Bengali Pulp Fiction

বাজারে রমরমা থ্রিলার ও রহস্যের, সত্যিই কি ফিরছে বাংলা ‘পাল্প’ সাহিত্য?

আশির দশকের পর থেকে বাংলা চটি রহস্য গল্পের জমানা প্রায় শেষ। রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি ফেলুদার সুশীল বৈঠকখানার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু, তার পর?

Advertisement
অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৯:১৩
What happened to the Bengali pulp fiction

দীনেন রায়, শশধর দত্ত বা স্বপনকুমারের সেই জগৎ কি আজও রয়েছে বাংলা সাহিত্যে? অ্যানিমেশন: শৌভিক দেবনাথ।

ঘনঘোর অন্ধকারে নির্জন সুড়ঙ্গপথে একলা নায়ক সন্তর্পণে এগোচ্ছে। তার দু’হাতে রিভলভার এবং অন্য হাতে টর্চ।

Advertisement

অথবা, দুশমনের পরীক্ষাগারে প্রবেশ করেই নায়ক বুঝতে পারল, সেখানে অ্যাটম বোমা তৈরি হয়। চুপিসারে সে বয়াম থেকে একমুঠো অ্যাটম তুলে নিয়ে যন্ত্রের ফোঁদলে ঢেলে দিয়ে হাতল ঘোরাতে লাগল আর যন্ত্রের অন্য প্রান্তের মুখ দিয়ে একের পর এক অ্যাটম বোমা বেরিয়ে আসতে লাগল— টপ… টপ… টপ…।

উপরের বর্ণনাগুলি এখনকার তরুণেরা রসিকতা বলে উড়িয়ে দেবেন। কিন্তু পঞ্চাশ বছর আগে বাংলাতেই এমন বর্ণনা হামেশা লেখা হয়েছে এবং পাঠকেরা তা গোগ্রাসে পড়েওছেন। কেউ এই পঙ্‌ক্তিগুলির ‘জনক’ হিসাবে স্বপনকুমারকে দেখিয়ে দেন। অনেকের মতে, এগুলির লেখক শশধর দত্ত বা আরও প্রাচীন দীনেন্দ্রকুমার রায়। দীনেন্দ্রকুমার, শশধর দত্ত বা স্বপনকুমার তিন আলাদা প্রজন্মের মানুষ হলেও এঁদের এক জায়গায় মিল ছিল। এঁরা তিন জনেই ছিলেন ‘পাল্প’ লেখক। অবশ্য সেকালের বাংলা ‘পাল্প’ শব্দটির সঙ্গে তেমন পরিচিত ছিল বলে মনে হয় না। রুচিশীলরা বড়জোর ‘রদ্দি’ বা ‘রগরগে’ বলে সেগুলিকে দেগে দিতেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেই যে এই ‘সাহিত্য’ লুকিয়ে পড়তেন, তার সাক্ষ্যও কিছু কম নেই।

এই সব কাহিনিকে ‘বটতলা’ বলে নাক সিঁটকে দূরে ছিল ভদ্রসমাজ। উনিশ শতকের বটতলা আর বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের ‘শ্রীস্বপনকুমার প্রণীত’র মধ্যে অবশ্যই একটা ফারাক ছিল। উনিশ শতকের বটতলা একটা মহীরুহ ব্যাপার! রহস্য-রোমাঞ্চ-ধর্ম-অর্থ-কাম-টোটকা সব মিলিয়ে অতুল কাণ্ড। কিন্তু বিশ শতকে স্বপনকুমারের বইগুলির রকম-সকম আলাদা। তবে সেই বইগুলিকে ‘বটতলা’ বলার একটা বড় কারণ তার সস্তা, প্রায় হলদেটে কাগজ আর পিতপিতে মলাটে রংচঙে ছবি।

