হলিউডের মতো টলিউডের সঙ্গীতশিল্পীরাও কি অভিনয় করতে ইচ্ছুক? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সিলিন ডিয়ন, জেনিফার লোপেজ়, লেডি গাগা বা সেলেনা গোমেজ়— এঁরা প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক মহিলা সঙ্গীতশিল্পী। তবে এ ছাড়াও তাঁদের মধ্যে একটা মিল রয়েছে। আর সেটা হল, তাঁরা প্রত্যেকেই অভিনেতা। অভিনয় করেছেন একাধিক সিনেমা এবং তথ্যচিত্রে। বিদেশে প্রতিষ্ঠিত সঙ্গীতশিল্পীদের অভিনয় রেওয়াজ করার দীর্ঘ দিনের । এমনকি, বলিউডেও এ রকম উদাহরণ রয়েছে। উষা উত্থুপ এবং মোনালি ঠাকুর। কিন্তু টলিউড এখনও ব্যাকরণ ভাঙতে নারাজ, না কি সঙ্গীতশিল্পীদের উপর ‘কনফিডেন্স’-এর অভাব?
একসময় ভারতীয় সিনেমায় এমন অভিনেত্রীর সন্ধান করা হত, যিনি সুগায়িকাও বটে। এর ফলে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যেত। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সিনেমা নির্মাণের বিভিন্ন ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। ফলে সময়ের সঙ্গে অভিনয় এবং প্লেব্যাক পরস্পরের থেকে আলাদা হয়ে যায়। টলিউডে প্রায়ই অভিযোগ ওঠে, অভিনয়ের জন্য দক্ষ অভিনেতার বড়ই অভাব। দীর্ঘ দিন ইন্ডাস্ট্রিতে কোনও নতুন নায়িকা উঠে আসেননি। সেখানে মহিলা সঙ্গীতশিল্পীদের কথা ভাবা হচ্ছে না কেন? সমস্যা কোথায়? আনন্দবাজার অনলাইনের তরফে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল ইন্ডাস্ট্রির কয়েক জন প্রতিষ্ঠিত শিল্পী এবং প্রথম সারির পরিচালকের কাছে। আলোচনায় উঠে এল বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ।
সম্প্রতি প্রিয়ঙ্কা চোপড়া অভিনীত ‘লভ এগেন’ ছবিটি ওটিটিতে মুক্তি পেয়েছে। এই ছবিতে ‘মাই হার্ট উইল গো অন’ খ্যাত সিলিনের অভিনয় দর্শকদের নজর কেড়েছে। আবার ‘অ্যানাকোন্ডা’, ‘হাসলারস’ বা সাম্প্রতিক ‘মাদার’ ছবিতে জেনিফারের অভিনয় অনুরাগীদের কাছে বাড়তি পাওনা। ‘আ স্টার ইজ় বর্ন’ বা ‘হাউস অব গুচ্চি’ তে অভিনয় করে নজর কেড়েছেন লেডি গাগা। এমনকি, দর্শক মুখিয়ে রয়েছেন আগামী বছর ‘জোকার ২’ ছবিতে তাঁর অভিনয় দেখার জন্য। কারণ, এই ছবিতে হার্লে কুইনের চরিত্রে অভিনয় করছেন তিনি। টলিউড এই ধরনের পথে এগোচ্ছে না কেন?
