এটা ভুলে গেলে চলবে না।

Advertisement
আরও পড়ুন