সেই সব দিন বিগত। দীপক চ্যাটার্জির শ্যাম্পুরুক্ষ চুল বাতাসে আর ওড়ে না, তার কানের পাশ দিয়ে সাঁই-সাঁই শব্দে আর গুলি ছুটে যায় না। আশির দশকের পর থেকে রহস্য-রোমাঞ্চ কাহিনি ফেলুদার সুশীল বৈঠকখানার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সত্যজিৎ নিজে ‘পাল্প’ লেখকদের ট্রিবিউট দিতে ভোলেননি। লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু সেই বিরল হয়ে আসা প্রজাতিরই প্রতিনিধি। তাঁর হিরো প্রখর রুদ্রের সঙ্গে দীপক চ্যাটার্জির দূরত্ব যে খুব বেশি নয়, তা লেখক আভাসে-ইঙ্গিতে প্রায়শই বুঝিয়ে দিতেন। কিন্তু ওই অবধিই। তার পরে আর বাংলা ‘পাল্প’ ফিকশনের নামগন্ধ বিশেষ পাওয়া যায়নি। ‘পাল্প’ বলতে ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ নায়ক ও তার কেরামতি, সামাজিক প্রেক্ষিতবিহীন রোমাঞ্চকাহিনি, যার মেয়াদ যত ক্ষণ পাঠক পড়ছেন, তত ক্ষণই। কিন্তু তার পরেও নটেগাছটি মুড়িয়েও মুড়োলো না। সমাজমাধ্যমের বিস্তার আর ‘প্রিন্ট অন ডিমান্ড’ (পিওডি)-এর মতো প্রযুক্তি হাতে পাওয়ার পর বাংলায় আবার দেখা দিল উচ্চকিত রঙের মলাটওয়ালা ‘শ্বাসরোধকারী’ শয়ে শয়ে বই। নিন্দেমন্দ থেকে প্রশংসা— সব ঘটে গেল। লেখক-লেখিকারা নিজের ফেসবুক পেজে পোস্ট করতে লাগলেন ‘প্রথম সংস্করণ শেষ’। শুধু রহস্যে পোষাচ্ছে না দেখে বাজারে আবির্ভাব ঘটল ‘তান্ত্রিক থ্রিলার’-এর। খেলা ক্রমে জমে উঠল।

What happened to the Bengali pulp fiction

চটি বইয়ের দুনিয়া ছাড়িয়ে স্বপনকুমার আজ রচনাবলির ভিতরে। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

কিন্তু সত্যিই কি জমল? স্বপনকুমার বা শশধর দত্তের বই ঘিরে পাঠকের উন্মাদনা কি ফিরে এল বাংলায়? দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য অনেক দিন ধরেই লিখছেন রোমাঞ্চ কাহিনি। তিনি এই মুহূর্তে এক প্রকাশনা সংস্থারও কর্ণধার। তাঁর সংস্থা থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হয় রোমাঞ্চ সাহিত্য, কল্পবিজ্ঞান, ‘হরর’ কাহিনি। তিনি মনে করেন, বাংলায় ‘পাল্প’ ফিরছে। তার অন্যতম কারণ, সমাজমাধ্যমের রমরমা আর পিওডি প্রযুক্তি চালু হওয়া। বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রথমে সমাজমাধ্যমে তাঁদের গল্প বা ধারাবাহিক লিখছেন। পাঠকের সাড়া পেলে (অথবা না পেলেও) তাকে বই করে ফেলছেন। বিষয় হিসেবে এঁদের মধ্যে অধিকাংশই বেছে নিচ্ছেন সেই সমস্ত কিছু, যা একদা ‘পাল্প’ নামে পরিচিত ছিল। নতুন যাঁরা আসছেন, তাঁদের সকলেই কি অপটু? দেবজ্যোতি বললেন, “প্রথমে অনেকেই প্রস্তুতি নিয়ে আসেন না। কিন্তু ক্রমে এঁদের মধ্যে থেকেই দু’চার জন পোক্ত হয়ে ওঠেন।”

সম্প্রতি আতঙ্ক কাহিনি ‘একানড়ে’ এবং রহস্য কাহিনি ‘শেষ মৃত পাখি’ লিখে নজর কেড়েছেন শাক্যজিৎ ভট্টাচার্য। শাক্যজিৎ সেই সব ধাঁচাতেই লিখতে চান, যা ‘পাল্প’-এর বিষয়। কিন্তু তাঁর প্রকল্প সিরিয়াস আখ্যান লেখা। শাক্যজিৎ বিনয়ের সঙ্গে বললেন, “পাল্প লেখার যোগ্যতা আমার নেই। অথচ আমি বড় হয়েছি পাল্প পড়েই।” উঠে এল সেই সময়ের কথা, যখন স্বপনকুমার রাজত্ব করছেন বঙ্গসাহিত্যের সুড়ঙ্গভূমিতে। শাক্যজিতের মতে, সেই সময়ে একটা বড় অংশের পাঠক ছিলেন শ্রমজীবী মানুষ। পরে তাঁরা টেলিভিশনকে বিনোদন মাধ্যম হিসেবে বেছে নিলে উধাও হয় পাল্প-সভ্যতা।

