ছবি : সংগৃহীত।
পুজো মিটতে না মিটতেই শুরু হয়ছে জ্বর-জালা। আশপাশে একটু কান পাতলেই শুনতে পাবেন কারও গলাব্যথা, কারও মাথাব্যথা, কাশি-সর্দি-জ্বর, এমনকি বদহজম, পেটখারাপ, গা-বমি ভাবের মতো সমস্যাও হচ্ছে কারও কারও। চার-পাঁচ দিন ওই সমস্যা থাকছে। তার মধ্যেই কাহিল হয়ে পড়ছেন রোগী। জ্বর যদি বা যাচ্ছে, রয়ে যাচ্ছে দুর্বলতা। অনেককে ডায়েরিয়ার মতো সমস্যা নিয়ে হাসপাতালেও ভর্তি করাতে হয়েছে ইতিমধ্যে। আর ওই জ্বর এক বার কারও হলে তাঁর পরিবারের বাকিরাও পর পর অসুস্থ হয়ে পড়ছেন!
গত এক সপ্তাহ ধরেই বাড়তে শুরু করেছে ওই জ্বরের প্রকোপ। চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী বলছেন, ‘‘এক ধরনের ভাইরাল জ্বর হচ্ছে। প্রতি বছর আরও কিছু দিন পরে, নভেম্বর-ডিসেম্বর নাগাদ এমন জ্বর হতে দেখা যায়। কিন্তু এ বার দেখা যাচ্ছে অক্টোবরেই হচ্ছে।’’ আর তার জন্য আবহাওয়াকেই দায়ী করছেন সুবর্ণ। তাঁর কথায়, ‘‘অন্য বছর অক্টোবর মাসে এত বৃষ্টি হয় না। এ বছর দেখা যাচ্ছে এক-দু’দিন পর পরই মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে বলে রোগেরও চরিত্র বদলাচ্ছে।’’
সুবর্ণের মতোই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের জেরিয়াট্রিক মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদারও মনে করেন আবহাওয়াই ওই জ্বরের কারণ। তিনি বলছেন, ‘‘সাধারণত শীত শুরু হওয়ার চার সপ্তাহ আগে থেকে যে আবহাওয়াটা তৈরি হয়, তাতে ওই ধরনের ভাইরাল জ্বর বা ইনফ্লুয়েঞ্জা বেশি হয়। এ বার বৃষ্টি হয়ে সেই সময়টা এগিয়ে এসেছে। আমাদের পর্যবেক্ষেণ বলছে, ঠান্ডা হয়তো এ বছর সামান্য আগেই পড়ে যাবে। তার জন্যই এখন থেকে ওই ধরনের জ্বর বেশি হতে শুরু করেছে।’’
খাতায়কলমে বাংলা থেকে বর্ষা বিদায় নিলেও পুজোর পর থেকেই শুরু হয়েছে বৃষ্টি। বৃষ্টি হওয়ার ফলে ঠান্ডা হচ্ছে পরিবেশ। অরুণাংশু বলছেন, ‘‘বিশেষ করে মফস্সলের দিকে ওই ঠান্ডাটা বেশি বোঝা যায়। কিন্তু তা বলে শহরের আবহাওয়া বদলাচ্ছে না, তা তো নয়। অসাবধানতার জন্যই সমস্যা হচ্ছে।’’ তবে বৃষ্টি যখন হচ্ছে না, তখন প্যাচপেচে গরম পড়ছে। সুবর্ণ মনে করছেন, ‘‘তাপমাত্রার ওঠাপড়ার জন্যও জ্বরের প্রকোপ বাড়ছে।’’
কী কী উপসর্গ?
১। হঠাৎ ঠান্ডা লাগা
২। হালকা থেকে মাঝারি জ্বর
৩। শ্বাসনালির সংক্রমণ, যেমন গলা খুসখুস, কাশি, গলায় ব্যথা, খাবার গিলতে সমস্যা, গলা ভেঙে যাওয়া, নাক বোজা, সর্দি ইত্যাদি।
৪। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর সঙ্গে বদহজম এবং ডায়েরিয়ার সমস্যাও দেখা যাচ্ছে।
জ্বর হলে কী করবেন?