ইন্ডাস্ট্রিতে প্রায় ১৬ বছর গান গাইছেন সোমলতা আচার্য চৌধুরী। প্রশ্ন শুনেই তাঁর সহজ উত্তর, ‘‘আমি তো টেবিলের বিপরীতে বসে রয়েছি। উত্তরটা প্রযোজক বা পরিচালকেরাই আরও ভাল দিতে পারবেন।’’ তবে স্বীকার করলেন তাঁর কাছেও অতীতে অভিনয়ের প্রস্তাব এসেছে। কিন্তু রাজি হলেন না কেন? সোমলতা বললেন, ‘‘আমার মনে হত, সবার দ্বারা সব কিছু সম্ভব না-ও হতে পারে। কারণ আমি শিখে কাজ করায় বিশ্বাসী।’’ কিন্তু সময়ের সঙ্গে সোমলতা বুঝতে পেরেছেন, মঞ্চে পারফর্ম করা বা মিউজ়িক ভিডিয়োয় কাজ করাটাও অভিনয়ের মতো। কারণ তাঁর কথায়, ‘‘জীবনটাই তো একটা বড় মঞ্চ। মন ভাল না থাকলেও হয়তো মঞ্চে হাসিমুখে কখনও গান গাইতে হল। সেটাও তো এক রকমের অভিনয়।’’ তাই এখন অভিনয়কে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত অভিনেত্রী। প্রস্তাব এলে সটান না বলবেন না। সোমলতা বললেন, ‘‘অভিনয়ের আগে কিছু জিনিস শিখে নেওয়াটা প্রয়োজন। চেষ্টা করব। তার পর না পারলে নিশ্চয়ই সরে আসব।’’ কথাপ্রসঙ্গেই জানালেন, হলিউডের সঙ্গীতশিল্পীদের বিভিন্ন মাধ্যমে অভিনয় তাঁর কাছে অনুপ্রেরণার কাজ করে।
বাংলা ছবির ইতিহাসে যে কিছু অভিনেতা এক সময় গানেও পারদর্শী ছিলেন, সে কথা স্মরণ করিয়ে দিলেন পরিচালক অতনু ঘোষ। তাঁর কথায়, ‘‘কিন্তু এখন সেই ধারা আর নেই। অভিনয় এবং সঙ্গীত শিল্পের দুটো আলাদা ক্ষেত্র। তাই গায়িকারা কতটা সিরিয়াস সেটাও দেখতে হবে।’’ কথাপ্রসঙ্গেই টলিপাড়ায় অতীত অভিনেত্রীদের মধ্যে ছায়াদেবী, কানন দেবী, শকুন্তলা বড়ুয়া বা বর্তমানে রূপা গঙ্গোপাধ্যায়ের কণ্ঠ মনে করিয়ে দিলেন অতনু। তবে নিজের ছবিতে প্রয়োজনে তিনি অভিনেত্রীকে দিয়েই গান গাইয়ে নিতে অধিক আগ্রহী। পরিচালকের ‘বিনিসুতোয়’ এবং ‘শেষ পাতা’ ছবিতে যথাক্রমে জয়া আহসান এবং গার্গী রায়চৌধুরীর কণ্ঠে গান দর্শকদের এখনও মনে আছে। অতনুর যুক্তি, ‘‘যিনি গায়িকা, তিনি এতটাই নিখুঁত, সেটা অনেক সময়েই ওই চরিত্রের সঙ্গে বেমানান হতে পারে। পাশাপাশি গানটা অনেক সময় শিল্পীর নামে পরিচিতি পায়। সেটা ছবির ক্ষতি করতে পারে।’’
গায়িকা ইমন চক্রবর্তী অবশ্য বিষয়টাকে অন্য ভাবে দেখতে চাইছেন। বললেন, ‘‘নির্মাতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। এ রকমও তো হতে পারে দু-এক জন ছাড়া বাকিরা হয়তো অভিনয়ে আগ্রহ দেখাননি।’’ কিন্তু লক্ষ্যণীয়, ইমন নিজে ‘নীতিশাস্ত্র’ ছবি এবং ‘শব চরিত্র’ নামের একটি ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় করেছেন। এই প্রসঙ্গে ইমন বললেন, ‘‘তার পর অনেক জায়গা থেকে প্রস্তাব এসেছে। আমি রাজি হইনি। কারণ, কাকে গুরুত্ব দিচ্ছি সেটাও বিচার্য। গান গাইব না কি অভিনয় করব।’’ ইমনের মতে, যাঁরা সিরিয়াস শিল্পী তাঁরা অভিনয় নিয়ে খুব বেশি মাথা ঘামান না। বলিউডেও তাই গায়িকা পাল্লা দিয়ে অভিনয় করছেন, সেই সংখ্যা খুব বেশি নয় বলেই মনে করেন ইমন। ‘‘আমার প্লেব্যাকের সঙ্গে অভিনয়কে তাই দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে লাভ নেই। সেখানে গানের পাল্লাই ভারী থাকবে। ভবিষ্যতেও সেই চেষ্টাই করব’’, বললেন লেডি গাগার অভিনয়ের ভক্ত ইমন।