তা হলে এই মুহূর্তে জনপ্রিয় সাহিত্যের মধ্যেই কি ঢুকে রয়েছে ‘পাল্প’-এর লক্ষণ? লেখিকা দেবারতি মুখোপাধ্যায়ের প্রশ্ন, “প্লট আর নায়কপ্রধান ‘পাল্প’ কি ফিরেছে বাংলায়?” তাঁর মতে, তিনি যা লেখেন, তা আদৌ ‘পাল্প’ নয়। তাঁর লেখায় সামাজিক প্রেক্ষিত বা ইতিহাস একটা বড় অংশ জুড়ে থাকে। তাঁর উপন্যাসে ইতিহাস বেশ মহিমা নিয়েই উপস্থিত। সেই সব আখ্যানকে কি ‘পাল্প’ বলা যাবে? দেবারতি বললেন, “থ্রিলার দিয়ে আমার সাহিত্য জীবন শুরু হলেও এখন ঐতিহাসিক উপন্যাসও লিখছি। লেখার চরিত্র অনেকটাই বদলে যাচ্ছে।” তিনি জানালেন, তিনি লেখার আয়ুতে বিশ্বাসী। ‘পাল্প’-এর মতো ‘ক্ষণিকের সাহিত্যে’ নয়।

তা হলে বাংলা ‘পাল্প’ কি হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমাজমাধ্যমে কিছু নবীনের কলমচারণা? বইমেলার মাঠে নতুন একটি প্রকাশনার স্টলে ছিল সত্তরের দশকের কবির কবিতাসংগ্রহের পাশে ‘ভয়াল ভয়ঙ্কর’ মলাটের থ্রিলার বা অতিপ্রাকৃত কাহিনির বই। প্রশ্ন করায় উত্তর মিলল, “এখন তো এ সব না ছাপলেই নয়!” জনান্তিকে জানা গেল, এ ধরনের বেশির ভাগ বই ছাপা হয় লেখকের নিজের অর্থে। আর সে ক্ষেত্রে ‘পিওডি’ করে কিছু কপি প্রকাশকের ঘরে রেখে বাকিটা লেখকের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

সম্প্রতি স্বপনকুমার আর তাঁর নায়ককে ফিরিয়ে এনেছেন দেবালয় ভট্টাচার্য তাঁর ‘শ্রীস্বপনকুমারের বাদামী হায়নার কবলে’ ছবিতে। এই ছবির কল্যাণেই আবার খোঁজ পড়ল স্বপনকুমারের। কলেজ স্ট্রিটের এক মূলধারার প্রকাশন থেকেই খণ্ডে খণ্ডে প্রকাশিত হচ্ছে ‘স্বপনকুমার সমগ্র’। সেই প্রকাশনা সংস্থার কর্ণধার নিমাই গড়াই জানালেন, ভাল কাটতি সে বইয়ের। তাঁর কথায়, “নতুন প্রজন্ম পুরনোদের কাছ থেকে শুনেছে স্বপনকুমারের কথা। তারা আগ্রহের সঙ্গেই কিনছে এই বই।”

তা হলে কি বাংলা ‘পাল্প’ আটকে রয়েছে এক ‘স্মৃতির শহরে’? ‘স্বপনকুমার’ ছদ্মনামটির পিছনে ছিলেন সমরেন্দ্রনাথ পাণ্ডে নামে এক আশ্চর্যকর্মা মানুষ। শতাধিক রহস্যকাহিনি লেখার পরে তিনি ‘শ্রীভৃগু’ নামে জ্যোতিষের বই লিখেছেন। লিখেছেন ঘরোয়া চিকিৎসা থেকে হাঁস-মুরগি পালন বা মোটর মেরামতির বইও। তিনি গত হয়েছেন বেশ কিছু কাল। কিন্তু যখনই ‘পাল্প’ সাহিত্যের কথা ওঠে, তিনি যেন সেই স্মৃতির শহরে মুচকি হেসে ওঠেন। সে হাসির পিছনে জমা থাকে ইঙ্গিত, যেন তিনি বলতে চান, তাঁকে ছাড়া বাঙালির সাহিত্যের ভোজ অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ফিনফিনে মলাট থেকে বেরিয়ে এসে দীপক চ্যাটার্জি আর তার দুর্ধর্ষ ভিলেন ড্রাগন, কালনাগিনী প্রমুখ আজ রচনাবলিতে। বাঙালি কি এখনও মকশো করছে তাদের উত্তরাধিকার তৈরির? কোথাও যেন মশলা মাখায় উনিশ-বিশ হয়ে যাচ্ছে। পলকা-পোক্ত, নরম-কঠিন, গেরামভারি-ফক্কুড়ে বিভিন্ন রকমের লেখা পাক খাচ্ছে সাহিত্যবাজারের অন্ত্রে। কিন্তু ‘পাল্প’ অধরাই থেকে যাচ্ছে!

আরও পড়ুন
Advertisement