এ ক্ষেত্রে উপসর্গ অনুযায়ীই ওষুধ খাওয়া উচিত বলে মনে করছেন সুবর্ণ। তিনি বলছেন, ‘‘ওই ধরনের ভাইরাল জ্বরে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিক লাগে না। অ্যান্টিভাইরালও কাজ করে না। তাই উপসর্গ যেমন, তেমনই ওষুধ খান। অর্থাৎ, জ্বর হলে প্যারাসিটামল, নাক বন্ধ হলে নাকের ড্রপ, সর্দি-হাঁচি বেশি হলে অ্যান্টিঅ্যালার্জিক ওষুধ, গলাব্যথা হলে গরম জলে স্টিম নেওয়া, পেটখারাপ বা হজমের সমস্যা হলে ওআরএস, হালকা খাওয়াদাওয়া এগুলো করলেই সাধারণত চার-পাঁচ দিনের মধ্যে সেরে যাচ্ছে।’’ তবে একই সঙ্গে তাঁর পরামর্শ, এক-দু’দিন জ্বর থাকলে অপেক্ষা না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
অরুণাংশু আবার সাবধান করেছেন ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়ার ব্যাপারেও। তিনি বলছেন, ‘‘সাধারণ ভাইরাল জ্বর নিজে থেকেই সারে। তাই জ্বর হলে নিজে থেকে অ্যান্টিবায়েটিক কিনে একেবারেই খাবেন না। বরং প্রচুর জল খান। রোজ ফল খান। জ্বর থাকলে প্যারাসিটামল খান। প্রথমেই ডাক্তারবাবুর কাছে ছোটার দরকার নেই। তবে যদি দেখেন দু’-এক দিনেও জ্বর কমছে না, তবে ফেলে রাখবেন না। কারণ, এই সময়টায় ডেঙ্গি-ম্যালেরিয়াও হয়। রোগীর পক্ষে তো তা বোঝা সম্ভব নয়। তাই দু’-এক দিন পরে জ্বর না করলে চিকিৎসককে দেখান।’’ একসঙ্গেই তাঁর পরামর্শ, ‘‘গলায় ব্যথা হলে গরম জলের ভাপ নিতে পারেন। তাতে গলায় আরাম হবে। কিন্তু গার্গল করবেন না।’’
ডায়েরিয়া হলে কী করবেন?
সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ভাইরাল জ্বর হলে ভাইরাস প্রথমে শ্বাসনালিকেই আক্রমণ করে। ফলে ফ্যারিংক্স এবং ল্যারিংক্সে সমস্যা দেখা দেয়, গলা ব্যথা হয়। অরুণাংশু বলছেন, ‘‘এর পাশাপাশি ভাইরাস খাদ্যনালিতেও সংক্রমিত হতে পারে। ইনফেকশন তৈরি হতে পারে। তখন ডায়েরিয়া হতে পারে। যদি ডায়েরিয়া হয় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
গলাব্যথায় কখন সতর্ক হবেন?
যাঁদের সিওপিডি রয়েছে বা যাঁরা ধূমপান বেশি করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে সংক্রমণ সারতে একটু বেশি সময় লাগতে পারে বলে জানাচ্ছেন সুবর্ণ। তিনি বলছেন, ‘‘ধূমপায়ীদের যদি ভাইরাল জ্বর হয়, তবে বলব কিছু দিন ধূমপান বন্ধ রাখুন। কারণ, সংক্রমণ শ্বাসনালিতে বেশি দিন থাকলে দেখা যাচ্ছে তা অনেক সময় শ্বাসনালি থেকে ফুসফুসেও ছড়াচ্ছে। কাশতে গেলে বুকে লাগছে। কফ উঠছে। সে ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স করানোর জরুরি হতে পারে।’’
কনজাংটিভাইটিসও হচ্ছে
ভাইরাল জ্বরের পাশপাশি এই সময়ে চোখে কনজাংটিভাইটিসও হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের পরামর্শ, বাইরের হাত না ধুয়ে চোখমুখে বা নাকে না দেওয়াই উচিত। কোভিডের সময়ের মতোই বাইরে থেকে বাড়িতে এসে হাত ভাল করে ধুয়ে নিন। অফিসে ঢোকার পরেও হাত সাবান দিয়ে পরিষ্কার করুন। হাতের কাছে স্যানিটাইজ়ার রাখুন।
কী ভাবে এড়াবেন?
মাস্ক: যে হেতু সংক্রামক, তাই যাঁর জ্বর হয়েছে, তিনি মাস্ক পরে থাকুন। হাত ধোয়া বা স্যানিটাইজ় করার মতো নিয়ম পালন করুন। দুই চিকিৎসক এ ব্যাপারে একই পরামর্শ দিয়েছেন। অরুণাংশু বলছেন, ‘‘কোভিড আমাদের অনেক খারাপ করেছে। কিন্তু দু’-একটি ভাল অভ্যাসও তৈরি করেছে। তার মধ্যে অন্যতম হল মাস্ক পরা।’’ বিশেষ করে যাঁরা বাস-মেট্রো-ট্রেনে যাতায়াত করেন বা ভিড়ের মধ্যে থাকেন, তাঁদের মাস্ক পরা জরুরি বলে মনে করছেন সুবর্ণও। তিনি বলছেন, ‘‘বাড়িতে যদি কারও হয়, তিনি অন্যদের সংক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য মাস্ক পরুন।’’
বৃষ্টিতে না ভেজা: বৃষ্টিতে না ভেজাই ভাল। ভিজে গেলে বাড়ি ফিরে হালকা গরম জলে স্নান করে নিন। চেষ্টা করুন ভিজে চুলে বেশি ক্ষণ না থাকতে। ভিজে জামাকাপড় বেশি ক্ষণ গায়ে না রাখতে।
তাপমাত্রার পরিবর্তন: প্রচণ্ড গরম থেকে ঠান্ডা এসি ঘরে ঢুকে পড়া। বা এসি থেকে বার বার গরমে বেরোনোও অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা বাড়িয়ে দিতে পারে।
ঠান্ডা প্রতিরোধ: ঠান্ডা লাগলে গায়ে চাদর জড়িয়ে নিন। বা রাতে হাতের কাছে একটা চাদর রাখুন। ঠান্ডা হাওয়া থেকেও দূরে থাকুন।
রোগ প্রতিরোধ: নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সব সময়েই জরুরি। তাই ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খান। জল বেশি খান। পুষ্টিকর খাবার খান।