সঙ্গীত এবং অভিনয় দুটো আলাদা ক্ষেত্র এবং সমান তালে তা চালিয়ে যেতে হলে ব্যক্তিকে ‘জিনিয়াস’ হতে হয় বলেই মনে করেন পরিচালক অরিন্দম শীল। কথাপ্রসঙ্গেই তিনি মনে করিয়ে দিলেন কিশোর কুমার বা হলিউডে লেডি গাগার কথা। শিল্পীরা বলছেন, ভাবতে হবে নির্মাতাদের। অরিন্দম পাল্টা বললেন, ‘‘দুটো জিনিসের মধ্যে গুলিয়ে ফেললে মুশকিল। যে কোনও পেশার ক্ষেত্রে আমাকে আগে সেটা ঘোষণা করতে হবে। তা না হলে তো নির্মাতারা বুঝতে পারবেন না যে, তিনি অভিনয় করতে আগ্রহী কি না।’’ অরিন্দম জানালেন, কলকাতার গায়িকাদের মধ্যে একমাত্র ইমনই তাঁকে অভিনয় করার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সময়ের অভাবে তা বাস্তবায়িত হয়নি। অরিন্দমের যুক্তি, ‘‘আমি জানি শ্রেয়া ঘোষাল প্রচুর অভিনয়ের প্রস্তাব পেয়েছেন। কিন্তু রাজি হননি। একটা ছবির শুটিংয়ের জন্য হয়তো দেখা যাবে শিল্পীদের ১০টা লাইভ শো ছাড়তে হল। এখানকার শিল্পীরা কি সেটা করতে পারবেন?’’ পাশাপাশি টলিপাড়ার পরিস্থিতির কথাও উত্থাপন করলেন ‘জঙ্গলে মিতিন মাসি’ ছবির পরিচালক। অরিন্দম বললেন, ‘‘আমাদের এখানে নিজের পেশায় জায়গা পেতে, টিকে থাকতে এবং প্রথম সারিতে জায়গা ধরে রাখতে যে প্রচণ্ড সময় ব্যয় করতে হয়, তার পর অন্য কোনও শিল্প মাধ্যমে সময় দেওয়াটা স্বাভাবিক ভাবেই কঠিন হয়ে ওঠে।’’ তাই হলিউডের মডেলে টলিউড, এই ভাবনায় অনেক সমস্যা রয়েছে বলেই মনে করেন অরিন্দম।
নতুন প্রজন্মের মধ্যে সঙ্গীতশিল্পী লগ্নজিতা চক্রবর্তী দীর্ঘ দিন ইন্ডাস্ট্রিতে রয়েছেন। এক সময় অভিজিৎ গুহ পরিচালিত ‘যদি বলো হ্যাঁ’ ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কিন্তু সঙ্গীতের পাশাপাশি তাঁকে অভিনয়ে আর দেখা গেল না কেন? ‘বসন্ত এসে গেছে’-র গায়িকা বললেন, ‘‘উত্তরটা আমার জানা নেই। কোনও গায়িকাকে অভিনয়ে সুযোগ দেওয়ার বিষয়টা নির্ভর করে নির্মাতাদের উপর।’’ লগ্নজিতা জানালেন, এক সময় তাঁর কাছেও কয়েক বার অভিনয়ের প্রস্তাব এসেছে। তালিকায় টলিপাড়ার প্রথম সারির পরিচালক থেকে শুরু করে নতুন পরিচালকদেরও নাম রয়েছে। কিন্তু রাজি হননি লগ্নজিতা। বললেন, ‘‘সেই সময় আমি অভিনয় নিয়ে আলাদা কিছু ভাবিনি। তখন গানেই বেশি মনোনিবেশ করতে চেয়েছিলাম। এখন প্রস্তাব এলে কী হবে, সেটাও বলা মুশকিল।’’ তবে কোনও গায়িকার কাছে ছবি বা ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় যে নতুন চ্যালেঞ্জ সে কথাও বিশ্বাস করেন লগ্নজিতা। তাঁর কথায়, ‘‘মিউজ়িক ভিডিয়ো বা কোনও বিজ্ঞাপনের তুলনায় ছবি এবং ওয়েব সিরিজ়ে অভিনয় সম্পূর্ণ আলাদা।’’ গায়িকার মতে, মিউজ়িক ভিডিয়ো তাঁদেরই শিল্পের অপর একটি রূপ। তাই সমস্যা হয় না। বিজ্ঞাপনী ছবির দৈর্ঘ্যও যথেষ্ট কম। তাই সমস্যা হয় না। কিন্তু পূর্ণ দৈর্ঘ্যের সিনেমার ক্ষেত্রে অভিনয়ের বিভিন্ন দিক শিখে তার পরই পা বাড়াতে ইচ্ছুক লগ্নজিতা।
সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে, বাংলার এই প্রজন্মের শিল্পীরা কিন্তু অভিনয় থেকে মুখ ফিরিয়ে নেই। কেউ যেমন বিষয়টা নিয়ে আগ্রহী, তেমনই কেউ আবার প্রাথমিক পাঠ নিয়ে তার পর ময়দানে নামতে ইচ্ছুক। এখন নির্মাতারা তাঁদের কথা ভাববেন কি না, সেটা সময় বলবে।